
.
বাংলাদেশের অর্থকরী ফসলের মধ্যে অন্যতম পাট। এটি আমাদের ঐতিহ্য ও নিজস্ব সম্পদ। অর্থনীতিতে পাটের অবদান কতটা ছিল তা বোঝা যায় স্বাধীনতা যুদ্ধের পরের পাট উৎপাদনের চিত্র দেখলে। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয় ছিল ৩৪ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৯০ শতাংশ এসেছে পাট থেকে। ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট পাট চাষ হয়েছে ৬ দশমিক ৮২ লাখ হেক্টর জমিতে এবং ১১৬ কোটি ১৫ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করা হয়েছিল এবং ২০২১-২০২২ অর্থবছরে মোট পাট চাষ হয়েছে ৭ দশমিক ৪৫ লাখ হেক্টর জমিতে। যদিও এই অর্থবছরে রপ্তানিকৃত ডলারের পরিমাণ কমে হয় ১১২ কোটি ৭৬ লাখ ডলারে।
গত পাঁচ বছরে বহুমুখী পাটপণ্যের রপ্তানি দ্বিগুণ হয়েছে। পাট সুপ্রাচীনকাল থেকেই আমাদের দেশে অর্থকরী ফসল হিসেবে গুরুত্ব পেয়ে আসছে। সোনা রঙের আঁশে কৃষকদের চোখে ছিল সোনার স্বপ্ন। জীবন ও জীবিকার প্রধান অনুষঙ্গ ছিল পাট কেন্দ্রিক। তাই পাটকে সোনালি আঁশ বলা হতো। বিশ^বাজারে আমাদের পাটের চাহিদা আজও ব্যাপক। পাট এবং পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হয়। ব্রিটিশ আমল এবং তার পরবর্তীতেও বহু বছর পাটই ছিল আমাদের প্রধান অর্থকরী ফসল। এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজীকে বলা হতো প্রাচ্যের ড্যান্ডি। যেটা ছিল বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জে স্থাপিত প্রথম পাটকল।
বাংলাদেশে পাট শিল্পের যাত্রা শুরু হয় ১৯৫২ সালে বাওয়া জুট মিলস লিমিটেড স্থাপনের মধ্যে দিয়ে। তবে নানা কারণে সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ হলেও বেসরকারি খাতের প্রচেষ্টায় করোনাকালেও পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের প্রায় ১৩৫টি দেশে ২৮২টি পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়। বাংলাদেশের কাঁচাপাট রপ্তানি হয় প্রধানত ভারত, পাকিস্তান, চীন, ইউরোপ, আইভোরিকোস্ট, থাইল্যান্ড, ও অন্যান্য দেশে। আর পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয় ইউরোপ, তুরস্ক, ইরান, আমেরিকা, সিরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব, জাপান, সুদান, ঘানা এবং অন্যান্য রাষ্ট্রে। এক সময় পাটের বহুমুখী ব্যবহার সম্ভব হতো না। এখন তা সম্ভব হচ্ছে।
বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে পাটপাতা থেকে তৈরি অর্গানিক চা। এই ত্রিমুখী ব্যবহারই পাটের সোনালি অতীত ফিরিয়ে এনে দেশের অর্থনীতি আরও গতিশীল করতে ভূমিকা পালন করবে। পাটের সুতা দিয়ে তৈরি হচ্ছে শাড়ি, টুপি, জিন্স ও গরম কাপড় বিভিন্ন ধরনের ব্যাগ, নার্সারি পট, কুশন কভার, পর্দা, উড়োজাহাজের ইন্টেরিয়র ছাড়াও বহু ধরনের পণ্য পাট থেকেই তৈরি করা হচ্ছে। পাট থেকে তৈরি ২২ জাতের সুতাও রপ্তানি হচ্ছে বিশে^র ১৪টি দেশে। আবার জাপানের টয়োটা কোম্পানির গাড়ির বডিতে পরিবেশবান্ধব পাট ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া আরও অনেক কোম্পানিই এটা করছে। ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকরা আগের তুলনায় পাট চাষে বেশি আগ্রহী হচ্ছে। এখন শুধু লক্ষ্য রাখতে হবে যেন প্রান্তিক চাষিরা পাটের ন্যায্যমূল্য পায়। পাটের গুরুত্বপূর্ণ অনেক আবিষ্কারের মধ্যে একটি হলো পাট দিয়ে পরিবেশবান্ধব টিন তৈরি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, বাংলাদেশের বিজ্ঞানী পাট দিয়ে এই পরিবেশবান্ধব টিন তৈরি করে চমকে দিয়েছেন। এই বিজ্ঞানীর আবিষ্কারই হলো পাটের সোনালি ব্যাগ, জুটিন বা ঢেউটিন, হেলমেট ও টাইলস। পাট থেকে তৈরি জুটিন পরিবেশবান্ধব ও টেকসই। এটা পাটের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার। পাটের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে কর্তৃপক্ষ পাটের বহুমুখীকরণের নানা উদ্যোগ নিয়েছে।
পাটের সবুজ পাতা থেকে তৈরি অর্গানিক ‘চা’ চমৎকার ঔষুধিগুণ সম্পন্ন যা ডায়াবেটিস, ক্যান্সারসহ মারাত্মক রোগ থেকে মুক্তি দিতে পারে। আর পাটের শাক তো আমাদের দেশে সেই আদিকাল থেকেই জনপ্রিয়। এখানেও আর্থিক লাভ রয়েছে। আবার এই পাট পাতা থেকে তৈরিকৃত স্যুপও বিদেশে বেশ জনপ্রিয়। এটি এখন বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করার পরিকল্পনাও হয়েছে। এ চায়ের ভেষজগুণ থাকায় বিদেশে এর চাহিদাও রয়েছে। ইতোমধ্যেই তা রপ্তানিও শুরু হয়েছে। ফলে এর সম্ভাবনার দুয়ার নতুনভাবে খুলে গেছে। যে পাটকে বিশ^ কেবল সুতা, বস্ত্র বা এ ধরনের চিরচেনা কিছু পণ্যে দেখতো তা আজ পরিবর্তন হয়েছে। এখন প্রয়োজন তা ব্যাপকভাবে মানুষের কাছে পৌঁছানো এবং বিদেশে রপ্তানি বাড়ানো। আগে যেসব পণ্যে পাটের মোড়ক ব্যবহার করা হতো না সেসব পণ্যে আজ পাটের মোড়ক ব্যবহার করা হয়। এখন সারাবিশ^ পরিবেশ রক্ষায় সোচ্চার হয়েছে। ফলে যেসব পণ্যে গত কয়েক দশক ধরে প্লাস্টিক ব্যবহার করার ফলে পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে দেওয়া হয়েছে সেখানে পাটের ব্যবহার আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছে। পাট ও পাটজাত পণ্যের সঙ্গে দেশের বহু মানুষের জীবন ও জীবিকা অতীতের মতো আজও নির্ভর করে। এই উত্তরণ আশা জাগায় যে ক্রমেই দেশে পাটের সোনালি অতীত ফিরে আসবে এবং অর্থনীতিতে নতুন গতির সঞ্চার হবে।