ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১২ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা সফরে কাশ্মীর

তানিউল করিম জীম

প্রকাশিত: ০০:৫৩, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা সফরে কাশ্মীর

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) সাংবাদিক সমিতির ১৪ দিনের কাশ্মীর সফর

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) সাংবাদিক সমিতির ১৪ দিনের কাশ্মীর সফর শেষ হয়েছে। যাত্রার দিন সকাল থেকেই শুরু হয় বৃষ্টি। কিন্তু বৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে ময়মনসিংহ রেলস্টেশন থেকে শুরু হয় যাত্রা। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন রাফি ও জাহিদ ভাই। এখন অপেক্ষা ঢাকাগামী তিস্তা এক্সপ্রেসের। ৫ টায় ট্রেন এলো। কে কোন্ বগিতে উঠবে ঠিক করে দিলেন আমাদের ট্যুরের সর্বাধিনায়ক রনি ভাই। আমি, আতিক, তানভীর আর লিখন উঠলাম ড বগিতে। এদিকে ট্রেনে উঠেই ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তানভীর। তবে জামালপুর থেকে ছেড়ে আসা তিস্তা এক্সপ্রেসে মাত্রাতিরিক্ত ভিড় যাত্রীদের। বসে থাকা যাত্রীদের থেকে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের সংখ্যাই বেশি। কখনো দ্রুত কখনো ধীরে এভাবেই চলতে থাকে ট্রেন। 
দেখতে দেখতে সকাল ৬টা। পৌঁছলাম দর্শনা হাল্ট স্টেশনে। সেখান থেকে সোজা চলে গেলাম বর্ডারে। সকালের নাস্তা শেষে বাংলাদেশে ইমিগ্রেশনের সব কাজ শেষ করে ইন্ডিয়াতে চেকিং। চেকিং শেষে ইন্ডিয়ার গেদে স্টেশনে এসে আমরা আবার ইন্ডিয়ার ইমিগ্রেশন শেষ করলাম। 
ট্যাক্সিতে প্রথম কলকাতার ভ্রমণ ছিল স্মৃতিময়। ট্যাক্সিতেই এক পলক দেখে নিলাম ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। এবার সারাদিনের ক্লান্তি দূর করার পালা।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই গেলাম নবাব কিং রেস্তোরাঁয়। গরুর মাংস ভুনা ও পরোটা খেলাম মাত্র ৮০ রুপিতে। এর পরেই হলুদ ট্যাক্সিতে করে যাত্রা করলাম হুগলি নদীর ওপর ইস্পাতের তৈরি ঐতিহ্যবাহী হাওড়া  ব্রিজ দেখতে। বিদ্যাসাগর ব্রিজ দেখা যাচ্ছিল হাওড়া ব্রিজ থেকে। ব্রিজটি স্টিলের তৈরি। এরপর সবাই মিলে একটি গ্রুপ ফোটো তোলা হলো। নিজের ছবি যে যার মতো তুলে নিল। 
এরপর  হোটেলে এসে গোসল করে বের হয়ে পড়ি শিয়ালদহ স্টেশনের দিকে। সেখানে পৌঁছে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। স্টেশনে ২৪টি প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। আমাদের ট্রেনের নাম ছিল হামসাফার। এই ট্রেনেই দীর্ঘ ৩৬ ঘণ্টা জার্নি করে আমরা পৌঁছব জম্মুতাই স্টেশনে। জম্মু যাওয়ার সবচেয়ে দ্রুতগামী ট্রেন এটিই। খোঁজ নেওয়ার পর জানলাম আমাদের ট্রেন আসবে ১৭ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। ৩৬ ঘণ্টার জার্নি শেষ করে নেমে পরলাম। এদিকে আমাদের বগিতে সবাই বিরিয়ানি খাচ্ছে। জম্মুতে ট্রেন থেকে নেমে সারারাত স্টেশনে অপেক্ষা করি। পরে রেলওয়ে মসজিদে সকালের নামাজ পড়ি আমরা। এই মসজিদটি অত্যন্ত সুন্দর। প্রায় ১২০০ লোক একত্রে নামাজ পরতে পারে। 
শ্রীনগর যাওয়ার জন্য টেম্পু (মাইক্রোবাস) ঠিক করা হলো। ৫৮০ টাকা করে জনপ্রতি খরচ পড়ল। ৩০০ কিলোমিটার রাস্তা। শুরুতেই অন্ধকার টানেলের মধ্য দিয়ে চলাচল শুরু। সামনে এগোতেই শুরু হলো পাহাড়ি রাস্তা। হালকা কুয়াশায় ঢাকা আর চারপাশে গাছপালা।  বড় বড় পাহাড়ের সবুজ সমারোহ। যতই সামনে যাই, কুয়াশা আরও বেশি যেন। পাহাড়ে পাথর।  সেই পাথর গড়িয়ে রাস্তাতেও পড়ে দেখলাম।
বড় বড় পাহাড়গুলো দেখে মনে হচ্ছিল যে ছবিতে আঁকা। কিন্তু এগুলো তো বাস্তব।  পাহাড়ের এই পাশান বুকের ওপর দিয়েই আবার বয়ে চলেছে পানির স্রোতধারা। ভারত বাংলাদেশ থেকে অনেক এগিয়ে। তারা পাহাড়কে সাধ্যমতো ব্যবহার করছে। পাহাড়েই তৈরি করেছে ব্রিজ, কালভার্টসহ সকল প্রকার যাতায়াত ব্যবস্থা। সকল জায়গায় রয়েছে বিদ্যুৎ ও নেটওয়ার্ক। 
গুলমার্গ : সকালে উঠেই আমাদের বের হতে হবে গুলমার্গের উদ্দেশে। বরফে ঢাকা গাছগাছালির মধ্যে  ইন্ডিয়ান মুভির যে দৃশ্য দেখানো হতো বেশির ভাগ দৃশ্য এই গুলমার্গের। সকালের নাস্তা করেই ৩/৪ ঘণ্টা পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে আমরা সেখানে পৌঁছাই। সুউচ্চ পাহাড় আর উঁচু উঁচু সারি সারি পাইন গাছের সমারোহ। যেদিকে তাকানো যায় পাহাড় আর পাহাড়। সেই পাহাড়েই আবার দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বিশাল গাছগাছালি। চারপাশে শোনা যাচ্ছে হেয়া শব্দ (ঘোড়ার ডাক)।

