
পর্যটকরা নিজ হাতে হরিণদের খাওয়াচ্ছেন
পৃথিবীর সেরা ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের কথা মনে হলে যে প্রাণীটির নাম সর্বপ্রথম সবার চোখে ভেসে ওঠে তা হলো মায়াবী চিত্রল হরিণ। প্রকৃতিদেবী সুন্দরবনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে এ প্রাণী। প্রতিবছর হাজার হাজার প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণে আসেন সুদর্শন হরিণের দেখা পেতে। বনে প্রবেশ করে সচরাচর বাঘের দেখা না পেলেও হরিণের দেখা থেকে বঞ্চিত হন না পর্যটকরা। সকাল বেলা এবং পড়ন্ত বিকেলে বনের নদী-খালের প্রশস্ত তীরে প্রায়ই হরিণের দেখা মেলে। দূর থেকে মানুষের শব্দ পেলেই ঘন বনে লুকোবার চেষ্টা লাজুক এ প্রাণীটির।
তবে বনের সব এলাকার হরিণের বৈশিষ্ট্য এক রকম নয়। গভীর বনের হরিণগুলো খুবই বন্য স্বভাবের হয়ে থাকে। কোথাও মানুষের দেখা পেলে কিছুক্ষণ মায়াবী দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে নিমেষেই চোখের আড়াল হয়ে যায়। আবার অফিসসংলগ্ন বনের কাছাকাছি বা পর্যটন অধ্যুষিত এলাকায় হরিণ, বানর ও শুকরের আনাগোনা চোখে পড়ার মতো। পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের সুপতি, কচিখালী, কটকা, কোকিলমুণি, দুবলা অফিস পাড়ায় অসংখ্য হরিণ বনরক্ষীদের পাশাপাশি বিচরণ করতে দেখা যায়। মানুষের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সখ্য দেখা যায় কটকার অভয়ারণ্য এলাকার হরিণের। সুন্দরবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট হচ্ছে কটকা। সুন্দরবন ভ্রমণে এসে কটকার দেখা না পেলে অসম্পূর্ণ থেকে যায় ভ্রমণ। এখানকার দূরন্ত মায়ামৃগ পর্যটকদের হাতের খাবার খেয়ে থাকে। আর দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসা পর্যটকরা তাদের স্বপ্নের মায়াবী চিত্রল হরিণগুলোকে নিজেদের হাতে খাবার খাওয়াতে পেরে ধন্য মনে করেন। সকাল বেলা কেওড়াপাতার ডাল হাতে যে কোন পর্যটক কটকার সী-বীচ সংলগ্ন ট্রেইলের কাছে গেলে সহসা ধরা দেয় হরিণের পাল।
খুব সতর্কতার সঙ্গে পর্যটকদের হাতের খাবার খেয়ে নেয় দ্রুত। হাতে করে খাবার খাওয়ানোর ইচ্ছায় প্রতিবছর বহু পর্যটক ভিড় করেন কটকায়। জানা যায়, ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিমি অধ্যুষিত ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনে দুই প্রজাতির হরিণ রয়েছে। মায়া হরিণ ও চিত্রা হরিণ। মায়া হরিণ মানে মা হরিণ। পুরুষ হরিণের মাথায় এক জোড়া শিং থাকে। এ হরিণেরা দিবাচর ও নিশাচর প্রাণী। হরিণের শরীর লালের ওপর সাদা ফোঁটার নিপুণ কারুকাজ। কেওড়াপাতা, ঘাস, লতাপাতা ও ফলমূল প্রধান খাদ্য এদের। এক-দুই বছরেই যৌনতাপ্রাপ্তি ঘটে হরিণের।
সাত-আট মাস গর্ভ ধারণের পর একটি কখনও বা দুটি বাচ্চা প্রসব করে হরিণ। হরিণ সুন্দরবনের সর্বত্র বিচরণ করে থাকে। তবে কোথাও কোথাও এর আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। হরিণ সাধারণত দল বেঁধে চলতে এবং স্যাঁতসেতে ঠা-া জায়গায় বসবাস করতে পছন্দ করে বেশি। এরা রাতের বেলা উঁচু ও পরিষ্কার জায়গায় বৃত্তাকার হয়ে ঘুমায়। বলা হয়ে থাকে বাঘের আক্রমণের ভয়ে এমন করে ঘুমায় তারা। চিত্রা হরিণ উচ্চতায় আড়াই থেকে তিন ফুট হয়ে থাকে। এর এক একটির ওজন এক থেকে তিন মণ পর্যন্ত হয়। শরণখোলা জেএসএল গ্রীন ট্যুরিজমের পরিচালক আমিনুল ইসলাম সাগর জানান, সুন্দরবনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ মায়াবী চিত্রল হরিণ। খুব কাছ থেকে বনের হরিণ দেখার জন্য মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে সাগরতীরবর্তী কটকা, দুবলা ভ্রমণ করে থাকেন। বাঘ, হরিণ দেখার জন্য সব সময় তটস্থ থাকে পর্যটকদের উৎসুক চোখ। খুব সহজেই বাঘের দেখা মেলে না। অবশেষে হরিণ দেখে বড়জোর হরিণকে হাতে খাবার খাইয়ে তৃপ্ত হতে হয় তাদের।
পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জ কর্মকর্তা শামসুল আরেফীন জানান, সুন্দরবনে অভয়ারণ্য বৃদ্ধি ও আবাস্থলের উন্নয়ন ঘটায় বন্যপ্রাণীর প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই ধরাবাহিকতায় হরিণের সংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। বনে প্রবেশ করলেই যার প্রমাণ পাওয়া যায়।
বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ সুন্দরবন বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) নির্মল পাল জানান, সাধারণত পর্যটন এলাকার বন্যপ্রাণীরা মানুষ দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে মানুষের কাছাকাছি আসতে শেখে। তাদের মাঝে এক প্রকার আস্থার সৃষ্টি হয় যে, মানুষ তাদের ক্ষতি করবে না। তাই তারা হাতের খাবার নিয়ে খেতেও দ্বিধা করে না।
নজরুল ইসলাম আকন, শরণখোলা, বাগেরহাট