ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২০ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

সরকারি-বেসরকারি নানা আয়োজন

মানবতার মর্মবাণীতে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্্যাপিত

সংস্কৃতি প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০০:১৩, ৯ মে ২০২৪

মানবতার মর্মবাণীতে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্্যাপিত

ধানমণ্ডির ছায়ানট সংস্কৃতি ভবন মিলনায়তনে রবীন্দ্র উৎসবে নৃত্য পরিবেশনা

আকাশভরা সূর্যতারা কিংবা  বিশ্বভরা প্রাণের মতোই আপন সৃষ্টির আলোয় উজ্জ্বল সেই  বিশ্বকবি। গানের সুরে, কবিতার পঙক্তিমালায়, মানবিক ভাবনায় অথবা স্বদেশ চেতনায় তিনি বাঙালির নিত্যসহচর।  সেই সুবাদে মানবিক দর্শনের আলোকরেখায় ঠাঁই করে নিয়েছেন বাঙালির মননে। সংকটে-সংগ্রামে, আনন্দ-ভালোবাসায় হয়েছেন অনুপ্রেরণার সঙ্গী। সেই কৃতজ্ঞতার বন্ধনে  বুধবার পঁচিশে বৈশাখ উদ্্যাপিত হলো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী।

সংঘাত, ধর্মান্ধতা ও উগ্রপন্থার আস্ফালনে মানবতার সংকটে সারাবিশ্ব যখন প্রকম্পিত সেই দুঃসময়ে জন্মদিনে আরও বেশি প্রাসঙ্গিকতায় সামনে এলেন রবীন্দ্রনাথ। ভালোবাসার বন্ধনে সহজাতভাবেই রবীন্দ্র অনুরাগীদের মনে গুঞ্জরিত হয়েছে- আজি এ প্রভাতে রবির কর/কেমনে পশিল প্রাণের পর/কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাতপাখির গান ...। সেই প্রেরণায় অমানবিকতার বিরুদ্ধে উচ্চারিত হয়েছে তাঁরই বাণীÑ অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে...। মানবতা ও সম্প্রীতির মর্মবাণীকে ধারণ করে উদ্্যাপিত হলো রবীন্দ্রজয়ন্তী।  যুদ্ধের দামামায় অস্থির বিশ্বে শান্তির প্রত্যাশায় উদ্্যাপিত হলো কবিগুরুর জরন্মদিন। 
নানা আয়োজনে সরকারি ও  বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যাপিত হলো বিশ্বকবির জন্মদিন। সেসব আয়োজনে ক্রান্তিকালে কবির সৃষ্টির মাঝে খোঁজা হয়েছে অভয় বাণী। তার গান বা কবিতা থেকে  সন্ধান করা হয়েছে সংকট উত্তরণের পথরেখা। এভাবেই সংকটকালে হৃদয়ের গহিন থেকে উৎসারিত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করা হয়েছে কবিগুরুকে। বাঙালির চিন্তা-মননের সঙ্গী এবং শিল্প-সংস্কৃতির অগ্রদূত কবিকে জানানো হয়েছে বন্দনা।

জন্মদিনে কবি বন্দনার পাশাপাশি ছিল তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করে হিংসা-বিদ্বেষ দূরে ঠেলে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের পথে চলার প্রত্যয় গ্রহণ।  এ ছাড়া কবির রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে দৈনিক পত্রিকাগুলো প্রকাশ করেছে বিশেষ প্রবন্ধ, নিবন্ধ কিংবা জন্মদিনের শুভাশিষ জানানো প্রতিবেদন। সরকারি-বেসরকারি চ্যানেলগুলো দিনভর প্রচার করেছে রবীন্দ্র সৃষ্টিস্নাত নানা অনুষ্ঠানমালা। রবীন্দ্রজয়ন্তীর উদ্যাপনে বর্ণিল রূপ ধারণ করে রাজধানী সংস্কৃতি ভুবন।

সেসব আয়োজনে গানে সুরে, কবিতার শিল্পিত উচ্চারণে কিংবা নাচের নান্দনিকতায় প্রকাশিত হয়েছে কবিগুরুর প্রতি অনুরাগ।  সোনার বাংলা স্বপ্ন    ও বাস্তবতা : বঙ্গবন্ধু থেকে রবীন্দ্রনাথ প্রতিপাদ্যে  জাতীয় পর্যায়ের ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় উদ্যাপিত হয়েছে কবিগুরুর জন্মদিন।  সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এদিন শিল্পকলা একাডেমি জাতীয় নাট্যশালা তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের সূচনা হয়।

বাংলা একাডেমির আয়োজনে  আলোচনাসভা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনার আয়োজনে  রবীন্দ্র পুরস্কার প্রদান  করা হয়।  সন্ধ্যায় নাচ-গান ও কবিতায় সজ্জিত রবীন্দ্র উৎসবের আয়োজন করে ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট। এর বাইরে জাতীয়ভাবে বিশ্বকবির স্মৃতিবিজড়িত কুষ্টিয়ার রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, নওগাঁর পতিসর এবং খুলনার দক্ষিণডিহি ও পিঠাভোগে রবীন্দ্রমেলা, রবীন্দ্রবিষয়ক আলোচনা, সাংস্কৃতিক পরিবেশনাসহ বহুমাত্রিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।

