
বাংলাদেশে ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান
তারুণ্যের চিন্তাভাবনাই তৈরি করতে পারে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপরেখা। সুশাসন, মানসম্মত শিক্ষা, ন্যায়বিচার, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন এবং বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করার প্রত্যাশা আছে তাদের মাঝে। তরুণরা এমন বাংলাদেশ চায়, যেখানে সকল নাগরিক সমঅধিকারের পাশাপাশি পাবে একটি উন্নত জীবনযাত্রা। নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশকে কেমন দেখতে চায়, তা তুলে ধরেছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালযের শিক্ষার্থী সুদীপ চাকমা ও নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অনিরুদ্ধ সাজ্জাদ
স্বপ্নের পথে নতুন যাত্রা
বাংলাদেশে ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে যে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের মানুষ আশাবাদী। এটাকে অনেকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা হিসেবে আখ্যা দিতে চাইলেও আমি এটার সাথে দ্বিমত পোষণ করি কারণ বাংলাদেশ একবারই স্বাধীন হয়েছে ১৯৭১ সালে। আর ২০২৪ সালে এটিকে আমরা গণবিপ্লব বলতে পারি। এই গণবিপ্লব আনন্দের, একই সাথে বেদনারওÑ যখন দেখি, একটি মহল গত ৫ আগস্ট থেকে আজ পর্যন্ত অনেক সংখ্যালঘুদের বাড়িতে হামলা করছে।
পূর্বের মতোই এক পক্ষ আরেক পক্ষের উপরে দোষ চাপিয়ে দিচ্ছেন, কিন্তু আমরা ভুক্তভোগীরা কখনোই সুবিচার পাই না। একই সাথে আমরা দেখেছি সমাজের প্রত্যেক স্তরের মানুষ যে যার অবস্থান থেকে এগিয়ে এসেছে এবং রাত জেগে আমাদের সংখ্যালঘু পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। এটি খুবই আশাব্যঞ্জক। এমন সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশই আমরা কামনা করি।
পিযুষ কান্তি সরকার
এগ্রোটেকনলোজি ডিসিপ্লিন
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ হোক
একজন শিক্ষার্থী হিসেবে সবার আগে স্বপ্ন দেখি- আমার বাংলাদেশ শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ স্থানে উপনীত হবে। যেখানে সকল বয়সের মানুষ তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণের জন্য সুযোগ পাবে। এছাড়া আমার প্রত্যাশা, আগামীতে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ হবে। তাহলেই শিক্ষার্থীরা পাবে মানসম্পন্ন শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করার মাধ্যমে জাতীয় সমস্যা নিরসনে দেশের শিক্ষার্থীদের অবদান রাখার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ, চিকিৎসাক্ষেত্র, মেডিসিন, শিল্প-প্রযুক্তি ও শিক্ষাখাতসহ সকল ক্ষেত্রে অন্য দেশের সহায়তা ব্যতিত সমস্যা সমাধানে অবদান রাখার মতো সুযোগ থাকবে। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। এভাবে দেশের শিল্প-উৎপাদনের সব খাতই একসঙ্গে এগিয়ে যাবে, আর এগিয়ে যাবে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ।
তাসমিয়া তানহা
প্রতœতত্ত্ব বিভাগ
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
সমান অধিকার নিশ্চিত হোক
আমাদের নতুন বাংলাদেশে সকলের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে যা আমাদের সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ২৯ নং অনুচ্ছেদে উল্লিখিত আছে। মানুষ হিসেবে প্রত্যেকের সমান সুযোগ-সুবিধা লাভের নিশ্চয়তা প্রদান করলে আমি আশা করিÑ জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে সবাইকে সম-অধিকার দেওয়া হবে। এছাড়া আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গেঁথে বসা অনিয়ম ও দুর্নীতি সমূলে উৎপাটন করে দিতে হবে।
একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি প্রত্যাশা রাখবো যাতে আমাদের দেশের প্রথাগতভাবে চলে আসা শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে। বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে শিক্ষার্থীরা কোন প্রায়োগিক দক্ষতা ও শিক্ষা অর্জন করতে পারে নাÑ যেটি হয়তো তাদের চাকরি ক্ষেত্রে, এমনকি তাদের পরবর্তী জীবনের জন্য খুব প্রয়োজনীয় হতে পারতো। যেমনটা আমরা উন্নত দেশগুলোতে দেখি যে, তারা জীবন ও জীবিকার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষা গ্রহণ করে। কিন্তু আমাদের দেশে সেটি খুব একটা পরীলক্ষিত হয় না।
