
.
ফাগুন মাস। গ্রামের মেঠো পথ। রাস্তার পাশে শিমুল ফুটেছে আগুনের মতো। ধুলো উড়িয়ে ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দ করতে করতে এগিয়ে চলেছে একটি গরুর গাড়ি। দুলকি চাল তার। বর গাড়ি সেটি। ছই দিয়ে সাজানো। রাস্তার দুপাশে খেজুর, শিমুল, পলাশের গাছ। তাদের ডালে ডালে ফাগুনের রঙ। পাতাঝরা ডালগুলোতে শিমুল ও পলাশ ফুলগুলো যেন আগুন ছড়াচ্ছে। সদ্যোজাত কচি আতা গাছের পাতাগুলো সকালের আলোয় যেন খিল খিল করে হাসছে। যেন রাস্তার বাঁকে একটা নয়নঝুলি। পদ্ম ও শালুকের বড় বড় বৃত্তাকার পাতাগুলোয় ঢাকা পড়েছে নয়নঝুলির গভীর নীল জল। তার ভেতর থেকেই মুখ তুলে আছে এদিক ওদিক প্রস্ফুটিত পদ্ম ও শালুকের ফুল। ফাঁকে ফাঁকে ডুব মারছে কয়েকটা পানকৌড়ি। জল টলমল পদ্মপাতায় বসে আছে একটি শিকারি মাছরাঙ্গা পাখি। নববধূটি গরুর গাড়ির ছইয়ের ভেতর থেকে মুখ বাড়িয়ে এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছে তার নতুন ঠিকানায়। বিচ্ছেদের যে কষ্ট নিয়ে সে বেরিয়েছিল, প্রকৃতির এই দৃশ্য দেখার পর এখন সেই কষ্ট অনেকটাই হালকা হয়েছে।
‘ওকি ও গাড়িয়াল ভাই রে.. আর কত রব পন্থের দিকে চেয়ে...’ একটি ভাওয়াইয়া গান। লিখেছেন ভাওয়াইয়া স¤্রাট আব্বাস উদ্দিন। গানের বিষয়টিও বড় করুণ। দীর্ঘদিন মেয়েটি বাপের বাড়ির কোনো খবর পায়নি। বাবা-মাকে দেখার জন্য সে বড়ই ব্যাকুল ও উতলা। তাই গরুর গাড়ির গাড়োয়ানকে মনের কথা জানাচ্ছে, এই গানের মধ্য দিয়ে। গাড়োয়ান যেন বাবা-মাকে গিয়ে তার মনের কথাটা বলেন। মনে পড়ে গেল, কালি দাসের ‘মেঘদূত’ কাব্যের কথা। সেখানে সংবাদবাহক ছিল মেঘ। এখানে গরুর গাড়ির দারোয়ান। সংস্কৃতের সেই ভাবগাম্ভীর্য এখানে নেই। আছে গ্রাম বাংলার সহজ সরল সরসতার ছোঁয়া। আজ থেকে তিন দশক আগেও গ্রামে বরযাত্রার গাড়ি হিসেবে গরুর গাড়িই ব্যবহৃত হতো। এটা অনেক প্রাচীন যান। তিরিশ নয়, আজ থেকে এক হাজার বছর আগেও বরযাত্রায় গরুর গাড়ি বা গোযান ব্যবহৃত হতো। সে ইঙ্গিত চর্যাপদেও রয়েছে।
গ্রাম বাংলায় ঐতিহ্যগতভাবে গরুর গাড়ি কিছুদিন আগে পর্যন্তও যাতায়াত ও মাল বহনের কাজে প্রভূত পরিমাণে ব্যবহৃত হতো। তবে বর্তমানে নানা ধরনের মোটরচালিত যানের আধিক্যর কারণে অপেক্ষাকৃত ধীরগতির এই যানটির ব্যবহার অনেক কমে এসেছে। ফ্রান্সের ফঁতান অঞ্চলে আল্পস পর্বতের উপত্যকায় একটি গুহায় গরুর গাড়ির যে ছবি পাওয়া যায়, তার থেকে জানতে পারা যায় খ্রিস্টের জন্মের ৩১০০ বছর আগে ব্রোঞ্জ যুগেও গরুর গাড়ির অস্তিত্ব ছিল। হরপ্পা সভ্যতাতেও যে গরুর গাড়ির অস্তিত্ব ছিল তার