
‘মিষ্টি’ বাঙালির কাছে প্রিয় ও লোভনীয় একটি ঐতিহ্যবাহী খাদ্যপণ্য
‘মিষ্টি’ বাঙালির কাছে প্রিয় ও লোভনীয় একটি ঐতিহ্যবাহী খাদ্যপণ্য। সেই আদিকাল থেকেই চলে আসছে মিষ্টির প্রচলন। যে কোনো উৎসব, বিয়ে বাড়ি, আত্মীয়স্বজনের বাড়ি কিংবা অনুষ্ঠান পালা-পার্বণে মিষ্টি না হলে যেন বাঙালির চলেই না। মিষ্টি নিয়ে বাঙালি জাতির যতটা আদিখ্যেতা-আহ্লাদ, বোধকরি আর কোনো জাতি তা করে না। কুষ্টিয়া ঐতিহ্যবাহী একটি জেলা। মুক্তিযুদ্ধে এ জেলার রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।
এ জেলার মাটিতে জন্মেছেন ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত সাংবাদিক-সাহিত্যিক কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, অমর কথাসাহিত্যিক ‘বিষাদ সিন্ধু’র রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেন, বিপ্লবী বাঘা যতিন, বিশিষ্ট কবি ও গীতিকার আজিজুর রহমান, জনপ্রিয় উপন্যাসিক আকবর হোসেন এবং মহিলা সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ জোবেদা খানমসহ অনেক কবি-সাহিত্যিক। বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের দেশ এই কুষ্টিয়া।
আউল-বাউল ও পীর ফকিরের এক তারার সুর মূর্ছনা আর পদ্মা-গড়াই বিধৌত এ জেলার মাটি হয়েছে ধন্য। তাই কুষ্টিয়াকে সাংস্কৃতিক জনপদও বলা হয়। সাংস্কৃতির পাশাপাশি এ জেলার দই, ঘি ও হরেক রকমের মিষ্টিরও খ্যাতি রয়েছে। কুষ্টিয়া শহরে রয়েছে বেশকিছু নতুন-পুরনো প্রসিদ্ধ মিষ্টির দোকান। এসব দোকানে বিক্রিও হয় প্রচুর। এদের মধ্যে জগদীশ মিষ্টান্ন ভা-ার, অশোক দধি মিষ্টান্ন ভা-ার, মৌবন সুইটস, কুমারখালী উপজেলার রমেশ দধি ও মিষ্টান্ন ভা-ার, মিরপুর উপজেলার আশীষ সুইটস অন্যতম।
এসব দোকানে তৈরি বাহারি সব মিষ্টি যেমন স্বাদে, তেমন বৈচিত্র্যে অতুলনীয়। তবে শহরের এসব মিষ্টির কথা নয়। বংশপরম্পরায় তিন পুরুষ ধরে মিষ্টির ব্যবসা করছে এমন একটি দোকানের খোঁজে রয়েছে কুষ্টিয়া থেকে ১৬ কিমি দূরে মিরপুর উপজেলায়। এখানে নতুন বাজার এলাকায় রয়েছে ‘আশীষ সুইটস’। যারা মিষ্টির গুণগতমান বজায় রেখে তিন পুরুষ ধরে আজও এ ব্যবসায় টিকে রয়েছে। ধরে রেখেছে অর্ধশত বছরের পুরনো ঐতিহ্য।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একাত্তরের পর মিরপুর উপজেলার নতুন বাজার এলাকায় শিঙ্গাড়া, জিলাপি বিক্রির পাশাপাশি ছোট পরিসরে মিষ্টির দোকান প্রতিষ্ঠা করেন রঘুনাথ পাল। তিনি মারা গেলে এ ব্যবসার হাল ধরেন তার ছেলে রমেশ কুমার পাল। তিনিও প্রয়াত হলে এ মিষ্টির দোকানের মালিক হন তার ছেলে কামনাশীষ পাল। বর্তমানে কামনাশীষ পাল এ ব্যবসায় তৃতীয় পুরুষ। তিনি গত ১০/১২ বছর ধরে ‘আশীষ সুইটস’ নামে এ প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করে আসছেন।