রাস্তার পাশেই সারি করে ঘোড়া বেঁধে রাখা আছে। ঘোড়াতে অনেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটু দূরে তাকালেই দেখা মিলবে পাহাড়ের সঙ্গে মেঘের মিতালি। মেঘ যেন পাহাড়ের গায়ে শুয়ে পড়েছে। লেপ্টে ধরেছে পাহাড়কে । এ বন্ধন যেন অনড়। এমন মনোরম পরিবেশ কেমন হবে? অবশ্যই ভালো হবে, তাই না? শুধু ভালো বললে ভুল হবে, এখানে যদি আমি মারাত্মক শব্দ দিয়ে সেই শীতল পরিবেশকে ব্যাখ্যা করি, তাহলে ভুল হবে না। এখানে আশপাশে সুন্দর সুন্দর রিসোর্ট তৈরি করে রেখেছে। তবে অনেক ব্যয়বহুল।
সোনমার্গ, এ যেন ভূস্বর্গ : গান্দেরবল, কঙ্গন, গুন্দ প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাহাড়ি জনপদ। আর পুরো পথটা জুড়েই দামাল সিন্ধুনদ। ঠান্ডা শীতল সেই নদের পানি। দাপিয়ে বয়ে চলছে। এছাড়া শ্রীনগর থেকে সোনমার্গ যেতে পথে পড়বে পাইন, ফার, বার্চ আর দূর-দূরান্তের পাহাড়শ্রেণির শোভা দেখতে দেখতে আপনি মোহিত হয়ে পড়বেন। চারপাশে পাহাড় আর সোনালি ঘাসে ঢাকা সোনমার্গ নিয়ে জনশ্রুতি রয়েছে যে, এই উপত্যকার কোথাও এক কূপ আছে, জার জলে সোনালি রঙ ধরে উপত্যকায়। এই জন্য নাম সোনমার্গ অর্থাৎ সোনালি উপত্যকা। আমরা গাড়ি থেকে নামতেই ঘোড়া নিয়ে হাজির কিছু লোক।