সপক্ষে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়। সেখানেও নানা অঞ্চল থেকে এক অক্ষ বিশিষ্ট চাকাওলা নানা খেলনা পাওয়া গেছে। এত কথা বলার কারণ এক সময় বিয়ে-সাদীতে গরুর গাড়ি ছিল একমাত্র বাহন। বরযাত্রার গাড়ি হিসেবে গরুর গাড়ির কনভয় ছিল বিখ্যাত। চিরকাল সেটা ইতিহাস হয়েই থেকে যাবে। শুধু তাই নয় গরুর গাড়িতে মাইকে বেঁধে গান বাজাতে বাজাতে বরযাত্রী যেতেন কন্যার বাড়িতে। অনেক সময় কলের গানও সঙ্গে নিতেন।
বাংলাদেশে বিবাহ প্রথা বলতে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনুষ্ঠিত বিয়ে ও এর আনুষঙ্গিক আচারকে বোঝানো হচ্ছে। বাংলাদেশের সর্বত্র বিয়েকে ‘বিয়ে’ কিংবা ‘বিবাহ’ নামে সম্বোধন করা হলেও অঞ্চলভেদে আঞ্চলিকভাবে আরও বিভিন্ন উচ্চারণভঙ্গিতে ডাকা হয়, যেমন : বিয়্যা বা বিয়া (বিআ) কিংবা বিহা, হিন্দি ভাষার প্রভাব বা অনুকরণে শাদী। বিয়ে একদিকে যেমন ধর্মীয় মিথস্ক্রিয়ায় পড়ে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষঙ্গ ধারণ করেছে, তেমনি এই নৃতাত্ত্বিক সার্বভৌম এলাকার লোকাচারও ধারণ করেছে। তবে সর্বক্ষেত্রেই বিয়ে মোটামুটি তিনটি মূল অংশ : গায়ে হলুদ, বিয়ে এবং বৌভাত বা ওয়ালিমা-তে বিভক্ত। তবে ধর্মভেদে এই অংশ বিভাজনে সামান্য পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
এখন মুসলমানদের বাড়িতে কিংবা কমিউনিটি সেন্টারে কাজি ডেকে এনে বিয়ে পড়ানো হয়। দু’পক্ষের উপস্থিতিতে কাজি, বর-কনের সম্মতি জানতে চান এবং উভয়ের সম্মতিতে বিয়ের মূল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। এ সময় বিয়ের খুতবা পাঠ ও নব-দম্পতির সুখের জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করা হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিয়েতে পুরোহিত মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে বিয়ে পড়ান, তার পর অগ্নিকে বায়ে রেখে তাকে ঘিরে সাতবার চক্কর দেওয়ার মাধ্যমে বিয়ের মূল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। এছাড়া হিন্দু শাস্ত্রমতে ‘দৈব বিবাহ’ও হয়ে থাকে, যাতে কন্যার বাবা মন্দিরে গিয়ে ঈশ্বরকে সাক্ষী করে মেয়েকে তার জামাতার হাতে তুলে দেন। বৌদ্ধ ধর্মেও মন্ত্র আউড়ে বিয়ে পড়ান বৌদ্ধ ভিক্ষু। খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের বিয়ে হয় গির্জায় পুরোহিতদের উপস্থিতিতে। পুরোহিত বাইবেল থেকে পাঠ করে দম্পতির সম্মতি জানেন এবং উভয়ের সম্মতিতে বিয়ে সম্পন্ন হয়।
