
প্রতিদিনই নীরবে বাড়ছে হৃদরোগের ঝুঁকি। অথচ সময়মতো সচেতনতা না থাকলে এই নীরব ঘাতকই হয়ে উঠতে পারে প্রাণঘাতী। হৃদরোগ কেবল একটি নয়, বরং একাধিক জটিল অবস্থা ও সমস্যার সম্মিলিত নাম। এর মধ্যে রয়েছে জন্মগত ত্রুটি থেকে শুরু করে বয়সজনিত বা জীবনধারাজনিত জটিলতা পর্যন্ত।
হার্টের রোগকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ’ বা সিভিডি। এটি এমন একটি শব্দগুচ্ছ, যার আওতায় পড়ে হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালির বিভিন্ন রোগ। কেউ কেউ জন্মগতভাবে এই রোগে আক্রান্ত হন, যাকে বলা হয় কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজ। আবার অনেকের ক্ষেত্রে বয়স, জীবনধারা ও অন্যান্য ঝুঁকির কারণে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই রোগ গড়ে ওঠে। সবচেয়ে প্রচলিত রূপ হলো করোনারি আর্টারি ডিজিজ, যা মূলত হার্টের ধমনীতে চর্বি জমে রক্তপ্রবাহ ব্যাহত হওয়ার মাধ্যমে হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি পাঁচটি মৃত্যুর মধ্যে একটির কারণ হৃদরোগ। ২০২০ সালে প্রায় ৬ লাখ ৯৭ হাজার মানুষ এই রোগে প্রাণ হারান। শুধুমাত্র করোনারি আর্টারি ডিজিজেই আক্রান্ত প্রায় ১ কোটি ৮২ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকান নাগরিক। তাই হৃদরোগ সম্পর্কে প্রাথমিক লক্ষণ, ঝুঁকি, প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা সম্পর্কে সচেতন হওয়া আজ সময়ের দাবি।
কোন কোন ধরণের হৃদরোগ রয়েছে?
হৃদরোগ বলতে সাধারণত কয়েক ধরনের সমস্যাকে বোঝানো হয়। এর মধ্যে রয়েছে-
কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজ, অর্থাৎ জন্ম থেকেই হৃৎপিণ্ডের গঠনে ত্রুটি।
করোনারি হার্ট ডিজিজ, যা ধমনীতে চর্বি জমে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে।
হার্ট অ্যাটাক বা মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন, যা সাধারণত করোনারি রোগের কারণে ঘটে। এতে হঠাৎ করে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে হৃদপেশির মৃত্যু হয়।
হার্ট ফেলিউর বা হৃদযন্ত্রের অক্ষমতা, যেখানে হৃৎপিণ্ড পুরো শরীরে প্রয়োজনীয় রক্ত পাম্প করতে ব্যর্থ হয়।
অ্যারিদমিয়া, অর্থাৎ হৃদস্পন্দনের অস্বাভাবিকতা। কখনো খুব দ্রুত, কখনো খুব ধীরে, কখনো আবার অনিয়মিতভাবে হার্ট বিট হতে পারে।
ভাল্ভের সমস্যা, যেমন ভালভ স্টেনোসিস, যেখানে হৃদযন্ত্রের কোনো ভালভ সম্পূর্ণ খুলতে পারে না এবং এতে রক্ত পিছনের দিকে ফিরে যায়।
হার্ট ফেলিউর আর হার্ট ডিজিজ কি এক?
অনেকে ‘হার্ট ডিজিজ’ ও ‘হার্ট ফেলিউর’ শব্দ দুটি গুলিয়ে ফেলেন। কিন্তু হার্ট ফেলিউর হৃদরোগের একটি মাত্র রূপ। এটি এমন একটি অবস্থা, যেখানে হৃদযন্ত্র পর্যাপ্ত রক্ত পাম্প করতে পারে না। অন্যদিকে, হার্ট ডিজিজ বলতে সমস্ত প্রকার হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালির সমস্যার সমষ্টিকে বোঝানো হয়।
কীভাবে বুঝবেন আপনি হৃদরোগে আক্রান্ত?
হৃদরোগের লক্ষণ সব সময় স্পষ্ট হয় না। অনেকেই বছরের পর বছর ধরে কোনো উপসর্গ ছাড়া বেঁচে থাকেন, যতক্ষণ না গুরুতর জটিলতা দেখা দেয়। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে আপনি সাবধান হতে পারেন।
বুকের ব্যথা বা চাপ অনুভব, পিঠ বা গলায় ব্যথা, বুক ধড়ফড় করা, মাথা ঘোরা, বমিভাব বা বমি, শ্বাসকষ্ট, অতিরিক্ত ক্লান্তি, পা বা পেট ফুলে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা গেলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। নারীদের ক্ষেত্রে অনেক সময় বুকের ব্যথা ছাড়াই অন্যান্য উপসর্গ দেখা দিতে পারে, বিশেষ করে বয়স যদি ৬৫-এর কম হয়।
হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগের উপসর্গ মানেই জরুরি অবস্থা
উপরের যেকোনো উপসর্গ দেখা দিলেই দ্রুত জরুরি চিকিৎসা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। কারণ তাৎক্ষণিক চিকিৎসা না পেলে হার্ট অ্যাটাকের ফলে হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যেতে পারে, যার পরিণতি হতে পারে মৃত্যু।
প্রাথমিক সতর্কতা বা আগাম সংকেত চিনে নিন
অনেক সময় গুরুতর হার্ট অ্যাটাকের আগেও শরীর আগাম কিছু সংকেত দেয়। যেমন বুক চেপে ধরা বা টানটান ব্যথা, হাত বা ঘাড়ে অস্বস্তি, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, হঠাৎ ঠান্ডা ঘাম হওয়া, বমিভাব, মাথা হালকা লাগা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
হৃদরোগের কারণ কী?