আব্দুর রহমান সৈকত
লোকপ্রশাসন বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মৌলিক সুবিধা নিশ্চিত হোক পাহাড়েও
পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের পাশাপাশি চাকমা, মারমা ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। কিন্তু দেখা যায় যে, সদর এলাকায় নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থাকলেও পাহাড়ের প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসকারী পরিবারগুলো সুবিধাবঞ্চিত। তাই আমার স্বপ্ন সমতলের মতো পাহাড়েও পৌঁছাবে উন্নতির ছোঁয়া। পাহাড়ের মাটি, বায়ু, আবহাওয়া খুবই উর্বর হওয়ায় এখানে বিভিন্ন সবজির ফলন খুব ভালো হয়। কিন্তু বিগত দিনগুলোতে বিভিন্ন সিন্ডিকেট মহলের তৎপরতায় প্রান্তিক কৃষকরা তাদের নায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বর্তমানে পাহাড়ে অন্যতম বড় সমস্যা অনুন্নত শিক্ষাব্যবস্থা।
এখানে নেই কোনো ভালো স্কুল,কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়। স্বল্প বেতনের কারণে পাহাড়ে দিন দিন কমে যাচ্ছে পাড়াকেন্দ্রের সংখ্যাও। মূলত নীতিনির্ধারকদের সুদৃষ্টির অভাবে আমার পাহাড়ের শিক্ষাব্যবস্থা এখনও পিছিয়ে। তার উপর বিগত দিনগুলোর শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিত দুর্নীতি পাহাড়ের শিক্ষার পরিবেশকে আরও নষ্ট করেছে। আমি আশা করি, ভবিষ্যতে চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতিসহ গ্রামে-গঞ্জে নলকূপ স্থাপন, মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, নারীদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণ, মোবাইল ক্লিনিকের দ্বারা স্বাস্থ্যসেবাসহ মৌলিক সকল সুবিধা আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও নিশ্চিত হবে।
রিয়া চাকমা
অর্থনীতি বিভাগ
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
দেশে সুশিক্ষা, সুশাসন ও স্বচ্ছতা চাই
যদি বলি কেমন বাংলাদেশ চাই, তবে প্রথমেই শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে দেশসেরা মেধাবীদের অবদান রাখার সুযোগ করে দেয়া হোক। শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষার পরিবর্তন আনা জরুরী। গাছের শিকড় যদি মজবুত না হয়, সে গাছ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। সবচেয়ে দক্ষ শিক্ষকদের নিয়ে আসতে হবে প্রাথমিক পর্যায়ে। দেশের বাইরে থেকে যেসব মেধাবীরা রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ফিরে আসতে চান তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা হোক। সুশাসন, সুবিচার, বাকস্বাধীনতার পাশাপাশি তৈরি হোক যৌক্তিক সমালোচনার পরিবেশ। বিচার বিভাগ ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে হতে হবে সরকারি প্রভাব মুক্ত। ঢাকার বিকেন্দ্রিকরণ, সচিবালয়গুলোর স্বচ্ছ কার্যপদ্ধতি ও জবাবদিহিতা হবে সুনিশ্চিত।
ছোট যানবাহনগুলো যানজটপূর্ণ এলাকায় নিষিদ্ধ করা এবং বিশ্বমানের পাবলিক বাস দিয়ে সবার যাতায়াত এর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা নির্মাণ এখন সময়ের দাবি। বিসিএস পরিক্ষা বাতিল করে পদকেন্দ্রীক নিয়োগ করতে হবে। ডিগ্রি নির্ভরতা কমানোর জন্য সারাদেশে নতুন ট্রেনিং স্কুল চালু করতে হবে, যাতে কম খরচে মানুষ ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। যেমন, ড্রাইভিং, কুকিং, মেকানিক, প্লাম্বার ইত্যাদি।
তরুণদের ডিজিটাল স্কিল শিখে ফ্রীলান্সিং করার ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা সহজ করতে হবে। প্রয়োজনে বিশ্বের সেরা কোর্সগুলো সরকারি অর্থায়নে তরুণদের জন্য সহজলভ্য করতে হবে। পেপাল এর মতো প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দিতে হবে দেশে। তবেই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে আজকের তারুণ্য।
আব্দুল্লাহ আল ওয়াসিম