কামনাশীষ পাল বলেন, মিষ্টির এ কারবার আমাদের পৈত্রিক তিন পুরুষের ব্যবসা। অর্ধশত বছর ধরে বংশপরম্পরায় আমরা এ ব্যবসা চালিয়ে আসছি। দেশ স্বাধীনের পরেই প্রথমে এখানে মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন দাদা রঘুনাথ পাল। পরে তার থেকে আমার বাবা রমেশ কুমার পাল ব্যবসার দায়িত্ব নেন। ওই সময় এলাকায় তেমন মিষ্টির দোকান ছিল না। আস্তে আস্তে আমাদের মিষ্টির সুনাম দিগি¦দিক ছড়িয়ে পড়ে। বাপ-দাদার হাত ধরে শুরু হওয়া সেই মিষ্টির ব্যবসা আমরা আজও আঁখড়ে ধরে রয়েছি।
ওই সময় তারা যেভাবে মিষ্টি বানিয়ে গেছেন বা কৌশল শিখিয়ে গেছেন। বর্তমানে আমরাও সেভাবেই মিষ্টি তৈরি করছি এবং মিষ্টির গুণগতমানও বজায় রেখেছি। তিনি বলেন, এ অঞ্চলের অতি সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনায় রেখে আমরা সাধারণ ধরনের মিষ্টিই বেশি তৈরি করি। যেমন- রাজভোগ, চমচম, কমলাভোগ, রসোমালাই, প্যারাসন্দেশ, কাটারিভোগ, ছানারজিলাপি ও কাঁচাগোল্লা। এ ছাড়া তৈরি হয় মনপুরা চমচম, রস কদম্ব, পানিতাওয়া রাজভোগ।
এর মধ্যে খাঁটি দুধের ছানা ও চিনি দিয়ে তৈরি করা প্যারাসন্দেশ ও রসমালাই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। খেজুর গুড়ের সন্দেশও পাওয়া যায় এখানে। তবে এটি বানানো হয় শীত মৌসুমে। আর কিছুদিন পরেই তৈরি হবে এটি। খাঁটি দুধের তিন আইটেমের দইও এখানে পাওয়া যায়। দই এর মধ্যে স্পেশাল সাদা দইয়ের চাহিদা সচেয়ে বেশি।
প্যারাসন্দেশ, রসমালাই, ছানারজিলাপি ও দই তৈরিতে ব্যবহার করা হয় গরুর খাঁটি দুধ। এ দুধের সরবরাহ আসে তার নিজস্ব গরুর খামার থেকে। কথা হয় মিরপুর উপজেলা প্রেসক্লাবের সাবেক সভপতি ও দৈনিক গ্রামের কাগজের জেলা প্রতিনিধি বাবলু রঞ্জন বিশ^াসের সঙ্গে। তিনি বলেন, আশীষ সুইটস তিন পুরুষের ঐতিহ্যবাহী একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। অর্ধশত বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি সুনামের সঙ্গে মিষ্টি উৎপাদন ও সরবরাহ করে আসছে।
বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানসম্মত মিষ্টি তৈরির ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটছে। এ কারণে মিষ্টির দাম কম-বেশি হওয়া নিয়ে কখনো কখনো কিছু খরিদ্দারের সঙ্গে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাও ঘটে। যদি দ্রব্যমূল্য একটু সহনীয় পর্যায়ে থাকে সেই ক্ষেত্রে মিষ্টির মান আরও সুন্দর করাসহ বিভিন্ন জায়গায় তা সরবরাহ হতে পারে। তিনি বলেন, আশীষ সুইটসের মিষ্টি শুধু মিরপুরেই নয়, বৃহত্তর কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়। আশীষ সুইটসের স্বত্বাধিকারী কামনাশীষ পাল আরও জানান, এখানে তৈরি করা মিষ্টি বা দইয়ে কোনো প্রকার লোভনীয় কৃত্রিম রং বা কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না। এগুলো সব ন্যাচারালভাবে তৈরি। তবে দইয়ে সামান্য পরিমাণ পাউডার দুধ ব্যবহার করা হয়।
