
ছবি: জনকণ্ঠ
দক্ষিণাঞ্চলের শিক্ষার বাতিঘর, ঐতিহ্য ও গৌরবের প্রতীক সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ ১৩৬ বছরে পদার্পণ করেছে। ইতিহাস, ঐতিহ্য, আন্দোলন ও সংগ্রামে গাঁথা এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি শুধু বরিশালের নয়, পুরো বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার এক অনন্য স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ১৮৮৯ সালের ১৪ জুন, তৎকালীন বরিশালের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বাবু রমেশচন্দ্র দত্তের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সমাজসেবক, শিক্ষানুরাগী অশ্বিনী কুমার দত্ত তাঁর পিতার নামে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন।
এর আগে, ১৮৮৪ সালে তিনি ব্রজমোহন (বিএম) স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সেই স্কুল ক্যাম্পাসেই সত্য, প্রেম, পবিত্রতার আদর্শে ব্রজমোহন কলেজের যাত্রা শুরু হয়। শুরুতে কলেজের কার্যক্রম পরিচালিত হতো অশ্বিনী ভবনে। পরে ১৮৯৮ সালে কলেজটি স্থানান্তরিত হয় বর্তমান স্থানে, যা আজও শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে। শিক্ষার পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক জাগরণের কেন্দ্র হিসেবে বিএম কলেজের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, এবং সর্বশেষ ২৪ এর জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান, সবকিছুতেই এই কলেজের শিক্ষার্থীদের সাহসী অংশগ্রহণ ইতিহাসে উজ্জ্বলভাবে স্মরণীয়। বিএম কলেজ তার দীর্ঘ পথচলায় অসংখ্য গুণীজনের জন্ম দিয়েছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন—ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা নলিনী দাস, বাংলা সাহিত্যের প্রতীকী কবি জীবনানন্দ দাস, মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, সুরকার আলতাফ মাহমুদ, খ্যাতিমান সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াসহ আরও অনেকে।
বর্তমানে কলেজটি ৬০ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। এখানে স্নাতক পর্যায়ে ২২টি, স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ২১টি এবং ডিগ্রি (পাস) কোর্সে ২০টি বিভাগ চালু রয়েছে। কলেজটিতে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ হাজারেরও বেশি। ছাত্রদের জন্য রয়েছে তিনটি আবাসিক হল—ফ্লাইট সার্জেন্ট জহুরুল হক (মুসলিম) হল, অশ্বিনী কুমার দত্ত (ডিগ্রি) হল এবং কবি জীবনানন্দ দাস হল। ছাত্রীদের জন্য রয়েছে বনমালী গাঙ্গুলি ছাত্রীনিবাস নামের একটি হল। শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য আছে মাত্র তিনটি বাস, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল।
এতসব গৌরব ও ঐতিহ্যের মধ্যেও আজ বিএম কলেজ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক ও কর্মচারীর সংকট বিদ্যমান। ৩০ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নেই, ফলে পাঠদান কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। একইসঙ্গে নেই পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, রিডিং রুমে নেই প্রয়োজনীয় বই। আবাসিক হলগুলোর অবস্থাও অত্যন্ত করুণ। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, আবাসন সংকট ও পুরোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে ছাত্রছাত্রীরা মানবেতর পরিবেশে দিন কাটায়। বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা চরমে ওঠে, হালকা বৃষ্টি হলেই ক্যাম্পাস তলিয়ে যায় পানিতে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো ক্যাম্পাসে মাদকের বিস্তার। দিনের আলোতেই চলে মাদক সেবন, যা শিক্ষার পরিবেশকে বিপন্ন করে তুলছে। বহিরাগতদের অবাধ বিচরণও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। শিক্ষাঙ্গন এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় উপনীত।
তবে এই সংকটের মাঝেও সম্ভাবনার আলো আছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট সকলের সম্মিলিত উদ্যোগ, সচেতনতা এবং আন্তরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে বিএম কলেজকে আবারও একটি আধুনিক, নিরাপদ, এবং গুণগত শিক্ষার প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। প্রশাসনের যথাযথ নজরদারি, শিক্ষক নিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন ও ক্যাম্পাস নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।
ঐতিহ্যবাহী বিএম কলেজের ১৩৬ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে একটাই প্রত্যাশা—সকল সংকট কাটিয়ে এই প্রাচীন শিক্ষালয়টি আবারও তার নিজ গৌরবে, শিক্ষার দীপ্তিতে ও মানবিক মূল্যবোধে উজ্জ্বল হয়ে উঠুক। দক্ষিণাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের স্বপ্নপূরণের প্লাটফর্ম হয়ে উঠুক বিএম কলেজ।
আবির