ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ফিরাতে হবে করোনায় ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের

প্রকাশিত: ২১:০২, ৩০ নভেম্বর ২০২১

ফিরাতে হবে করোনায় ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের

করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের শিক্ষা কার্যক্রম। প্রায় ১৮ মাস বন্ধ থাকার পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। ১২ সেপ্টেম্বর থেকে কলকাকলিতে মুখরিত জ্ঞানচর্চার আঙিনাটি। প্রায় দেড় বছর কেটেছে অবরুদ্ধতার কঠিন জালে, করোনা সংক্রমণের ভীতিতে। প্রতিদিনের শিক্ষা পাঠক্রম চলেছে প্রযুক্তির মাধ্যমে, শিক্ষার্থীদের এটি ছিল অন্যরকম পথচলা। প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতার অভাব এবং অপ্রচলিত পন্থায় সত্যিই হিমশিম খাওয়ার অবস্থা। শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়েই এমন পাঠক্রমের সঙ্গে পরিচিত এবং অভ্যস্ত ছিল না। বাস্তবতা হচ্ছে এখনও প্রযুক্তির আঙিনাকে সবক্ষেত্রে অবারিত করা যায়নি। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। সঙ্গত কারণে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা পড়ে বিব্রতকর অবস্থায়। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রীরা নতুন এই পদ্ধতির পাঠ গ্রহণে হিমশিম খেয়েছে। বাংলাদেশের সিংহভাগ শিক্ষার্থী বাস করে গ্রামেগঞ্জে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে। যাদেরকে বর্তমান সরকার অনেক সহযোগিতায় শিক্ষা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করেছে। দরিদ্র শিক্ষার্থীর ঘরে টিভি থাকলেও তথ্যপ্রযুক্তির ঘাটতিতে পাঠক্রম কোনভাবেই অবাধ থাকেনি। তার চেয়েও দুঃখজনক, হতদরিদ্র অনেক শিক্ষার্থীর ঘরে টিভি পর্যন্ত নেই। তারা পাঠদান কার্যক্রমের সঙ্গে বিযুক্তই ছিল। করোনার সংক্রমণে সারাদেশের ওপর যে স্থবিরতার আবরণ পড়ে সেখান থেকেও মুক্ত হওয়া ছিল অনধিগম্য এক যাত্রাপথ। বিশ্ব শিশু সংস্থা ইউনিসেফ এবং বাংলাদেশের বহুজাতিক সংস্থা ব্র্যাক এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করে। সেখান থেকে যে তথ্য বেরিয়ে আসে তা যেমন আশঙ্কাজনক একইভাবে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যও চরম দুঃসংবাদ। জাতি গঠনে এইসব উদীয়মান নির্মাতা শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে। দরিদ্র পিতামাতা কন্যা সন্তানকে বাল্যকালে বিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। শিশু পুত্রসন্তানকে শ্রমের বাজারে সম্পৃক্ত করে আর্থিক দৈন্য ঘোচানোর চেষ্টায় লিপ্ত। ইউনিসেফ বৃহত্তর এশিয়ার ওপর এই গবেষণা চালায়। শিশু বিষয়ক এই বিশ্ব সংস্থাটি সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছে, দারিদ্র্য যে হারে বাড়ে শিশুশ্রম বৃদ্ধি পায় তার ৪ গুণ। ব্র্যাকের গবেষণায়ও উঠে আসে শিশু শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার চাইতেও ভয়ঙ্কর অবস্থা পাঠদানের ক্ষেত্রে। অনেক শিশু অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধরতেই পারছে না। যাদের ঘরে টিভি কিংবা ইন্টারনেট নেই তাদের অবস্থা তো বলারই অপেক্ষা রাখে না। যারা টিভি এবং প্রযুক্তির পর্যাপ্ততায় অংশগ্রহণে সক্ষম হচ্ছে তারাও