শিক্ষার্থী, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল
ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
বিশ্বের বুকে মাথা উচুঁ করবে বাংলাদেশ
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ, বর্তমানে বৈষম্যের বিরুদ্ধে ন্যায়যুদ্ধ প্রতিটি আন্দোলন - সংগ্রামে তারুণ্যের শৌর্যদীপ্তের ভূমিকা তুলনাহীন। তাই কল্যাণময় রাষ্ট্রগঠনে আমরা তরুণসমাজই সবকিছুর উর্ধ্বে। এবার বলবো তারুণ্যই শক্তি কথাটি তখনই পূর্ণতা পাবে যখন কোনো সমাজ ও দেশের তরুণরা সৎ সাহসের পরিচয় দেবে, ভুলগুলোকে সংস্করণ করবে।
আমি একজন তরুণ হিসেবে এমন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছিÑ যেখানে আমার দেশের দরিদ্র মানুষেরা তাদের ন্যায্যমূল্য পাবে। যেখানে কোনোভাবেই কারো বাকস্বাধীনতাকে হরণ করা হবে না, যেখানে প্রত্যেক নাগরিক তার ভোটের অধিকার সুষ্ঠুভাবে চর্চা করতে পারবে, যেখানে রাজনীতি থাকবে কিন্তু এর অপব্যবহার থাকবে না। আমি এমন এক বাংলাদেশ দেখতে চাইÑ যে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উচু করে নিজের অস্তিত্বের পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করবে না।
ফারহানা আক্তার ইশা
শিক্ষার্থী,মার্কেটিং বিভাগ,
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বিজয় যেন বৃথা না যায়
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর ২০২৪ সালে ছাত্রজনতা আবার এক হয়ে হাজারো শহীদের রক্ত ঝরানোর মাধ্যমে স্বৈরাচার মুক্ত হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। আমরা বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম এমন এক বাংলাদেশ চাই যেখানে বাক স্বাধীনতা থাকবে যেখানে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক কর্মী, গণমাধ্যম কর্মী সবার নিজ মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে।
নতুন বাংলাদেশে আমরা মানসম্মত ও সহজলভ্য শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি কারিগরি দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ চাই। বাংলাদেশ থেকে অর্জিত শিক্ষা যেন বর্হিবিশ্বের যেকোনো দেশের সাথে চ্যালেঞ্জ দেওয়ার মতো হয় সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। বর্তমান বাংলাদেশে আমরা দ্রব্যমুল্যের ঊর্ধ্বগতি থেকে রেহাই পেতে চাই। আমরা তরুণ প্রজন্ম দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ চাই, যেখানে সবাই স্বপ্ন পূরণের জন্য সুষ্ঠু ও সমৃদ্ধি পাবে।
রাইসা ইসলাম জীম
শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ,
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
দেশপ্রেম ও একতা হোক মানুষের শক্তি
দেশের প্রতিটি সেক্টর দুর্নীতির করাল গ্রাসে বিপর্যস্ত। কেবল দুর্নীতিমুক্ত একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা এই দেশকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দিবে। আমি এমন একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি যেখানে আইনের শাসন নিশ্চিত হবে, জনগন পাবে তার ন্যায় অধিকার, পাবে কথা বলার স্বাধীনতা, নিয়োগ প্রক্রিয়া হবে স্বচ্ছ, সরকারের থাকবে জবাবদিহিতা, থাকবে অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরশীলতা, লাল ফিতার দৌরাত্ম হ্রাসের পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসন হবে রাজনীতিমুক্ত, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থে থাকবে তরুণদের মতামতের মূল্যায়ন।
থাকবে না কোনো গুম, মিথ্যা হয়রানিমূলক মামলা, প্রতিহিংসার রাজনীতি, বিদেশী অপশক্তির প্রভাব, নিরাপত্তার শঙ্কা, ধর্ষণ, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, ঘুষ, অর্থপাচার, ধর্মীয় অবমাননা এবং সকল অন্যায়-অবিচার। এছাড়াও শিক্ষা ও গবেষণা হবে উন্নতমানের যা সময়োপযোগী, কর্মমুখী ও দক্ষতানির্ভর। দেশপ্রেমের অঙ্গীকার ও একতা হবে এদেশের মানুষের প্রধান শক্তি। এই প্রত্যাশাই থাকবে আগামীর স্বপ্নের বাংলাদেশের জন্য।
আরিফুল ইসলাম রাফি
শিক্ষার্থী, ব্যবস্থাপনা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়