
এফডিসিতে চিত্রনায়িকা অঞ্জনাকে শেষ শ্রদ্ধা
পাঁচ দশক আগে যে আঙ্গিনায় নিজেকে মেলে ধরেছিলেন চিত্রনায়িকা হিসেবে। যেখান থেকে কিশোরী অঞ্জনা হয়ে উঠেছিলেন দর্শকপ্রিয় পরিণত এক অভিনয় শিল্পী। চিরচেনা সেই এফডিসিতে শনিবার কফিনবন্দি হয়ে শেষ শ্রদ্ধায় সিক্ত হলেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের গুণী অভিনেত্রী অঞ্জনা রহমান।
‘পরিণীতা’ সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার পাওয়া এই নায়িকা এক সময় বাংলাদেশের ঘরে ঘরে ছিলেন অতি পরিচিত মুখ। পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চ থেকে চিরবিদায় নিলেন সত্তর ও আশির দশকের ঢাকাই চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেত্রী অঞ্জনা রহমান। ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার রাতে তার মৃত্যু হয় (ইন্না লিল্লাহি .... রাজিউন)।
অঞ্জনাকে বুধবার রাত থেকে হাসপাতালে ভেন্টিলেশন সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। শুক্রবার রাত ১টা ২০ মিনিটে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন, জানিয়েছেন শিল্পী সমিতির কার্যনির্বাহী সদস্য ও অভিনেতা সনি রহমান। তার বয়স হয়েছিল ৬০ বছর।
শনিবার বেলা সোয়া ১১টায় অভিনেত্রী অঞ্জনার মরদেহবাহী গাড়িটি প্রবেশ করে চলচ্চিত্রের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন-বিএফডিসির ভেতরে। সেখানে অঞ্জনাকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন পরিচালক ছটকু আহমেদ, নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী, শিল্পী সমিতির কার্যনির্বাহী সদস্য ও অভিনেতা সনি রহমান, চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস, পলি আক্তার, রোমানা ইসলাম মুক্তি, অভিনেতা জয় চৌধুরী, শ্রাবণ শাহ, নৃত্য পরিচালক ইউসুফ খান, অভিনেতা উজ্জ্বল, ইলিয়াস কাঞ্চন, সুব্রত, আলমগীর, মিশা সওদাগর, পরিচালক ছটকু আহমেদ, মুশফিকুর রহমান গুলজার, শাহীন সুমন, প্রযোজক খোরশেদ আলম খসরুসহ চলচ্চিত্রাঙ্গনের আরও অনেকে।
সন্তানের স্নেহে অঞ্জনা সঙ্গে রেখেছিলেন নিশাত মনিকে। মনিও তাকে মায়ের মতো আগলে রেখেছিলেন। মায়ের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছেন এই তরুণ। তিনি বলেন, আম্মু সুস্থই ছিল। জ্বর আসত, আবার চলে যেত। ১৫ দিন আগে বাসায় মেহমান এসেছিল। নিজ হাতে রান্না করে আম্মু তাদের খাইয়েছে। তার পরই অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল। সাধারণ জ্বর ভেবে ওষুধ খাচ্ছিল, হাসপাতালে যেতে চাইত না।
অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই তো সেদিন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আইসক্রিম খেতে চেয়েছিল। কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন মনি। তিনি বলেন, যতদিন বাঁচব আমার আফসোস হবে, আমি কখনো বুঝতে পারিনি আম্মুর ভেতরে এমন অসুস্থতা ছিল। এমন সুস্থ একজন মানুষের ভেতরে এতটা অসুখ কীভাবে হলো।
অঞ্জনার স্মৃতিচারণ করে চিত্রনায়িকা নূতন বলেন, অঞ্জনা আমার বোনের মতো ছিল। যেখানে যেতাম আমাদের হাসি ঠাট্টা দেখে মানুষ মনে করত আমরা দুই বোন। একসঙ্গে অনেক সিনেমা করেছি। গত ৬ ডিসেম্বর তার সঙ্গে শেষ দেখা, একজন সুস্থ মানুষ ছিলেন। সেদিনই যে শেষ দেখা হবে, শেষ কথা হবে বুঝতে পারিনি।
সিনেমার নায়িকা হওয়ার আগেও অঞ্জনা যে একজন নৃত্যশিল্পী ছিলেন সে কথা স্মরণ করেছেন অভিনেতা উজ্জ্বল। তিনি বলেন, আমি দেখেছি, সে সময় বিদেশী রাষ্ট্রীয় অতিথি থেকে সরকারি বড় বড় অনুষ্ঠানে তার নাচের ডাক পড়ত। সবাই তার নাচের প্রশংসা করত। এভাবে আমরা সবাই একদিন চলে যাব, আমাদের কাজই থেকে যাবে।
অঞ্জনাকে চলচ্চিত্রের একজন বড় অভিভাবক বর্ণনা করে অপু বিশ্বাস বলেন, আমরা আরেকজন কিংবদন্তি হারালাম। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি।