গায়ে-হলুদ হলো বিয়ের মূল অনুষ্ঠান বহির্ভূত একটি অনুষ্ঠান, যা সাধারণত বিয়ের আগে অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানটির সূচনালগ্নে যদিও বর বা কনের গায়ে হলুদ দেওয়ার অনুষ্ঠানই ছিল, কিন্তু সময়ের আবর্তনে অনুষ্ঠানটি এখন অনেক ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। গায়ে-হলুদের পোশাকে বরের ঐতিহ্যবাহী পোশাক হলো পাঞ্জাবি। সুতি পাঞ্জাবির প্রচলন অতীতকাল থেকে চলে এলেও অধুনা সুতির পাশাপাশি খাদি বা অ্যান্ডির প্রচলনও দেখা যায়। অধুনা পুরুষদের পাঞ্জাবির সঙ্গে ওড়না বা উত্তরীয় পরার চলও দেখা যায়। অতীতে পাঞ্জাবির সঙ্গে সাধারণ ঢোলা পাজামা পরার রীতি দেখা গেলেও অধুনা চুড়িদার পাজামা এমনকি জিন্স পরার রীতিও লক্ষণীয়। পায়ে থাকে চটি জুতা।
কনের গায়ে হলুদের ভূষণে হলুদ শাড়ি লাল পাড়ের প্রচলন যুগ-যুগান্তরের। অধুনা গায়ে হলুদে-হলুদ, লাল, সবুজ, নীল, সাদা, বেগুনি ইত্যাদি বৈচিত্র্যময় রঙের জামদানি শাড়ির প্রচলন লক্ষণীয়। কেউবা বৈচিত্র্য আনতে কাতান, গরদ কিংবা গ্রাফিক্যাল প্রিন্টের শাড়িও পরে থাকেন। চওড়া পাড়ের সুতি শাড়ি বহুযুগ থেকে আধুনিক যুগ অবধি বিরাজমান। কেউ কেউ সিল্ক এমনকি মসলিনও পরে থাকেন। অতীতে কুচি দেওয়া ব্লাউজের প্রচলন থাকলেও অধুনা কামিজ কাটের ব্লাউজ, কন্ট্রাস্ট ব্লাউজের প্রচলন দেখা যায়। এ ছাড়া শীতকালে অনুষ্ঠিত বিয়েতে ব্লাউজের সঙ্গে কেউ কেউ লং জ্যাকেট পরে থাকেন। ব্লাউজের রং বিভিন্ন রকমের হতে পারে। অন্যান্য অনুষঙ্গের মধ্যে রয়েছে খোঁপার কাঁটা, বিছা, নূপুর ; হাতে বটুয়া ইত্যাদি।
একইসঙ্গে এই অনুষ্ঠান, দেশের বাইরের অনেক সংস্কৃতিও ধারণ করতে শুরু করেছে। অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন কনেপক্ষ এবং বরপক্ষ এখানে অতিথির মতো উপস্থিত হোন। অনুষ্ঠানে বরপক্ষ পরিবার-পরিজন, নিকটাত্মীয়, বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীদের সমন্বয়ে গঠিত বরযাত্রী নিয়ে উপস্থিত হন। সাধারণত অনুষ্ঠানে বর ও কনের জন্য আলাদা আলাদা স্থান থাকে। বর গিয়ে তার জন্য নির্ধারিত আসনে আসীন হোন। মুসলমানদের বিয়েতে এসময় একজন কাজীর দ্বারা আক্বদ পড়ানো হয়। আক্বদ হলো বর ও কনের পারস্পরিক সম্মতি জানার সামাজিক প্রক্রিয়া। প্রথমে বর ও কনেপক্ষের মুরব্বিদের উপস্থিতিতে বিয়েতে কনের সম্মতি জানা হয় এবং পরে একই কাজির দ্বারা বর ও কনেপক্ষের মুরব্বিদের উপস্থিতিতে বরের সম্মতি জানা হয়। এভাবে বিয়ের মূল অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।