ঘোড়ায় করে পর্যটকদের দর্শনীয় স্থান ঘুরিয়ে দেখানোই তাদের ব্যবসা। আমাদের বাজেট কম হওয়ার কারণে সিন্ধান্ত নেওয়া হলো হেঁটেই পাহাড়ি পথে যাবো সোনমার্গের সৌন্দর্য দেখতে। শুরু হলো পথ চলা। আতিকের কারেন্ট বেশি, তাই সে বরাবরের মতো দ্রুতই সামনে এগিয়ে চলেছে। বেশ ঠান্ডা জায়গায়টা।  ঠান্ডা হওয়ায় নিশ্বাস নেওয়াই একটু সমস্যা হচ্ছিল আমার। এভাবে আমরা সবাই পাহাড়ের একটি উঁচু স্থানে  একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বসি। পরে সেখানে সবাই মিলে বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে গ্রুপ ছবি তুলি। বিদেশের মাটিতে দেশের পতাকা উড়ানোর বিষয় বেশ শান্তির ও মর্যাদার ছিল। 
দুদপাথরী : মনে হচ্ছিল যেন গোল পাকে ঘুরছি। পাহাড়ে গাড়ি করে উঠতে লাগলে এমনি মনে হবে। ওপরের দিকে উঠতে লাগলেই ঠান্ডা বাতাসে এক আনন্দ থাবা মেরে যাচ্ছিল যেন! হলুদ রঙ করা বাসে স্কুলের বাচ্চাদের সঙ্গে সবাই মিলে হাত নাড়িয়ে হাই দিলাম। সবাই হঠাৎ এমন ব্যবহার পেয়ে একটু হয়তো বিব্রত হয়েছিল। আমরা যখন দুদপাথরীতে গেলাম, তখন সেখানে বৃষ্টি হচ্ছে। এক ছাতাতে দুজন করে রওয়ানা দিলাম পাহাড় রাস্তা দিয়ে। ভালো ঠান্ডা ছিল সেদিন। বেশ কিছুদূর গিয়ে এক দোকানে নরমাল পানি চাইলাম। দিল ঠান্ডা পানি। রাগে কইলাম  ঠান্ডা পানি দেন। একই রকম পানি। আসলে ঠান্ডা নরমাল আর ফ্রিজের পানি একই হয়ে গেছে। তারপর এক আন্টির সঙ্গে দেখা হয়, তার বাসা ছিল রাজশাহী। ২৬ বছর হলো তিনি প্রেমের টানে কাশ্মীরে চলে আসেন।  এখন এখানেই তিনি থাকেন। তার এক মেয়ে স্কুলের শিক্ষকও হয়েছেন। তার সঙ্গে আমাদের সবার ভালোই গল্প হলো। 