নৃত্য পরিচালক ইউসুফ খান বলেন, গত মাসে বাসায় গিয়ে দেখি আপা অসুস্থ। নিজ হাতে স্যুপ বানিয়ে আপাকে খাইয়ে এসেছি। বারবার বলেছি আপা তুমি ডাক্তার দেখাও। আপা কথা শোনেনি। গত পরশু হাসপাতালে তাকে দেখে খুব খারাপ লাগছিল। এই অঞ্জনা আপাকে আমি দেখতে চাইনি। আমার মা তাকে বলে গিয়েছিলেন, ইউসুফকে দেখে রেখো। ছোট ভাইয়ের মতো আমাকে আদর করতেন তিনি।
চলচ্চিত্র নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী বলেন, অঞ্জনা আপার অসুস্থতার খবর আরও একটু আগে জানতে পারলে আমরা হয়তো তাকে আর একটু বেশি সময় দিতে পারতাম। তার মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। তার মিষ্টি হাসি আর কাজ অঞ্জনা আপাকে সবার মাঝে বাঁচিয়ে রাখবে।
বিএফডিসি প্রাঙ্গণে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বেলা ১টা ৫০ মিনিটে অঞ্জনার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এর পর তার মরদেহ নেওয়া হয় তেজগাঁও চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে। ছেলেবেলার বান্ধবী ও অভিনেত্রীকে বিদায় জানাতে চ্যালেন এসেছিলেন সংগীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন। উপস্থিত ছিলেন চলচ্চিত্র গবেষক ও পরিচালক মতিন রহমানও। সেখানে দ্বিতীয় জানাজার পর তাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। শনিবার বিকেল সোয়া ৩টায় অভিনেত্রীর দাফন সম্পন্ন হয়েছে বলে শিল্পী সমিতির কার্যনির্বাহী সদস্য ও অভিনেতা সনি রহমান জানিয়েছেন।
ঢাকায় এক সংস্কৃতিমনা সনাতন পরিবারে অঞ্জনার জন্ম। তার মা কমলা সাহা, বাবা প্রফুল্ল চন্দ্র সাহা। বিয়ের পর মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন অঞ্জনা, তখন থেকে তার নাম হয় অঞ্জনা রহমান। ছোটবেলা থেকে নাচের প্রতি তার আগ্রহের কারণে বাবা-মা তাকে নাচ শিখতে ভারতে পাঠান। সেখানে তিনি ওস্তাদ বাবুরাজ হীরালালের কাছে নাচের তালিম নেন, শেখেন কত্থক। সিনেমায় আসার আগেই অঞ্জনা পরিচিতি পান নৃত্যশিল্পী হিসেবে।
১৯৭৬ সালে বাবুল চৌধুরী পরিচালিত ‘সেতু’ চলচ্চিত্র দিয়ে তিনি ঢাকাই সিনেমায় কাজ শুরু করলেও তার মুক্তি পাওয়া প্রথম চলচ্চিত্র ছিল শামসুদ্দিন টগর পরিচালিত ‘দস্যু বনহুর’। নায়ক সোহেল রানার বিপরীতে ওই সিনেমার পর আর পেছনে তাকাতে হয়নি অঞ্জনাকে। নিজের সেরা সময়ে ঢাকাই সিনেমার প্রথম সারির প্রায় সব নায়কের বিপরীতেই অভিনয় করেছেন তিনি।
নায়করাজ রাজ্জাকের সঙ্গে তাকে দেখা গেছে ৩০টি সিনেমায়, যার মধ্যে রয়েছে ‘অশিক্ষিত’, ‘রজনীগন্ধা’, ‘আশার আলো’, ‘জিঞ্জির’, ‘আনারকলি’, ‘বিধাতা’, ‘বৌরানী’, ‘সোনার হরিণ’, ‘মানা’, ‘রামরহিম জন’, ‘সানাই’, ‘সোহাগ’, ‘মাটির পুতুল’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ও ‘অভিযান’ এর মতো দর্শকনন্দিত চলচ্চিত্র। এ ছাড়া ভারতের সুপারস্টার মিঠুন চক্রবর্তী, পাকিস্তানের অভিনেতা ফয়সাল, নাদীম, জাভেদ শেখ, ইসমাইল শাহ, নেপালের শীবশ্রেষ্ঠ ও ভুবন কেসির সঙ্গেও অভিনয় করেছেন এই নায়িকা।
চার দশকের ক্যারিয়ারে শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করেছেন অঞ্জনা। ‘পরিণীতা’ সিনেমার জন্য ১৯৮৬ সালে পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। পাশাপাশি বাচসাস পুরস্কার এবং নৃত্যে জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। ১৯৯২ সালের পর থেকে সিনেমায় অনিয়মিত হয়ে যান অঞ্জনা। ২০০৮ সালে মুক্তি পায় তার সর্বশেষ সিনেমা ‘ভুল’। অভিনয়ে অনিয়মিত হয়ে গেলেও তার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান অঞ্জনা ফিল্মস থেকে ‘প্রাণ সজনি’, ‘বন্ধু যখন শত্রু’, ‘চালু সরদার’সহ অনেকগুলো সিনেমা মুক্তি পায়। পর্দায় সক্রিয় না হলেও চলচ্চিত্র অঙ্গনে নিয়মিতই যাতায়াত ছিল তার। সর্বশেষ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনে সদস্য পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।