এরপর শুরু হয় ভোজনপর্ব। বিয়ের ভোজন শুরু করা হয় বরের ভোজন দিয়ে। বরের জন্য এজন্য বিশেষভাবে আলাদা একটি বড় থালাতে খাবার সাজানো হয়, যাকে কোনো কোনো অঞ্চলে ছদরি (উচ্চারণ : সদ্) বলা হয়। এই থালাতে পরিবেশিত খাবার অধিকাংশ সময়েই অপচয় হয় এবং শ্রেফ সৌন্দর্যের জন্য পালন করা হয় এই রীতি। এছাড়া উপস্থিত বর ও কনেপক্ষের অতিথিদের জন্য আলাদাভাবে খাদ্য পরিবেশিত হয়। খাদ্য তালিকায় সাধারণত উচ্চক্যালরিযুক্ত খাবার থাকে, যেমন : পোলাও, মুরগির রোস্ট, কোরমা, কাবাব, রেজালা; মিষ্টিজাতীয় খাবারের মধ্যে থাকে : দই, পায়েস, জর্দা; হজম সহায়ক খাদ্যের মধ্যে থাকে বোরহানী ইত্যাদি। এছাড়া কোনো কোনো বিয়েতে সাদা ভাত, এবং কোমল পানীয়েরও ব্যবস্থা থাকে। বিয়ের ভোজন পর্ব শেষ হলে বরকে নিয়ে যাওয়া হয় কনের কাছে এবং দু’জনকে একত্র করে বসানো হয়। সেখানে আরো কিছু আচার পালন শেষে আসে বিদায় পর্ব।
হিন্দু রীতিতে সাতপাক
হিন্দুরীতির বিয়েতে অন্যান্য ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার পাশাপাশি মূল কার্যক্রম হয় সাতচক্কর বা সাতপাক। এ জন্য ম-পের মধ্যিখানে একটি অগ্নিকুন্ড তৈরি করে বর ও কনে উভয়ের পরিধেয় কাপড়ের একটা অংশ একত্রে গিঁট দিয়ে নেন এবং আগুনকে ডানে রেখে সাতবার চক্কর দেন বা ঘুরে আসেন। এভাবেই বিয়ের মূল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়।
বাংলাদেশে অন্যান্য অঞ্চলের মতো সত্তর দশকে যশোরাঞ্চলে বিয়েতে বর-কনেকে গোসল করানোর সময় একপ্রকার বিশেষ নাচের প্রচলন দেখা যায়। বর-কনেকে কেন্দ্র করে প্রতিবেশী নারীরা এ নাচের আয়োজন করে থাকেন। তারা ধান, দূর্বা, পান, কড়ি ইত্যাদি দিয়ে বিয়ের নাচে অংশগ্রহণ করেন। এ ধরনের নাচে বিশেষ গানও প্রচলিত ছিল :
একটু ঠিকর করে লাচরে ভাবের মার্যানী,
একটু গিদার করে লাচরে ভাবের মাল্যানী।
তোকে আম বাগানের আম খাওয়াবো এখুনি
তোকে জাম বাগানের জাম খাওয়াবো এখুনি।
বিয়ের দিন বরের পোশাক সাধারণত হয় পাঞ্জাবি-পাজামা আর শেরওয়ানী। মাথায় একটা টুপি পরে তার ওপর পাগড়ি পরে থাকেন বর। পায়ে থাকে মোজা আর নাগরা জুতা। পকেটে বা হাতে থাকে রুমাল। পাগড়ি কখনো পাঞ্জাবি ঢঙে বড় রঙিন কাপড় দিয়ে বানিয়ে নেওয়া হয়, কখনো বাজার থেকে রেডিমেড পাগড়ি কিনে আনা হয়। পাগড়ি কখনো শ্রেফ সাদা কাপড়ের হয়, তবে অধিকাংশ সময়ই পাগড় হয় রঙিন, একাধিক রঙের সম্মিলন, আর থাকে চুমকি-জরির কারুকাজ। ইদানীং কোনো কোনো বিয়েতে বর, কাঁধে শাল কিংবা ওড়না রাখার রীতিও দেখা যায়। কনের বিয়ের পোশাক হলো রঙিন শাড়ি। বিয়ের দিন সাধারণত লাল শাড়ি পরিধান করা হয়, তবে ইদানীং লাল ছাড়াও বেগুনি, সবুজ, গোলাপী ইত্যাদি রঙের শাড়ি পরতেও দেখা যায়। শাড়ি হয় যথেষ্ট কারুকাজ ম-িত : তার, কারচুপি, চুমকি, পুতি ইত্যাদির মিশ্রণে বেশ জমকালো হয়ে থাকে বিয়ের শাড়ি। শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে ব্লাউজ, পেটিকোট এবং জুতা পরিধান করে থাকেন কনে। বিয়ের সময় সাধারণত হাই হিল, সেমি হিল, কিংবা ফ্ল্যাট জুতা পরিধান করেন, তবে জুতাও শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে পরা হয়। অনেক সময়ই শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে হাত-ব্যাগ হাতে রাখার প্রচলন দেখা যায়।
বিয়ের অলংকার মানেই স্বর্ণালংকার। কখনো স্বর্ণের দাম বেড়ে গেলে কুলিয়ে উঠতে না পারলে রূপা দিয়েও অলংকারের স্থান পূরণ করা হয়। অতিরিক্ত সামর্থের ভিত্তিতে কেউ ক্রিস্টাল বা হীরার অলংকারও ব্যবহার করে থাকেন। এ ছাড়া সামর্থের অভাবে কেউ কেউ ইমিটেশনের অলংকার কিংবা স্বর্ণের প্রলেপ দেওয়া অলংকারও ব্যবহার করে থাকেন। গহনার মধ্যে টিকলি, টায়রা, বালা, কানের দুল, নাকফুল, নোলক, গলার চেইন, গলার বড় গহনা, নেকলেস, আংটি, পায়েল, নূপুর ইত্যাদির বহুল প্রচলন লক্ষণীয়।
পুরুষের জন্য সাধারণত হাতের আংটি এবং গলার চেইনের ব্যবহার দেখা যায়। বিয়ে বাড়ি সাজানোর জন্য অতীতে নানা প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করা হতো। সেসময় কলাগাছ এবং দেবদারু গাছের পাতা দিয়ে বাড়ির প্রধান ফটকে বড় তোরণ নির্মাণ করা হতো। কখনো সৌখিনতার মাপকাঠি অনুযায়ী বাড়ির যুবক বয়সীরা বাঁশ কেটে তা দিয়ে সুন্দর করে বেড়া তৈরি করে নকশাদার ফটক তৈরি করতেন। এছাড়া বাড়ি সাজানোর উপকরণ হিসেবে কাগজের ফালি বানিয়ে তা দিয়ে রিং তৈরি করে একপ্রকার কাগুজে-শিকল তৈরি করে তা দিয়ে বাড়ি সাজানো হতো। কিন্তু ধীরে ধীরে এই আয়োজন বাড়ির গন্ডি ছাড়িয়ে ‘ডেকোরেটর’ নামক বাণিজ্যিক সংগঠনের হাতে ন্যস্ত হয়েছে। সাধারণত ডেকোরেটর প্রতিষ্ঠানের লোকজন বাড়ির প্রধান ফটকে বাঁশ ও রঙিন কাপড় দিয়ে একটি গেট বা তোরণ নির্মাণ করেন।
কনেপক্ষ বা কন্যাপক্ষ, বাংলাদেশের বিয়েতে একটি নিষ্ক্রীয় অংশ। সাধারণত কনেপক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া হয় না। তবে দেয়ার প্রয়োজন হলে সাধারণত ‘ঘটক’ নামক তৃতীয় পক্ষের শরণাপন্ন হতে দেখা যায়। গ্রামাঞ্চলে এখনও ঘটক নামের পেশা টিকে আছে। ঘটক মূলত একজন ব্যক্তি, যিনি বর এবং কনেপক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করেন এবং বিয়েকে শেষাবধি সুসম্পন্ন করার জন্য পরিশ্রম করেন। ঘটকের এই কাজকে ঘটকালি বলা হয়। ঘটকালি সবসময়ই একটা ব্যবসা নয়, বরং ক্ষেত্রবিশেষে একটি সামাজিক বা পারিবারিক দায়িত্বও হয়ে ওঠে। যদিও