ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জলবায়ু সম্মেলন

শেষ মুহূর্তে সমঝোতায় পৌঁছানোর আপ্রাণ চেষ্টা 

কাওসার রহমান, শার্ম আল শেখ (মিশর) থেকে

প্রকাশিত: ২২:১৫, ১৮ নভেম্বর ২০২২; আপডেট: ২২:১৫, ১৮ নভেম্বর ২০২২

শেষ মুহূর্তে সমঝোতায় পৌঁছানোর আপ্রাণ চেষ্টা 

জলবায়ু সম্মেলন ২০২২

জলবায়ু সম্মেলনের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে জটিল ইস্যুগুলোতে সমঝোতায় পৌঁছানোর আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। শেষ মুহূর্তে বৈঠকে বালি থেকে উড়ে  এসে যোগ দিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসে। 

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বিশ্ব নেতাদের প্রচেষ্টার প্রতিফলন ঘটাতে একযোগে কাজ করছে স্বয়ং জাতিসংঘ, আয়োজক দেশ মিশর এবং জলবায়ু সংস্থা  ইউএনএফসিসিসি।

জলবায়ু সম্মেলন আয়োজনে জড়িত এই তিন সংস্থা আজ শুক্রবার শেষ দিনে সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছে। এতে দেখা যাচ্ছে, অনেক বিষয়ে অগ্রগতি হলেও কার্বন নি:সরণ কমানোর পরিমাণ বৃদ্ধি, লস এন্ড ডেমেজ ও অর্য়ানের মতো জটিল ইস্যুতে অগ্রগতি এখনো পিছিয়ে আছে। 

সবচেয়ে আশ্বর্যের বিষয় হলো গত ৭ ও ৮ নভেম্বর হাই লেভেল সেগমেন্ট বিশ্ব নেতারা যে বক্তব্য দিয়েছেন তার প্রতিফল দেখা যাচ্ছে  না মন্ত্রী পর্যায়ে চুড়ান্ত বৈঠকেও । হাই লেভেল সেগমেন্টে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সব বিশ্ব নেতাই জোড়ালো বৈশ্বিক প্রদক্ষেপ গ্রহণের প্রতি একসুরে সমর্থন দিয়েছেন। এ ব্যাপারে তাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও নিজ দেশের প্রতিশ্রুতিও পুনব্যক্ত করেছে। তারা পৃথিবী রক্ষার কার্যক্রম জোড়দার ও অর্থায়নে দিয়েছেন নতুন করে প্রতিশ্রুতি। 

সম্মেলন থেকে কার্যকরী ও ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত বের করে আনতে মন্ত্রী পর্যায়ের শেষ বৈঠকে সেই রাজনৈতিক সদিচ্ছারই প্রতিফলন চাইছে জাতিসংঘ ও আয়োজক দেশ।  এ ব্যাপারে ২৭তম জলবায়ু সম্মেলনের সভাপতি মিশরের পররাস্ট্র মন্ত্রী উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মন্ত্রীদের সঙ্গে পৃথকভাবে কথা বলছেন। আলোচনা করছেন জটিল ইস্যুগুলোতে সমঝোতায় পৌঁছানোর। কিন্তু এই আলোচনার খুব একটি ইতিবাচক প্রতিফলনও দেখা যাচ্ছে না মন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠকে।

বৈঠক সূত্র জানায়, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে আটকে রাখার জন্য কার্বন নি:সরণ কমানোর 'মিটিগেশন ওয়ার্ক প্রোগ্রাম' নিয়ে আলোচনা এখোন কাঙ্খিত মাত্রায় পৌঁছেনি। অভিযোজন ইস্যুটি এখোন প্রক্রিয়ার বেড়াজালে আটকে আছে। অর্থায়নের বিষয়েও এখন পর্যন্ত ঐক্যমতে পৌঁছানো যায়নি। লস এন্ড ডেমেজ নিয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে মন্ত্রীরা ইতস্ততবোধ করছেন।

জলবায়ু পরিবর্তনে ভয়াবহ বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহায়তার বিষয়টি এই প্রথম এবারের জলবায়ু সম্মেলনে এজেন্ডাভু্ক্ত করেছে আয়োজেক দেশ মিশর। মুলত আফ্রিকার দেশগুলোর চাপে এটি প্রথমবার এজেন্ডায় এসেছে। এখন পুরো এলডিসিভুক্ত দেশই এই ইস্যুতে সোচ্চার হচ্ছে। তাই মিশর চাইছে যে করেই হোক, লস এন্ড ডেমেজ বিষয়ে এবারের জলবায়ু চুক্তিতে একটি ঘোষনা নিয়ে আসতে। কিন্তু উন্নত দেশগুলো এর বিরোধিতা করছে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, এই ইস্যুটি নিস্পত্তির জন্য ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময় বেধে দেয়া হয়েছে। তাই তারা ২০২৪ সালে এই অর্থায়নের ঘোষনা নিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু এলডিসি দেশগুলো এই জলবায়ু  সম্মেলনেই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে অনড়। ফলে উত্তর দক্ষিনের মধ্যে একটি স্পস্ট বিরোধ ফুটে উঠেছে। এ ব্যাপারে জাতিসংঘ এবং আয়োজক দেশের পক্ষ থেকে মন্ত্রীদের বিশেষ হস্তক্ষেপ চাওয়া হচ্ছে, যাতে লস এন্ড ডেমেজের ক্ষতি পোষাতে দ্রুত ও পর্যাপ্ত তহবিল গঠন করা যায়।

