
সম্ভাবনা ও শঙ্কায় টালমাটাল পাঁচ ইসলামী ব্যাংক
দেশের আর্থিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশের ব্যাংকিং খাতে আস্থা ফেরাতে এবং দীর্ঘদিন ধরে লোকসানে থাকা দুর্বল ব্যাংকগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এই সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাংক খাতে যেমন নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তেমনি দেখা দিয়েছে নানা শঙ্কা ও বিতর্ক।
পাঁচটি ব্যাংকের মোট আমানত ১ লাখ ৯০ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা হলেও এর মধ্যে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকাই খেলাপি ঋণ-যা প্রায় ৭৭ শতাংশ। সমন্বিতভাবে এই ব্যাংকগুলোর পরিশোধিত মূলধন মাত্র ৫ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। কিন্তু মূলধন ঘাটতির অঙ্ক বিশাল। এত বিপুল খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতির মধ্যেও গ্রাহক সংখ্যা ৯২ লাখ এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী ১৬ হাজার। এই বিপুল জনবল ও গ্রাহকগোষ্ঠী মার্জার পরবর্তী সম্ভাবনার দিকে তাকিয়ে আছে।
গ্রাহক ও কর্মকর্তাদের দ্বিধা ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের এ উদ্যোগে একদিকে তৈরি হয়েছে একটি শক্তিশালী ইসলামী ব্যাংক গঠনের সম্ভাবনা, অন্যদিকে গ্রাহক ও কর্মকর্তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। অনেক গ্রাহক আমানতের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, আবার দুর্বল ব্যাংকগুলোর কর্মীরা আশঙ্কায় রয়েছেন চাকরি হারানোর। কয়েকটি ব্যাংক ইতোমধ্যেই আমানত হারাতে শুরু করেছে।
এক্সিম ব্যাংকের আপত্তি ও বাস্তবতা মার্জারের বিরোধিতায় সরব হয়েছে এক্সিম ব্যাংক। তাদের দাবি, তারা একটি স্বনির্ভর, শক্তিশালী ব্যাংক এবং অন্য কোনো দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে মার্জ হওয়া তাদের জন্য ক্ষতিকর হবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের করা অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ (একিউআর) বলছে ভিন্ন কথা। এক্সিম ব্যাংকের ৫২ হাজার ৭৬ কোটি টাকার বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে ২৫ হাজার ১০১ কোটি টাকাই খেলাপি, যা মোট ঋণের ৪৮.২০ শতাংশ। এ ছাড়া প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ১৫ হাজার ১১৭ কোটি টাকা।
আইএমএফের চাপ ও আন্তর্জাতিক নিয়ম ॥ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নিয়ম অনুযায়ী, কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩০ শতাংশ অতিক্রম করলে সেটিকে মৃত হিসেবে বিবেচনা করা হয়; যাকে হয় দ্রুত বিলুপ্ত করতে হবে, নয়ত পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। পাঁচটি ব্যাংকই এই সীমা অতিক্রম করেছে। তাই আইএমএফের চাপেই হোক বা আর্থিক স্থিতিশীলতার স্বার্থেই হোক, বাংলাদেশ ব্যাংকের একীভূতকরণ সিদ্ধান্তকে অনেকেই সময়োপযোগী মনে করছেন।
গভর্নরের আশ্বাসে সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, “এই মার্জার প্রক্রিয়ার সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং কয়েক মাসের মধ্যেই এটি বাস্তবায়ন হবে।” তিনি আরও বলেন, “এই মার্জারে কারও চাকরি যাবে না। অতিরিক্ত শাখাগুলো শুধু শহর থেকে গ্রামে স্থানান্তর করা হতে পারে।”
বিশ্লেষকের মত ব্যাংক খাতের একজন বিশ্লেষক বলেন, “এই পাঁচটি ব্যাংক একীভূত হলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে একটি বড় ব্যাংক তৈরি হবে। শাখা, কর্মকর্তা, গ্রাহক ও সম্পদের পরিমাণ একত্রে বিশাল হবে। দুর্বল অ্যাসেটগুলো অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির মাধ্যমে ব্যবস্থাপনায় আনা হবে। প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতি পূরণেও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
সম্ভাব্য সুফল একীভূত ব্যাংকে ৭৭৯টি শাখা, ৬৯৮টি উপশাখা, ৫০০টি এজেন্ট আউটলেট এবং ১,০০০টির বেশি এটিএম বুথ নিয়ে গড়ে উঠবে দেশের বৃহত্তম ইসলামী ব্যাংক। এই ব্যাংক ব্যাংকিং সেবার আওতা বাড়িয়ে গ্রামীণ অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখতে পারবে। মার্জারের ফলে খরচ কমবে, প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়বে এবং দক্ষ মানবসম্পদের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়বে। সার্বিকভাবে, ব্যাংক মার্জার দেশের ব্যাংকিং খাতে কার্যকারিতা, স্থিতিশীলতা এবং আস্থা ফিরিয়ে আনতে একটি কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে বলে মত দিয়েছেন একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ- একিউআর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে এক্সিম ব্যাংকের আমানত ৪২৯৯৩ কোটি টাকা, বিতরণকৃত ঋণ ৫১৬৪২ কোটি, খেলাপি ঋণ ২৫১০১ কোটি, পরিশোধিত মূলধন ১৪৪৮ কোটি, শাখা ১৫৫টি এবং লোকসান ৪০৯ কোটি টাকা।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের আমানত ৩০৯৭৭ কোটি টাকা, বিতরণকৃত ঋণ ৩৫২২০ কোটি, খেলাপি ঋণ ২৩৫৭৫ কোটি, পরিশোধিত মূলধন ১১৪০ কোটি, শাখা ১৮১টি এবং লোকসান ৫৩ কোটি টাকা।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের আমানত ১২৩১৩ কোটি টাকা, বিতরণকৃত ঋণ ১৪৪২৭ কোটি, খেলাপি ঋণ ১৩৫৬৯ কোটি, পরিশোধিত মূলধন ৯৮৭ কোটি, শাখা ১০৪টি এবং লোকসান ২১৪ কোটি টাকা।
ইউনিয়ন ব্যাংকের আমানত ১৭৯৪২ কোটি টাকা, বিতরণকৃত ঋণ ২৮২৭৯ কোটি, খেলাপি ঋণ ২৬৪৯১ কোটি, পরিশোধিত মূলধন ১০৩৬ কোটি, শাখা ১১৪টি এবং লোকসান ৮০ কোটি টাকা।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের আমানত ৪৩১৪৩ কোটি টাকা, বিতরণকৃত ঋণ ৬০৯১৫ কোটি, খেলাপি ঋণ ৫৮১৮২ কোটি, পরিশোধিত মূলধন ১২০৮ কোটি, শাখা ২০৬টি এবং লোকসান ৪০৫ কোটি টাকা।