রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার বড় ঝুঁকি
এলডিসি উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আরও জোরেশোরে প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে ভবিষ্যতে রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার বড় ঝুঁকি দেখছে সরকার। তবে এলডিসি উত্তরণ পরবর্তী সেই কঠিন সময় কিভাবে মোকাবেলা করা হবে সে বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। রফতানিতে নগদ প্রণোদনা ও ভর্তুকি কমানোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। স্বল্পোন্নত বা এলডিসি হতে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার পর বিদ্যমান শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ।
এ অবস্থায় রফতানি বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য ও অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করতে হবে। এ ধরনের বাণিজ্য চুক্তির আওতায় রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। একই সঙ্গে রফতানিতে নগদ প্রণোদনা ও ভর্তুকির মধ্যে যেগুলো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা ডব্লিউটিওর বিধিবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় সেগুলো ক্রমান্বয়ে হ্রাস করতে হবে। তবে বিকল্প উপায়ে উৎসাহিত করা হবে রফতানি খাতকে।
শনিবার ঢাকায় এলডিসি উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সংক্রান্ত এক জাতীয় কর্মশালায় এ তথ্য জানানো হয়েছে। এলডিসি উত্তরণে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গৃহীতব্য কার্যক্রম সম্পর্কে যে খসড়া সুপারিশমালা প্রণয়ন করা হয়েছে তা সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের কাছে উপস্থাপন এবং তাদের মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে এই কর্মশালাটির আয়োজন করা হয়।
এতে অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস। অংশীজনদের পক্ষ থেকে এফবিসিসিআই সভাপতি মোঃ জসিম উদ্দিন, বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান, গবেষকগণের পক্ষ হতে বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়েক সেন ও পিআরআইয়ের চেয়ারম্যান ড. জাইদী সাত্তার বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
এ ছাড়া প্যানেল আলোচক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর আবদুর রউফ তালুকদার, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মোঃ রহমাতুল মুনিম এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বক্তব্য রাখেন।
উল্লেখ্য, আগামী ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণ পরবর্তীতে বাংলাদেশকে যে চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলা করতে হবে, সেই প্রস্তুতি, পরিকল্পনা গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও মনিটরিং বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির কাজে সহায়তার জন্য গঠিত বিষয়ভিত্তিক ৭টি সাব-কমিটির মধ্যে একটি হচ্ছে ‘অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ ও ট্যারিফ যৌক্তিকীকরণ’ বিষয়ক সাব-কমিটি।
জাতীয় কর্মশালায় মূল সুপারিশমালা উপস্থাপন করেন এ সাব-কমিটির অধীনে গঠিত তিনটি স্টাডি গ্রুপের তিন আহ্বায়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিও দেয়া হয়েছে।
কর্মশালায় কর সংক্রান্ত বিধিবিধান ও পদ্ধতি সংস্কার বিষয়ে উপস্থাপনা করেছেন এনবিআরের সদস্য (কর নীতি) ড. সামস উদ্দিন আহমেদ, ট্যারিফ যৌক্তিকীকরণ বিষয়ে উপস্থাপনা করেন এনবিআর সদস্য (শুল্ক নীতি) মোঃ মাসুদ সাদিক এবং রফতানি প্রণোদনা বিষয়ে উপস্থাপনা করেন অর্থ বিভাগের মনিটরিং সেল এর মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) আরফিন আরা বেগম। জাতীয় কর্মশালায় ‘কর সংক্রান্ত বিধিবিধান এবং পদ্ধতি সংস্কার’ বিষয়ক স্টাডি গ্রুপ তাদের উপস্থাপনায় কর ব্যয় সংক্রান্ত গবেষণা সম্পাদনের মাধ্যমে কর অব্যাহতির অপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্রসমূহ চিহ্নিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করে। রাজস্ব প্রশাসনে অটোমেশন ও ডিজিটাইজেশনের ব্যাপ্তি বৃদ্ধির ওপরও বিশেষ জোর দেয়া হয়।
রাজস্ব আহরণ সংশ্লিষ্ট আইনসমূহের (যেমন, নতুন কাস্টমস আইন ও নতুন আয়কর আইন) ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়াও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন চুক্তি অনুসারে শুল্কায়ন প্রক্রিয়া সহজতর করা ও পণ্য খালাস দ্রুততর করার জন্য কর্মপদ্ধতি আধুনিকায়নের সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া ‘ট্যারিফ যৌক্তিকীকরণ’ বিষয়ক স্টাডি গ্রুপ যে সকল সুপারিশ উপস্থাপন করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- যে সকল পণ্যের ক্ষেত্রে আরোপিত কাস্টমস শুল্ক ডব্লিউটিওর বন্ড শুল্ক হার সীমা অতিক্রম করেছে সেগুলোর ক্ষেত্রে শুল্ক হার উক্ত সীমার মধ্যে নিয়ে আসা, যেহেতু ন্যূনতম আমদানি মূল্য ডব্লিউটিওর কাস্টমস মূল্যায়ন চুক্তির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, সে কারণে আলোচ্য ন্যূনতম আমদানি মূল্যকে পর্যায়ক্রমে ফেজ-আউট করা এবং পর্যায়ক্রমে আমদানি পর্যায়ে প্রযোজ্য প্যারা-ট্যারিফ এবং সম্পূরক শুল্ক হ্রাস করা।
এ ছাড়া সাবসিডি বিষয়ক স্টাডি গ্রুপ তাদের উপস্থাপনায় উল্লেখ করে যে, স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বর্তমানে নগদ সহায়তা প্রদান করতে কোন অসুবিধা না হলেও উত্তরণ পরবর্তীতে শিল্প পণ্যের রফতানির ক্ষেত্রে সেটি প্রদান করা যাবে না। এ ছাড়াও বর্তমানে রফতানি প্রণোদনা, নগদ সহায়তাপ্রাপ্ত খাতসমূহে স্থানীয় মূল্য সংযোজনের যে শর্ত রয়েছে তা বাদ দিতে হবে।
এ স্টাডি গ্রুপ রফতানি প্রণোদনা প্রদান করে না এমন একটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের রফতানি চিত্রের তুলনামূলক পর্যালোচনা করে দেখেছে যে, রফতানিতে নগদ সহায়তা না থাকলে দীর্ঘ মেয়াদে নেতিবাচক প্রভাবের মাত্রা কম হবে। তবে, যেহেতু নগদ প্রণোদনা প্রত্যাহার করা হলে রফতানি খাতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে, সে কারণে বিকল্প কি ব্যবস্থা বা কার্যক্রম গ্রহণ করা যায় তা এ স্টাডি গ্রুপ পর্যালোচনা করে দেখছে।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউসের সঞ্চালনায় মুক্ত আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর পর্বে বিভিন্ন চেম্বার বডির সদস্যগণ ও বিভিন্ন সেক্টরের প্রতিনিধিবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের পথ মসৃণ করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য রফতানিকারক, আমদানিকারকসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের ও গবেষকদের বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণ জরুরী।
বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ‘অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ ও ট্যারিফ যৌক্তিকীকরণ’ সাব-কমিটির গৃহীতব্য কার্যক্রম বিষয়ক সুপারিশমালা চূড়ান্ত করার কাজে জাতীয় কর্মশালায় অংশীজনদের কাছ থেকে প্রাপ্ত মূল্যবান মতামত ও পরামর্শ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।