
ডিম-মুরগি, ছবি: সংগৃহীত
স্থিতিশীল থাকা ডিম-মুরগির বাজারকে অস্থির করে তুলতে আবারও পাঁয়তারা শুরু হয়েছে। বর্তমানে স্থিতিশীল ডিমের বাজারকে অস্থির তুলতেই আজ (পয়লা মে) থেকে সারাদেশে পোলট্রি খামার বন্ধের ডাক দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হস্তক্ষেপে তা আর হয়নি। রমজানের শুরু থেকেই দেশে ডিমের বাজারে স্থিতিশীলতা এসেছে। চড়া দামের ডিম ক্রমান্বয়ে ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে এসেছে। এখন এই বাজারকে অস্থির করতে ডিমের দাম বাড়িয়ে অতীতের মতো ফায়দা লুটতে চায় এক শ্রেণির মুনাফালোভী ব্যবসায়ী।
চলতি মাসের ১৭ এপ্রিল সাংবাদিকদের কাছে এক বিজ্ঞপ্তি পাঠায় বিপিএ। বিজ্ঞপ্তিতে ১০ দফা দাবি ঘোষণা করে তা বাস্তবায়ন না হলে আজ থেকে সারা দেশে সব পোলট্রি খামার বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়। যদি সারা দেশে সব পোলট্রি খামার বন্ধ করার মতো উদ্যোগ নেওয়া হয় তাহলে এ খাতের অস্থিরতা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা অনুমান করা কঠিন। নিবন্ধনহীন এই সংগঠনের বিরুদ্ধেই এবার অভিযোগ উঠেছে, স্থিতিশীল থাকা ডিম-মুরগির বাজারকে অস্থির করে তোলার। যদি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত পোলট্রি খামার বন্ধের ঘোষণা থেকে সরে এসেছে সংগঠনটি।
সবচেয়ে আশ্চর্যজনক হলো, যে সংগঠনের নামে এই বন্ধের ডাকা দেওয়া হয়েছিল তা কোনো সংগঠন নয়। সিটি করপোরেশরে লাইসেন্সধারী একটি একটি প্রতিষ্ঠান। যার নাম ‘বাংলাদেশ পোলট্রি এসোসিয়েশন’। আর এই প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. সুমন হাওলাদার। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে ২০২২ সালের ২৭ অক্টোবর যে ই-ট্রেড লাইসেন্সের ইস্যু করা হয়েছে তার তথ্য এটি। প্রশ্ন উঠেছে ব্যক্তি মালিকানার একটি ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে কেউ এসোসিয়েশনের মতো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন কিনা।
অথচ এই ব্যক্তি সারা দেশের প্রান্তিক খামারিদের প্রতিনিধিত্ব করছেন। নিজের নামের একটি ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে একটি সংগঠন বা এসোসিয়েশনের মতো করে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন, সংবাদ সম্মেলন করছেন- পোলট্রি খাতের বিরুদ্ধে বিষোধাগার করছেন, মাঝে মধ্যে আবার স্থিতিশীল বাজারে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছেন। অথচ খামারিদের প্রতিনিধিত্ব করার কথা বললেও সুমন হাওলাদারের নিজের একটি খামারই নেই। ২০২২ সাল থেকে ট্রেড লাইসেন্স পাওয়ার পর থেকে তিনি এখন পর্যন্ত নিজেই সভাপতি।
এ ধরনের একটি এসোসিয়েশন করতে হলে সেখানে একটি কার্যনির্বাহী কমিটি থাকতে হয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন দরকার হয়। তার কিছুই নেই এই প্রতিষ্ঠান সংগঠনের।
সুমন হাওলাদার গবেষণার কথা বললেও আসলে তার কোনো গবেষণা টিম নেই বলে তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, খামারিদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে এসব হিসাব করা হয়। আবার মাঝে মধ্যে তিনি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের তথ্যও তুলে ধরেন। এটি তিনি নিজে বসে ক্যালকুলেটর দিয়ে হিসাব করে নেন।
যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়ায় বিপিএর সভাপতি সুমন হাওলাদারের (যদিও এটি ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান) শুধু নাজিফা পোলট্রি ফিড অ্যান্ড মেডিসিনের দোকান ছিল, যেটিও দুমাস আগে বন্ধ করে দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
