ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

 হারানো শহীদ মিনার ফিরে আসছে নগরীতে

সমুদ্র হক

প্রকাশিত: ২০:৪৩, ৩১ মার্চ ২০২৩

 হারানো শহীদ মিনার ফিরে আসছে নগরীতে

বিএনপি-জামায়াতের নির্মিত বিদঘুটে শহীদ মিনার (বাঁয়ে) ধ্বংস করে দেওয়া বগুড়ার সৃষ্টিশীল সেই শহীদ মিনার (ডানে)

অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রায় বিশ বছর পর বগুড়া নগরীর মানুষের হৃদয়ের সেই শহীদ মিনার নির্মিত হতে যাচ্ছে। এর আগে বহুবার নগরীর শহীদ খোকন পার্কের পূর্ব-উত্তর কোনে বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে গুঁড়িয়ে দেওয়া সৃষ্টিশীল নন্দন শহীদ মিনার পুনঃস্থাপনের দাবি উত্থাপিত হয়েছে। কয়েক দফায় আশ্বা পাওয়া গেলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। অদৃশ্য জটিলতা ভর করে ছিল নির্মাণকাজে। সাধারণ মানুষ আশায় ছিল, নিশ্চয়ই একদিন হারানো শহীদ মিনার ফিরে পাওয়া যাবে। সেই আশা পূরণ হতে চলেছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদের আশ্বাসে। মার্চের মধ্যভাগে তিনি বগুড়া সফরে সার্কিট হাউসে সুধীজন সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বগুড়ায় গুঁড়িয়ে দেওয়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ করে দেবেন এমনটি কথা দেন। বলেন শহীদ মিনার নির্মাণের অর্থের জোগান দেবে মন্ত্রণালয়। বছর জুলাই মাসে বগুড়ার শহীদ মিনার নির্মাণকাজ শুরু হবে। তার এই আশ^াসে সাধারণ মানুষের মনে আস্থা ফিরে আসে।

বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে তারেক রহমানের নির্দেশে বগুড়ায় ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ম্যুরালের নক্সায় নির্মিত শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দিয়ে তার কাছাকাছি নির্মিত হয় বর্ণ এঁটে দেওয়া বিদঘুটে এক শহীদ মিনার। নির্মাণের পরই বগুড়ার সুধীজন প্রত্যাখ্যান করেন। পুরানো শহীদ মিনার পুনর্নির্মাণের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। প্রতিবছর ওই কথিত শহীদ মিনারের ধারে শোলা দিয়ে প্রতীকী শহীদ মিনার বানিয়ে প্রগতিশীল ধারার তরুণরা ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে।

বগুড়া নগরীতে একটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের তাগিদ অনুভব করেন বগুড়ার গুণী সৃষ্টিশীল শিল্পী খন্দকার আমিনুল করিম দুলাল (প্রয়াত) ১৯৮৩ সালে তিনি একটি শহীদ মিনারের নক্সা করে নিজে নির্মাণ তত্ত্বাবধানের আগ্রহ প্রকাশ করে পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলামের (প্রয়াত) কাছে প্রস্তাব দেন। পৌর চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলাম বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তখনই অনুমতি দেন। একই বছর নগরীর নবাববাড়ি সড়কের ধারে শহীদ খোকন পার্কের ভেতরে ডান দিকে শহীদ মিনার নির্মাণের স্থান নির্বাচন করে দেন। বরাদ্দ হয় দশমিক ৮০ লাখ টাকা। ওই বছরই ভাষা আন্দোলন থেকে ৬৯ এর গণঅন্দোলন হয়ে৭১ এর দিনগুলোকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিজয় পর্যন্ত ইতিহাস ভিত্তিক কনস্ট্রাকশন ম্যুরালের ওপরে   বর্ণমালা দিয়ে একটি দৃষ্টিনন্দন শহীদ মিনার নির্মাণ করে দেন শিল্পী দুলাল।

