ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাহাঙ্গীরনগরে ইফতার সম্প্রীতি-ঐক্য-ভ্রাতৃত্ব

ইমন মাহমুদ

প্রকাশিত: ২২:৪৭, ১ এপ্রিল ২০২৩

জাহাঙ্গীরনগরে ইফতার সম্প্রীতি-ঐক্য-ভ্রাতৃত্ব

সারাদিন রোজা রেখে ক্লান্ত ক্লান্ত চোখে ঘড়ির কাঁটার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে টিউশন শেষে ফিরে আসা শিক্ষার্থী

সারাদিন রোজা রেখে ক্লান্ত ক্লান্ত চোখে ঘড়ির কাঁটার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে টিউশন শেষে ফিরে আসা শিক্ষার্থী। কেউ বা কান খাড়া করে অপেক্ষায় আছে কখন বাতাসে ভেসে আসবে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠস্বর। একদল ব্যস্ত মোনাজাতে; কথিত আছে ইফতারের আগে কিছু চাইলে তা পূরণ হয়। গোল হয়ে শিক্ষার্থীরা বসে আছেন। পত্রিকার পাতা বিছিয়ে মাখানো হচ্ছে মুড়ি। কিংবা প্লাস্টিকের পাতিলের ব্যবস্থাও করেছেন অনেকে

ঘনিয়ে আসছে ইফতারের সময়। পশ্চিম আকাশে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে লাল আভা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে চলছে ইফতারের প্রস্তুতি। পারিবারিক আবহে কাজ ভাগাভাগি করে সবাই ব্যস্ত ইফতার তৈরিতে। কেউ জিলাপি ভাঙছে, কেউবা মনযোগী শরবত তৈরিতে। সারাদিন রোজা রেখে ক্লান্ত ক্লান্ত চোখে ঘড়ির কাঁটার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে টিউশন শেষে ফিরে আসা শিক্ষার্থী। কেউ বা কান খাড়া করে অপেক্ষায় আছে কখন বাতাসে ভেসে আসবে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠস্বর।

একদল ব্যস্ত মোনাজাতে; কথিত আছে ইফতারের আগে কিছু চাইলে তা পূরণ হয়। গোল হয়ে শিক্ষার্থীরা বসে আছেন। পত্রিকার পাতা বিছিয়ে মাখানো হচ্ছে মুড়ি। কিংবা প্লাস্টিকের পাতিলের ব্যবস্থাও করেছেন অনেকে। বাতাসে মাগরিবের আজানের ধ্বনি ‘আল্লাহু আকবার...’ ভেসে আসার সাথেই সাথেই খেজুর কিংবা এক চুমুক পানি দিয়ে ইফতার শুরু করে গোল হয়ে বসে থাকা শিক্ষার্থীরা। হাতে হাতে একজন অন্যজনের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে শরবতের রঙিন গ্লাস। মুহূর্তেই খুনসুটি আর হাসির শব্দে সরগরম হয়ে ওঠে কেন্দ্রীয় মাঠের প্রাঙ্গণ।

ইফতারের সময় খাবার ভাগ করে নেওয়ার এই কর্মযজ্ঞ শুধু ইফতার বা খাবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি আসলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার প্রত্যয়, অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা ও দৃঢ় বন্ধনেরও প্রতীক। পারিবারিক পটভূমি, ধর্ম, বর্ণ বা বিশ্বাস নির্বিশেষে সবাই একে অপরের সমর্থনে একটি পরিবার হিসেবে একত্রিত হয়। রমজান মাসে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা রোজা রাখার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক ভক্তির একটি সময়কাল পার করে। আত্মনিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা এবং সংযমের এই সময়ে সহানুভূতি, সম্প্রীতি, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের উপস্থিতি চোখে পড়ে সর্বত্র।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ও এর ব্যতিক্রম নয়। সারাবছর বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় উৎসবমুখর ও ব্যস্ততায় ঘিরে থাকা কেন্দ্রীয় মাঠে রমজানের এই ছুটিতে একটুও ভাটা পড়েনি উৎসবের। বিকেল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একটি নির্মল পরিবেশে রূপান্তরিত হয় খেলার মাঠ। বিভিন্ন বিভাগ এবং হলের শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে তাদের সারাদিনের রোজা ভাঙতে জড়ো হয়। ছোলা-বুট, ভাজাপোড়া ও বিভিন্ন ফলের সুগন্ধে ভরে ওঠে মাঠের প্রাঙ্গণ। গত ২৭ মার্চ থেকে ৩৯ দিনের ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ে।

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য ছুটে আসা শিক্ষার্থীদের অনেকেই ক্লাস-পরীক্ষা থেকে মুক্তি পেয়ে দীর্ঘকালীন এই ছুটিতে নাড়ির টানে ফিরেছেন বাড়ির পথে; বেশ বড় সংখ্যক শিক্ষার্থী আটকে গেছেন ল্যাব, পরীক্ষা, টিউশন কিংবা ব্যক্তিগত কাজে। ক্যাম্পাসে থাকা শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে সম্প্রীতি, ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা প্রদর্শনের মাধ্যমে কিছুটা হলেও পরিবারের অভাব ঘুচানোর চেষ্টা করছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ে ইফতার নিয়ে আসে ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের আবহ। সবাই যার যার মতো টাকা দিয়ে কেনা হয় ইফতার সামগ্রী। ধর্ম-বর্ণ-জেন্ডারভেদে সবার অংশগ্রহণে বরাবরই সম্প্রীতির বার্তা পৌঁছে দেয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের ইফতার।

শুধু ক্যাম্পাসের বর্তমান শিক্ষার্থীরাই নয়, সাবেক শিক্ষার্থীরাও আসেন ইফতারির মাধ্যমে আড্ডা আর গল্পে মেতে উঠতে। সাবেক-বর্তমানের মেলবন্ধন ছড়িয়ে দেয় ঐক্য ও সৌহার্দ্যরে বার্তা। অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মুহাম্মদ মূসা বলেন, কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে ছোট বড় সকলে মিলে একত্রে ইফতারের সময় যে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয় তা আমাদের মানসপটে আরেকটি পারিবারিক উৎসব ও পরিবারের অনুভূতি দেয়।

অনেক শিক্ষার্থীর জন্য, রমজান তাদের বিশ^াসের প্রতিফলন এবং তাদের আধ্যাত্মিক সংযোগকে শক্তিশালী করার সময়। তবে ক্যাম্পাসের মাঠে ইফতারের সময় একটি অসম্প্রদায়িক ঐক্যের অনুভূতি গড়ে ওঠে। আমাদের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও, আমরা সকলেই আমাদের সহানুভূতি ও মানবিকতায় একতাবদ্ধ। জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি শৌমিক বাগচী বলেন, কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের ইফতারটা আমাদের ঐতিহ্যের একটা অংশ হয়ে গিয়েছে।

অনেক বিভাগেই এখন ক্লাস, পরীক্ষা চলছে। সবাই যখন একসঙ্গেই আছে, সবাই একত্রেই ইফতার করছে। আমি নিজে ইসলাম ধর্মাবলম্বী না হলেও আমার বিভাগ থেকে যখন ইফতারের আয়োজন করা হচ্ছে তখন আমাকেও ডাকা হচ্ছে। এই চর্চা আমরা বিশ^বিদ্যালয়ের পাশাপাশি অন্যত্রও ছড়িয়ে দেব অবশ্যই। ধর্ম আচরণ শুধু ধর্মাবলম্বীর জন্য কিন্তু উৎসবটা ধর্ম-গোত্রভেদে সবার জন্যই। 

×