সুমন হাওলাদার বলেন, তার সংগঠনে এখন ১৮ হাজার সদস্য। খামারিরাই তাকে বলেছেন খামার বন্ধের ডাক দিতে। তিনি খামার বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসায় এখন খামারিরা তাকে নানাভাবে বকাবকি করছেন।
তিনি স্বীকার করেন, ২০২০ সালে কার্যক্রম শুরু হলেও তার সংগঠনের এখনো কোনো নিবন্ধন নেই। সবশেষ তার যে দোকানটি ছিল যাত্রাবাড়ীতে, তাও দুই মাস আগে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তার কোনো খামার আছে কি না, জানতে চাইলে তার কাছ থেকে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে ডিম ও মুরগির দামে ব্যাপক অস্থিরতা তৈরি হয়। যে অস্থিরতা সরকার কোনোভাবেই কমাতে পারছিল না। তখন সরকার পোলট্রি এসোসিয়েশনকে কাজে লাগায়। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ভোক্তা অধিদপ্তরের বিভিন্ন কাজকর্মে। তারা অস্থিরতার সময়ে বিপিএর সভাপতিকে দিয়ে কম দামে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ডিম বিক্রি শুরু করে। আর তার এ ধরনের ন্যায্যমূল্যের দোকান উদ্বোধনে সবসময় পাশে থাকতেন তৎকালীন ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।
পোলট্রি খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০২৪-এর নির্বাচনের আগে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন শ ম রেজাউল করিম। তিনি করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাগে আনতে ব্যর্থ হওয়ায় এই সংগঠনকে সামনে নিয়ে আসেন, যাতে তাদের চাপে রাখা সম্ভব হয়। কিন্তু বাজারে সরবরাহ পরিস্থিতি, সাপ্লাই চেইন ঠিক না করে কোনোভাবেই দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
পোলট্রি খাতের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ কো-অর্ডিনেশন কমিটি (বিপিআইসিসি) দাবি করছে, পোলট্রি খাতে প্রান্তিক খামারিদের পাশাপাশি দেশী-বিদেশী অনেক প্রতিষ্ঠান বড় বিনিয়োগ করেছে। এ বিনিয়োগ ও শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত করতেই হঠাৎ ডিম-মুরগির বাজারকে অস্থির করার পাঁয়তারা শুরু হয়েছে।
পোলট্রি খাতের পরিচিত সংগঠনগুলোর একটি ব্রিডার্স ইন্ডাস্ট্রি এসোসিয়েশন। এর সভাপতি মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘বিপিএর কাজকর্ম এবং কথাবার্তা পুরোপুরি উদ্ভট। এ ধরনের চরিত্র শিল্পের জন্য ক্ষতিকর। তার বিষয়ে সরকারের অনুসন্ধান করা উচিত। কারণ এ শিল্পে দেশী-বিদেশী ব্যাপক বিনিয়োগ রয়েছে।
শিল্প খাদ্য নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখছে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানে যারা রয়েছে তারা নিয়মিত নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে উৎপাদন খরচ, লাভ-লোকসানের হিসাব দিয়ে যাচ্ছে। তারপরও প্রতিনিয়ত বিপিএ করপোরেটদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে, যা মোটেও ইতিবাচক কোনো ফল বয়ে আনবে না।
তবে বিপিএর উত্থানের পেছনে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোরও দায় রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কারণ বাজারে যখন ডিম-মুরগির দামে অস্থিরতা তৈরি হয়, তখন মিডিয়ার কাছে তথ্য প্রদানে প্রতিষ্ঠানগুলো গড়িমসি করে। এ সুযোগেটি গ্রহণ করে বিপিএ।
জানা গেছে, বর্তমানে পোলট্রি খাতে এক লাখের মতো ছোট-বড় খামার রয়েছে। যেখানে সরাসরি ২৫ লাখ এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৬০ লাখের বেশি মানুষ কাজ করছে। প্রতিদিন পোলট্রি খাত থেকে ৪-৪.৫ কোটি পিস ডিম উৎপাদন হয়। পোলট্রি খাতটি শুধু ডিম-মুরগির উৎপাদন নয়, বাচ্চা, খাদ্য, ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রি মিলিয়েই। এ খাতে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে। প্রতি বছর পোলট্রি খাত থেকে ১১ লাখ টন মুরগির মাংস উৎপাদন হচ্ছে, যা খাদ্য নিরাপত্তায় বড় ভূমিকা রাখছে।
কাওসার/শহীদ