এসব ইস্যুতে সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য দিনরাত ছুটাছুটি করছেন মিশরের পররাস্ট্র মন্ত্রী। শেষদিনে এসে সময়ের দিকেও তাকে নজর রাখতে হচ্ছে। যাতে নির্দিস্ট সময়ের মধ্যে জলবায়ু সম্মেলন শেষ করা যায়। 

জাতিসংঘ মহাসচিব জি-২০ বৈঠকে যোগদান শেষে শুক্রবার উড়ে এসেছেন শার্ম আল-শেখে। তবে মন্ত্রী পর্যায়ের শেষ বৈঠকে জরুরী ইস্যুগুলোতে উন্নত ও উন্নয়শীল দেশগুলোর মধ্যে বিরোধ দেখে তিনি হতাশা ব্যক্ত করেছেন। বৈঠকে দরকষাকষিতে নিয়োজিত মন্ত্রীদের বৈঠকে তিনি এই হতাশার কথা তুলে ধরেছেন। 

চুড়ান্ত দরকষাকষিতে নিয়োজিত মন্ত্রীদের উদ্দেশ্য তিনি বলেছেন, উত্তর ও দক্ষিনের মধ্যে স্পস্ট বিবেধ দেখা যাচ্ছে। এই বিভাজন আরও স্পস্ট হয়ে উঠেছে উন্নত ও দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে । কিন্তু এখন দোষারোপের সময় নয়। এই দোষারোপের খেলা পৃথিবীকে নিশ্চিত বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাবে। মানবজাতি ভয়ানক জলবায়ু চ্যালেন্জের সম্মুখীন। বিশ্বাবাসী আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের সহজ বার্তা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিপক্ষে দাঁড়াও এবং এখনি কার্যক্রম গ্রহন কর। এই গ্রহকে বাঁচাতে এবং গ্রহের মানুষকে বাঁচাতে বিশ্ববাসী আমাদের কাছে ক্লাইমেট একশন দেখতে চায়। 

তিনি আরও বলেছেন, বৈশ্বিক কার্বন নির্গমণ এখন রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং এটি ক্রমান্নয়ে বাড়ছে। জলবায়ুর বিরুপ প্রভাব অর্থনীতি, সমাজ ও উন্নয়ন কে ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমরা জানি কি করা প্রয়োজন। আমাদের কাছে সেই অস্ত্র ও সম্পদ আছে। তাই আমি সকল দেশগুলো কে জরুরি তিন বিষয়ে সক্রিয় হয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। 

জাতিসংঘ মহাসচিবের তিন বিষয়ের প্রথমটি হলো, হারানো আস্হা ফিরিয়ে আনতে লস এন্ড ডেমেজ এবং অর্থায়নে উন্নত দেশগুলোকে একটি গ্রহণযোগ্য চুক্তিতে পৌঁছানো। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, লস এন্ড ডেমেজ নিয়ে কথা বলার সময় শেষ। এখন কাজ করার সময়। আমরা বিশ্বজুড়েই লস এন্ড ডেমেজের ভয়াবহতা দেখছি। এটি অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। তাই এই বিষয়ে আজকের শেষ বৈঠকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

তিনি বলেন, যে সকল দেশ কম কার্বন নি:সরণ করছে এবং টিকে থাকার জন্য লড়াই করছে, তাদের প্রতি অবিচার চলতে পারে না। তাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শনের এখনই সময়। তাই কার্বন নি:সরণের প্রয়োজন ও বাস্তবাতার মধ্যে যে বিরাট পার্থক্য তা এখনই দূর করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

তিনি বলেন,  ১.৫ ডিগ্রি শুধু একটি লক্ষ্য নয়, এটি পৃথিবীর মানুষকে বাচানোর মুল মন্ত্র। তাই ২৭তম জলবায়ু সম্মেলনের সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রমাণ হিসেবে এ ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করতে হবে। আমরা চাই 'ক্লাইমেট সলিডারিটি এক্ট'। উন্নত দেশগুলো কার্বন নি:সরণ কমিয়ে এই চুক্তিতে নেতৃত্ব দিতে পারে। বহজাতিক অর্থায়নকারী সংস্হাগুলেকে নবায়ণযোগ্য জ্বালানিতে অর্থায়ন দ্রুততর করতে হবে। ১.৫ ডিগ্রির লক্ষ্য অর্জনের জন্য এটি খুবই জরুরি। 

জাতিসংঘ মহাসচিব তার তৃতীয় বিষয়ে বলেন, অর্থায়ন নিয়ে জটিল প্রশ্নে দেশগুলোকে আরও সক্রিয় হতে হবে। উন্নয়শীল দেশগুলোকে প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে অভিযোজন অর্থায়ন দিগুন করতে একটি গ্রহণযোগ্য রোডম্যাপ দরকার। 

সবশেষে তিনি বলেন, সমাধান আমাদের হাতেই আছে। আমদের শুধু  সবাইকে সম্মত হতে হবে লস এন্ড ডেমেজ, কার্বন নি:সরণ এবং অর্থায়ন এই তিনটি বিষয়ে। আসুন আমরা ২৭তম জলবায়ু সম্মেলন কে ব্যতিক্রমী ও স্মরনীয় করতে সবাই মিলে সক্রিয় ভুমিকা পালন করি।

এমএইচ

×