সরেজমিন দেখলাম, কুষ্টিয়া শহরের বড় বড় সব হাইফাই ডেকোরেশনের মিষ্টির দোকানগুলোর মতো ‘আশীষ সুইটস’সের তেমন জৌলুস নেই। ছোট পরিসরের একটি দোকান। শোরুম ও কারখানা একই সাঙ্গে। তবে বেচা-বিক্রি বেশ ভালোই। ক্রেতাদের অধিকাংশই সাধারণ মানুষ। কেউ দোকানে বসে পছন্দের মিষ্টি খাচ্ছেন। আবার কেউ মিষ্টির প্যাকেট হাতে ঝুলিয়ে বাড়ি কিংবা আত্মীস্বজনের বাড়ি যাচ্ছেন।
আশিষ সুইটস ভা-ারের অনন্য স্বাদের এসব মিষ্টির দাম তুলনামূলক একটু কম হওয়ায় ক্রেতাদের চাহিদা ও আগ্রহ একটু বেশি। দোকান মালিক জানান, বর্তমানে সানা ও চিনিসহ মিষ্টি তৈরির কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। মিষ্টি তৈরি ও বিক্রির ওপরও এর প্রভাব পড়ছে। তিনি নিয়মিত চারটি ঘোষের কাছ থেকে ছানা সংগ্রহ করেন। এসব ঘোষ গ্রামে গ্রামে ঘুরে গরুর দুধ সংগ্রহ এবং বাড়িতে ছানা তৈরি করে দোকানে সরবরাহ করেন। বাকি দুধ ও ছানার জোগান আসে তার নিজস্ব ‘আশীষ ডেইরি ফার্ম’ থেকে।
কামনাশীষ পাল সাত বছর আগে মিরপুরের পালপাড়া গ্রামে নিজ বাড়িতে এ ফার্ম গড়ে তোলেন। ফার্মে বর্তমানে ১৫/১৬টি দুগ্ধ গাভী রয়েছে। ফার্ম থেকে প্রতিদিন ৫০/৬০ লিটার দুধ সংগ্রহ করেন তিনি। তার প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ কেজি ছানার কাজ হয়। দোকানে কর্মসংস্থান রয়েছে ৮ কর্মচারীর। বিদেশ ফেরত এলাকার প্রবাসী মানুষজন বিদেশে যাওয়ার সময় আষীশ সুইটসের মিষ্টি নিয়ে যান। অনেকে আবার বিদেশ থেকে তাদের মাধ্যমে অর্ডার দিয়ে মিষ্টি সংগ্রহ করেন।
তবে বিদেশে অনন্য স্বাদের প্যারাসন্দেশটি সবচেয়ে বেশি চলে। এখানে মিষ্টি বিক্রি হয় প্যারাসন্দেশ সাড়ে ৪শ’, রসমালাই ৪শ’ কাটারিভোগ সাড়ে ৪শ’, চমচম ৩শ’, রাজভোগ ২৮০ ও ছানারজিলাপি ২৪০ টাকা প্রতি কেজি দরে। দোকান মালিকরা তিন ভাই-বোন। কামনাশীষ পাল, দেবাশীষ পাল ও তপতী রানী পাল। মিরপুর উপজেলার পালপাড়া গ্রামে তাদের বাড়ি। দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার মিরপুর প্রতিনিধি মারফত আফ্রিদী জানান, আশীষ সুইটসের মিষ্টির কোয়ালিটি বেশ ভালো। তাদের তিন পুরুষের মিষ্টির ব্যবসা। আশীষ সুইটস একটু ব্যতিক্রম এবং মানসম্মত মিষ্টি তৈরি করে। তাদের গরুর নিজস্ব ফার্ম রয়েছে। এই ফার্মের দুধ দিয়েই তারা মিষ্টি ও দই তৈরি করেন। তাদের দইয়ের কোয়ালিটিও বেশ ভালো।
এমএ রকিব, কুষ্টিয়া