মোগল গার্ডেন : নিশাত বাগ  হলো একটি মোগল বাগান। এর পূর্ব পাশ দিয়ে নির্মিত ডাল লেক, পাশে শ্রীনগর ইউনিয়ন টেরিটরি জম্মু ও কাশ্মীর। এটি কাশ্মীর উপত্যকার দ্বিতীয় বৃহত্তম মোগল উদ্যান । ‘নিশাত বাঘথ উর্দু, এবং এর অর্থ ‘আনন্দ উদ্যান, ‘গ্ল্যান্ডের বাগান’ এবং ‘আনন্দের উদ্যান’। সম্রাট সাজাহানের নানা স্থাপত্যগুলো থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নূরজাহানের বড় ভাই আসিফ খান ১৬৩৩ সালে এটি তৈরি করেন। মোগল সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীরের কন্যা জুহুরা বেগমের কবর এখানেই রয়েছে। চারদিকে ফুলে ভরা আবার মাঝখানে পানির ফুয়ারা। ৮/৭ টি ধাপে সাজানো বাগানটি। যতই সামনে যাবেন উঁচুতে উঠতে থাকবেন। অবসর ও শান্তিতে সময় কাটানোর কি ভালো জায়গা।
ডাললেক ও শিকারা রাইড : শ্রীনগর শহর এক ঘনবসতিপূর্ণ, গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র। শহরের হৃৎপি- হলো ডাললেক। প্রায় ২৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট লেকের ওপরে রয়েছে তিনটি ছোট ছোট দ্বীপ। এগুলো হলো চারচিনার, কবুতরখানা আর নেহরু পার্ক। শিকারায় চেপে ডাললেক দর্শন এক তৃপ্তিদায়ক এবং স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। ডাললেক শুধু তার সৌন্দর্যের জন্যই বিখ্যাত নয়, লেককে কেন্দ্র করে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত ঘটে চলা কর্মকা- এককথায় তুলনাবিহীন। ডাললেকে নৌকার ওপর স্থায়ীভাবে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা খুব একটা কম নয়।

আমরা সন্ধ্যায় ডাললেকের শিকারা রাইডে (বিশেষ ধরনের নৌকা রাইড) উঠলাম, লেকের মধ্যেই কাশ্মীরী কাওয়া পাওয়া যায়। সবাই সেটি খেলাম। বেশ সুস্বাদু ছিল কাওয়া। রাইড শেষে সবাই মার্কেট করতে ব্যস্ত হয়ে যায়।
পেহেলগ্রাম : পরেরদিন রওয়ানা দেই পেহেলগ্রামের উদ্দেশে।  পথে আপেল ভ্যালি নামে এক আপেল বাগানে যাই। সেখানে ১মবারের মতো গাছে আপেল দেখা। বাগানে আপেল জুসও পাওয়া যায়। কেউ আপেল কিনল, কেউ জুসের স্বাদ নিল। আরেক জায়গায় গাড়ি দাঁড়াল। সেখান থেকে সবাই জাফরান, আখরোট  কিনল। পরে আমরা ভ্যালি রিসোর্ট নামে একটি রিসোর্টে উঠি। খুবই সুন্দর পরিবেশ ছিল রিসোর্টটির।

রিসোর্টটির পিছনে ছিল লিডার নদী। লোভ সামলাতে না পেরে লিডার নদীর ঠান্ডা পানিতেই কয়েকজন গোসল করে। পরে আশপাশে সবাই একটু ঘোরাঘুরি করি। জায়গাটি সন্ধ্যার পর অনেক ঠান্ডা হয়ে যায়। আর সন্ধ্যার পর লোকাল ট্রান্সপোর্টও চলে না। আমরা রিসোর্টে যাই, রেস্ট নেই। রাতের খাবার দিল মুরগির মাংস, সবজি, রুটি,ভাত। 
ভারতে ট্রেনে গেলে খরচ খুব কম হয়। ¯হানীয় লোকজনের কথা বুঝতে পারলে আর অনেক লোকজন নিয়ে গেলে খরচ কম হবে। কিছু জায়গায় খরচ ধরিনি।  ঘোড়ায় চড়ে সোনমার্গ, গুলমার্গ, বাইস রান ভ্যালি মোট ২০০০-২৫০০  রুপি লাগবে। আমরা এগুলো পায়ে হেঁটেই গিয়েছি। 

×