কবিগুরুর স্মৃতি বিজড়িত শাহজাদপুরে এদিন থেকে শুরু হয় তিন দিনব্যাপী উৎসব। সকালে রবীন্দ্র কাচারিবাড়ি মিলনায়তনে উৎসবের উদ্বোধন হয় । তিন দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানমালার মধ্যে রয়েছে রবীন্দ্র স্মারক প্রবন্ধ পাঠ, সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা।         
শিল্পকলায় তিন দিনের অনুষ্ঠান শুরু ॥   জাতীয় পর্যায়ের রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্যাপনের অংশ হিসেবে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে তিন দিনব্যাপী বর্ণিল অনুষ্ঠানমালার সূচনা বুধবার সকালে। একাডেমির। একাডেমির নাট্যশালা মিলনায়তনে  প্রধান অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। স্মাারক বক্তৃতা করেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার।

বিশেষ অতিথি ছিলেন রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. শাহ্্ আজম ও সংস্কৃতি সচিব খলিল আহমদ। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার খানের সভাপতিত্বে আয়োজনে অনুষ্ঠানে স্বাগত  বক্তব্য দেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। প্রদীপ প্রজ্বালন ও জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে শুরু হয় প্রথম দিনের আয়োজন। এর পর যন্ত্রসংগীতের করুণ স্মরণ করা হয় প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত  শিল্পী সাদি মহম্মদকে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিরীন শারমিন চৌধুরী এমপি বলেন,  নতুনকে আলিঙ্গন করে নবজাগরণের ডাকে ফিরে আসে পঁচিশে  বৈশাখ। বাংলার মানুষের জীবনসংগ্রাম, দুঃখ দুর্দশা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে  সোচ্চার ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।  সেই বাস্তবতায় বাঙালির আত্মপরিচয় ও আত্মবোধের বিকাশের মূলে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধুর নিবিড় সম্পর্ক।

তাই রবীন্দ্রনাথ এবং বঙ্গবন্ধুর দর্শন একসঙ্গে  দেখলে তার  কেন্দ্রে বাঙালি  জাতিসত্তার আত্মপরিচয় ও আত্মমর্যাদার বিষয়টি উঠে আসে।  কারণ, বাঙালির আত্মপরিচয় ও আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠাই ছিল  রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যেকার নিবিড়  যোগসূত্র। সাহিত্যের  আশ্রয়ে রবীন্দ্রনাথ বাঙালিকে নিয়ে গেছেন বিশ্বসভায়। অন্যদিকে ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুও জাতিসংঘের সভায় প্রথম বাংলায় ভাষণ দিয়েছেলেন।

পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশে বঙ্গবন্ধু ও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একই পথের যাত্রী। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, কবিগুরু ছিলেন প্রেম, প্রকৃতি, পূজা, স্রষ্টার বন্দনা ও মানবতার অফুরন্ত সংমিশ্রণ। প্রতিবাদ ও সহমর্মিতার মিশ্রণ একইসঙ্গে হয়েছে তার লেখনীতে। নিপীড়ন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার থেকে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট সাহিত্য । পাশাপাশি নারী অধিকার ও নারী জীবনের বাস্তবতাকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধ, গল্প ও কবিতায় বিশেষভাবে স্থান দিয়েছেন।

যুদ্ধের দামামায় অশান্ত বিশ্বের বুকে শান্তির বাণী ছড়িয়েছেন। আঁধার  কেটে আলোর পথে সত্য ও সুন্দরের নিরন্তর সাধনায় রবীন্দ্রনাথ নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। 
আলোচনা শেষে ছিল সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।  এ পর্বে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সম্মেলক কণ্ঠে গেয়ে শোনা  ‘হে নতুন  দেখা দিক আরবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ  ও ‘ও মহামানব আসে’ শীর্ষক সংগীত।

মাধুর্যময় কণ্ঠের আশ্রয়ে শ্রোতার হৃদয় রাঙান স্বাধীনতা পুরস্কার ও ভারতের পদ্মশ্রী পুরস্কারজয়ী রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। তিনি পরিবেশন করেন ‘তোমায় গান শোনাব’ এবং ‘ভালো বেসে, সখী, নিভৃতে যতনে/আমার নামটি লিখো/তোমার মনের মন্দিরে’। প্রখ্যাত বাচিকশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বাঁশি’ শিরোনামের কবিতা আবৃত্তি করেন । সমবেত সংগীত ‘ও আমার  দেশের মাটি’ পরিবেশন করে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়।

‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে’ গানের সুরে নাচ করে শিশু একাডেমির শিশু শিল্পীরা।   গান ও কবিতা পরিবেশন করেন সামিউল ইসলাম পুলক এবং মাহনাজ করিম  হোসেন। ‘রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক নৃত্যালেখ্য পরিবেশন করে শিল্পকলা একাডেমির নৃত্যদল । 
বাংলা একাডেমির আয়োজন ॥ রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্যাপনে বক্তৃতা, রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ প্রদান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলা একাডেমি। একাডেমির সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ দেন একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। একক বক্তৃতা করেন মঞ্চ নির্দেশক ও রবীন্দ্র-গবেষক মঞ্চসারথি আতাউর রহমান। সভাপতিত্ব করেন একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।
অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র সাহিত্যের গবেষণা বা সমালোচনা বা অনুবাদে প্রকাশিত গ্রন্থের মান বিবেচনায় অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরীকে এবং রবীন্দ্রসংগীত চর্চায় অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসাকে বাংলা একাডেমি প্রবর্তিত রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ প্রদান করা হয়। পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকের হাতে পুষ্পস্তবক,  সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী রূপা চক্রবর্তী এবং শিমুল মুস্তাফা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী লিলি ইসলাম এবং চঞ্চল খান।

×