সবাই একরকম কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হন না। কেউ জন্মগতভাবে হৃদযন্ত্রের গঠনগত সমস্যায় ভোগেন। আবার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ধমনীতে চর্বি জমে (অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস) রক্তপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে হৃদরোগ হয়। কিছু মানুষের ক্ষেত্রে রক্তনালির সংকোচন বা প্রসারণের স্বাভাবিক ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়, যার ফলে শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ী রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়।
কারা বেশি ঝুঁকিতে?
হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায় এমন কিছু কারণ আছে, যেগুলো নিয়ন্ত্রণযোগ্য নয়। যেমন বয়স, পারিবারিক ইতিহাস বা জেনেটিক বৈশিষ্ট্য। আবার কিছু ঝুঁকি রয়েছে যেগুলো আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। যেমন ধূমপান, অনিয়মিত জীবনযাপন, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া, মানসিক চাপ, ঘুমের অভাব কিংবা ব্যায়ামের ঘাটতি। এছাড়া উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস, স্থূলতা, কিডনির অসুখ, মানসিক সমস্যা বা কিছু অটোইমিউন রোগও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
কীভাবে হৃদরোগ প্রতিরোধ করবেন?
হৃদরোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো জীবনধারায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনা। এর মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, যেমন তাজা ফল, সবজি, চর্বি ও চিনি কমানো, নিয়মিত ব্যায়াম করা, ধূমপান ছেড়ে দেওয়া, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, পর্যাপ্ত ঘুম এবং স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণে রাখা। এছাড়া যারা উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসে ভোগেন, তাদের ওষুধ নিয়মিত গ্রহণ করা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কীভাবে হৃদরোগ শনাক্ত হয়?
চিকিৎসক প্রথমে আপনার উপসর্গ, পারিবারিক ইতিহাস ও শারীরিক অবস্থা মূল্যায়ন করবেন। এরপর প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন পরীক্ষা করা হতে পারে। যেমন রক্তে কোলেস্টেরল বা চিনি মাপা, ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাম, এমআরআই, সিটি স্ক্যান, স্ট্রেস টেস্ট কিংবা অ্যাঞ্জিওগ্রাম।
চিকিৎসা কীভাবে হয়?
হৃদরোগের চিকিৎসা নির্ভর করে রোগের ধরণ ও মাত্রার ওপর। সাধারণত জীবনযাপন পদ্ধতি পরিবর্তন, ওষুধ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হয়।
ওষুধের মধ্যে রয়েছে এন্টিহাইপারটেনসিভ, বিটা-ব্লকার, স্ট্যাটিন, অ্যান্টিডায়াবেটিক, নাইট্রেট, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ ইত্যাদি। অনেক সময় কমপ্লিমেন্টারি থেরাপিও ব্যবহার করা হয়, যেমন যোগব্যায়াম, মেডিটেশন, কিছু হারবাল সাপ্লিমেন্ট। তবে সব সময় চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েই এগুলো গ্রহণ করা উচিত।
অস্ত্রোপচারের মধ্যে রয়েছে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি (স্টেন্ট বসানো), বাইপাস সার্জারি বা প্রয়োজনে মায়োকার্ডিয়াল রিভাসকুলারাইজেশন, যেখানে লেজারের মাধ্যমে হার্টে ছোট ছিদ্র করে রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক করা হয়।
হৃদরোগ থাকলে কেমন জীবন যাপন করবেন?
হৃদরোগ থাকলেও নিয়ম মেনে চললে দীর্ঘ ও ভালো জীবন যাপন সম্ভব। এজন্য চিকিৎসকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা, ওষুধ সময়মতো খাওয়া, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, ব্যায়াম, ঘুম ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া জরুরি। প্রয়োজনে কাউন্সেলিং, পরিবার ও বন্ধুদের সহায়তা, কিংবা সাপোর্ট গ্রুপে যোগ দেওয়াও সাহায্য করতে পারে।
হৃদরোগ প্রতিরোধযোগ্য, যদি আপনি সময়মতো সতর্ক হন। জীবনধারায় ছোট পরিবর্তনও বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। তাই নিজের হৃদয়কে ভালোবাসুন, সচেতন থাকুন, নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং সুস্থ জীবন উপভোগ করুন।
সূত্র:https://tinyurl.com/msrdkuk7
আফরোজা