অনেকে একে ব্যবসা হিসেবে নিজের পেশা করে নিয়েছেন। বাংলাদেশে, ঘটক পাখি ভাই ঘটকালিতে বিশেষ সুনামধারী একজন ব্যক্তি, যিনি ১৯৭৩ সাল থেকে এই ব্যবসায়ের সাথে জড়িত। বাংলাদেশের সমাজে ব্যবসায়িক ঘটকালির ব্যাপারটা ঘটে অনেকটাই লোকচক্ষুর আড়ালে, গোপনে। তা ছাড়া ঘটকালির মাধ্যমে যারা বিয়ে করেন তারা প্রায় কেউই বিয়ের আগে বা পরেও এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে চান না। ঘটকালির কাজটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঘুরে ঘুরে করতে হলেও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে অনেকেই ঘটকালির কাজটিকে ইন্টারনেটভিত্তিক করে নিচ্ছেন।
যশোরে পালকি নিয়ে বিয়ে করতে গেলেন বর...
পালকি চলে! পালকি চলে! গগন তলে আগুন জ্বলে! স্তব্ধ গাঁয়ে আদুল গাঁয়ে যাচ্ছে কারা রুদ্র সারা! সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘পালকির গান’ কবিতাটি গ্রামবাংলার ঐতিহ্য পালকির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। একটা সময় ছিল, যখন গ্রামবাংলা এমনকি শহরের বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে পালকি চাই-ই চাই। যেন পালকি ছিল এক অভিজাত্যের প্রতীক। নারীদের আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে জড়িত ছিল পালকি। আর পালকি ছাড়া তো গ্রামের বিয়ে কল্পনা করা যেত না। পালকি সাধারণত তিন ধরনের ছিল সাধারণ পালকি, আয়না পালকি এবং ময়ূরপঙ্খী পালকি। সাধারণ পালকি ছিল আয়তকার। চারিদিকে কাঠ দিয়ে আবৃত এবং ছাদ ঢালু।
এর দুই দিকে দুটি দরজা থাকত। আয়না পালকিতে আয়না লাগানো থাকত। ময়ূরপঙ্খী ছিল আয়তনে সবচেয়ে বড়। এর ভেতর বসার জন্য পালঙ্কের মতো আসনও করা হতো। পালকিগুলোতে পাখি, পুতুল, লতাপাতা ও আকর্ষণীয় কারুকার্য নকশা করানো থাকত। এবার সেই পালকিতে চড়ে কনের বাড়িতে গেলেন বর। তিনি যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার নির্বাসখোলা ইউনিয়নের সাদিপুর গ্রামের গণেশ কুমার মন্ডলের মেজো পুত্র।
পৃথিবী বদলে গেছে, রাজাদের রাজত্ব গেছে, গেছে জমিদারের জমিদারিও। যানবাহনে এসেছে বিবর্তন। রেলগাড়ি, মোটরগাড়ি, রিক্সা ইত্যাদি কত রকমের যানবাহন গ্রাম-শহরের পথে পথে। এসব যানবাহনে ধনী-গরিব সবাই চলাচল করতে পারেন। ইতিহাসের দায় মিটিয়ে তাই হারিয়ে গেছে পালকি। শেষ হয়েছে কাহারদের রোদে পোড়া, বৃষ্টিতে ভেজা কষ্টের জীবন। পালকির স্থান এখন ইতিহাসের পাতায়, সিনেমার পর্দায় আর জাদুঘরে। বেয়ারাদের হরতাল কলকাতার ইতিকথায় যোগ করে রেখেছে এক প্রতিস্পর্ধী আখ্যান।
সাজেদ রহমান, যশোর