বগুড়ার এই শহীদ মিনার দেশের অন্যান্য স্থানের চেয়ে ব্যতিক্রমী হিসেবে প্রশংসিত হয়। সেই শহীদ মিনারের বিভিন্ন কোনায় ম্যুরালে তাকালে একটি জাতির জন্মের ইতিহাস দৃষ্টিতে আসে। শিশু কিশোররা হৃদয়ে গেঁথে নেয় ইতিহাস। বগুড়ার মানুষের প্রাণের সেই শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় হাজার সালে। শহীদ খোকন পার্কের উল্টো দিকে স্টিলের পাইপ কনস্ট্রাকশনে এমন একটি কথিত শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয় যা দেখে সাধারণ মানুষ ধিক্কার দেয়। ওই বছর থেকেই আগের শহীদ মিনার পুনর্নির্মাণের দাবি উঠতে থাকে।

তারও আগের কথা : ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে বগুড়ার সর্বস্তরের মানুষ বড় ভূমিকা রাখে। পরবর্তী বছর ১৯৫৩ সালে প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয় নগরীর আলতাফুন্নেছা খেলার  মাঠে। একই সময়ে নগরীর অ্যাডওয়ার্ড পার্ক কেন্দ্রস্থল সাতমাথায় শহীদ মিনার নির্মাণ করে সেদিনের তরুণরা। পরে এই শহীদ মিনারগুলো গুঁড়িয়ে দেয় তৎকালীন পাকিস্তানি সরকার। দেশ স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারি আজিজুল হক কলেজের পুরাতন ভবনে দ্রুত শহীদ মিনার নির্মাণ করে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয়। এর পর ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর সেখানেই পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হতো। ১৯৮৪ সাল থেকে শহীদ খোকন পার্কে নির্মিত সৃষ্টিশীল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয়। ২০০৪ সালের পর বগুড়ার সুধীজন প্রগতিশীল ধারার মানুষ বিএনপি-জামায়াত সরকারের নির্মিত শহীদ মিনারে গিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে হোঁচট খায়। তারা পুরাতন জায়গায় প্রতীকী শহীদ মিনার বানিয়ে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে।  

হাজার সালের ডিসেম্বেরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর হারানো শহীদ মিনার পুনর্নির্মাণের দাবিতে সর্বস্তরের মানুষ মাঠে নামে। উদীচীর তৎকালীন সভাপতি রহিম চৌধুরীর (প্রয়াত) নেতৃত্বে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সকল সদস্য সংগঠন মানববন্ধন সমাবেশসহ আন্দোলন গড়ে তোলে। শরিক হয় বগুড়ার সুধীজন। বগুড়া থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক তৌফিক হাসান ময়না, সংশপ্তক থিয়েটারের সভাপতি সাদেকুর রহমান সুজন, নীভা রানী, উদীচীর শিল্পীরা  শব্দকথন সাহিত্য আসরের এইচ আলিম বলেন, প্রতিবার তারা প্রতীকী শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য দেয়। উদীচী, যুব ইউনিয়ন, ছাত্র ইউনিয়ন, খেলাঘর, রক্তটিকা আসর, লেখক চক্র, গীতিচর্চা সঙ্গীতালয়সহ প্রগতিশীল ধারার সকল সংগঠন এবং বগুড়ার সুধীজনের সম্মিলিত কণ্ঠস্বরফিরিয়ে দাও আমাদের হৃদয়ের শহীদ মিনার তাদের দাবি সেই শহীদ মিনার পুনর্নির্মাণ করে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হোক।

বগুড়া- (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নান (প্রয়াত) জীবিত থাকাকালে বগুড়ার পুরনো শহীদ মিনার পুনরায় নির্মাণের উদ্যোগ নেন। অনেক দূর এগিয়ে যান। তার মৃত্যুতে শহীদ মিনার নির্মাণে ভাটা পড়ে। বগুড়া- (সদর) আসনের উপনির্বাচনে বিজয়ী সংসদ সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসান রিপু হারানো শহীদ মিনার নির্মাণে বড় ভূমিকা রাখেন। চলতি বছর মার্চে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর আশ্বাসে বগুড়ার সকল মানুষের জোরালো সেই দাবি পূরণের সময় আসে। এখন অপেক্ষার পালা। সাধারন মানুষ আশা করে আছে ২০২৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারা হারানো সেই শহীদ মিনারে গিয়ে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করতে পারবে।

×