এই পাঠদান সেভাবে নিতে পারছে না। ব্র্যাক তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, প্রধানত যথেষ্ট মনোযোগের অভাবে শিক্ষার্থীকে নতুন এই কার্যক্রমে তেমন উৎসাহ পেতে বেশ কিছু সময় ব্যয় করতে হবে। ১২ সেপ্টেম্বর থেকে শিক্ষাঙ্গন তার প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমে ফিরে এসেছে। এক্ষেত্রে কেবল নগর, শহর আর বন্দরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মুখরিত হয়েছে। অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন ঘরের সন্তানরা দেশের এসব স্থানে বাস করে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিচারে গ্রাম, গঞ্জে, অজপাড়াগাঁয়ে দরিদ্র পিতামাতার সন্তানের অনেকেই এখনও স্কুল পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। তথ্য সূত্রে উঠে আসে কন্যাসন্তানেরা বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে, যা প্রতিরোধে এখনও লড়াই চলছে। করোনাকাল তাকে অতি সহজেই বালিকাদের জন্য অবারিত করে দিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবার জন্য শিক্ষার দ্বার উন্মোচনে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছেন। আশানুরূপ সফলতাও এসেছে। যার কারণে ২০১৭ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সমতাভিত্তিক ১৫০টি দেশের মধ্যে ৪৮তম আর দক্ষিণ এশিয়া শীর্ষস্থানে। সেখানে চমৎকৃত হওয়ার বিষয়টি প্রাথমিক শিক্ষা সূচকে ছেলেমেয়ের এক সঙ্গে বিচার-বিবেচনায় বাংলাদেশে বিশ্বে নজরকাড়া। একেবারে শীর্ষে। সেটাও বঙ্গবন্ধু কন্যার অবিস্মরণীয় কার্যক্রমের অভাবনীয় অর্জন। বাংলাদেশ করোনাকে মোকাবেলা করতে উন্নয়নের অন্যান্য সূচকের ক্ষতি পুষিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু ভবিষ্যত কর্ণধারদের শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ক্রমাগত বিচ্যুতির ক্ষতি কিভাবে সামাল দেবে? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে যাবার পর নতুন যে দুঃসহ চিত্র তা সত্যিই উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার বিষয়। নবেম্বর থেকে শুরু হওয়া মাধ্যমিক পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বিবেচনায় আরও ঝরে পড়ার তথ্যে হতভম্ব হওয়ার মতোই। ৮০ হাজারের মতো নিবন্ধন করা ছাত্রছাত্রী পরীক্ষায় বসতেই পারেনি। তথ্য-উপাত্তে দৃশ্যমান হয় ছাত্রীরা বিয়ের পর এখন সংসারধর্ম পালনে মহাব্যস্ত। আর ছাত্ররা নতুন হরেক রকম কর্মযোগে নিজেদের তৈরি করার নতুন পথে। শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা আগেই অনুমান করেছিলেন এমন অসহনীয় চিত্র স্বাভাবিকভাবে উঠে আসবে। এবারের পরীক্ষাটা সম্পূর্ণ নয়, আংশিক। শুধু বিভাগভিত্তিক বিষয়ের ওপরই তাদের মেধা ও মনন যাচাই করা হবে। মূল বিষয় বাংলা, অঙ্ক ও ইংরেজী ছাড়াই তাদের উত্তরণ পর্বের যোগ্যতা নির্ধারণ করা হবে। সেখানেও যে কেমন চমকপ্রদ ফল আসবে তা দেখার অপেক্ষায়। ইতোমধ্যে উচ্চশিক্ষার ভর্তি পরীক্ষার ফল অন্যান্যবারের তুলনায় বিস্ময়কর। বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মান যাচাইয়ের পরীক্ষায় শ্রেষ্ঠতম বিবেচিত হয়েছে। বুয়েটেও একই কলেজের ছাত্র অসাধারণ রেজাল্ট করেছে। প্রতিবছর যেখানে নটর ডেম, ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতার শীর্ষে থাকত। করোনা অনেক কিছুর মধ্যেই ব্যতিক্রমী চিত্র হাজির করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েটের পরীক্ষা এতই প্রতিযোগিতামূলক যে সেখানে রাজধানীর শিক্ষার্থীরাই সব সময় এগিয়ে থাকে। বাংলাদেশের গুচ্ছ পরীক্ষায়ও ফলের চিত্রে অন্য রকম মেধা ও মননের বিকাশ দেশের জন্য শুভ সংকেত। কারণ বাংলাদেশকে সমান তালে এগিয়ে যেতে হবে। সমৃদ্ধির জোয়ারে কেউ যেন পিছিয়ে না পড়ে সেটাও উন্নয়নের অবধারিত লক্ষ্যমাত্রা। করোনাকালে ছাত্রছাত্রীর ঝরে পড়া নিয়ে শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন- আগের চেয়ে বেশি প্রণোদনা বাড়ানো জরুরী। কারণ প্রতিবছর ক্ষুদে প্রজন্মরা তৈরি হয় শিক্ষা কার্যক্রমের সূচনা করতে। যারা ঝরে পড়েছে তাদের ফিরিয়ে আনা সহজ না হলেও চেষ্টা করতে হবে। যেসব মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে তাদের শ্বশুর পক্ষকে বোঝাতে হবে। যেসব ছেলে বই-খাতা ফেলে কাজে যোগ দিয়েছে তাদের কথা বলতে হবে অভিভাবকদের সঙ্গে। যারা এখনও শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে তাদের দিকে নজর দিতে হবে। নতুন যারা বিদ্যালয়ে প্রবেশ করবে তাদের ব্যাপারে প্রাসঙ্গিক কার্যক্রম হাতে নেয়া অত্যন্ত জরুরী। বিন্দুমাত্র গাফিলতি নতুন কোন বিপর্যয়কে ভয়াবহ করে দিতে পারে। সেখানেও কঠোর পর্যবেক্ষণে আগামীর ভবিষ্যত যেন নতুন যাত্রাপথে বাধা-বিপত্তিকে সহজভাবে পাশ কাটাতে পারে। শিক্ষা শুধু মৌলিক অধিকার নয়, এটা সর্বজনীন হওয়া ছাড়া মানসম্মত শিক্ষা উপহার দেয়া বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হওয়া। কর্তৃপক্ষকে এসব বিচার, বিবেচনায় এনে সবার জন্য শিক্ষা সহজতর এবং বাধ্যতামূলক করতে হবে। উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা কোন্ পর্যায়ে তাদের নিয়মিত পাঠক্রম চালাতে পারছে সেটাও বিবেচনার দাবি রাখে। একসময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে মাত্রায় সেশনজটে আটকে থাকত সেটাও এক দুঃসহ ব্যাপার। শিক্ষার্থীদের চাকরির বয়স পেরিয়ে যাওয়ার সঙ্কটও মোকাবেলা করতে হতো। গত কয়েক বছরে তারা মোটামুটি সেশনজটকে সামনে নিয়মিত পর্যায়ে তাদের অবস্থান মজবুত করেছিল। সেখানেও নতুন করে সেশনজটের আবর্তে পড়বে কিনা তেমন আশঙ্কা থেকেই যায়। তারা শিক্ষা কার্যক্রমে অনলাইনভিত্তিক পাঠ নিয়েছে। সেটাও সব সঙ্কটের উর্ধে নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রায় দেড় বছর প্রাতিষ্ঠানিক বলয় থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। এখানেও প্রযুক্তির বলয়ের ব্যাপারটি প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ, করোনার চরম দুর্বিপাকে হলসমূহ বন্ধ হয়ে গেলে অগণিত ছাত্রছাত্রী বাড়ি ফিরে যায়। গ্রামেগঞ্জের শিক্ষার্থীও খুব কম নয়। প্রযুক্তিতে তারা দক্ষ এবং অভিজ্ঞ সন্দেহ নেই। যেহেতু ইতোমধ্যে তারা বিদ্যাশিক্ষার সর্বোচ্চ পাদপীঠে পড়াশোনা করার যোগ্যতা অর্জন করেছে। কিছু সময় নিয়মিত ক্লাসও করেছে ১ম বর্ষের শিক্ষার্থীরা। তাদের সক্ষমতার ঘাটতি ছিল না। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ বিস্তারে হরেক রকম প্রতিবন্ধকতা ছিল ধারণা করা অমূলক নয়। সঙ্গত কারণে উচ্চশিক্ষার শিক্ষার্থীদেরও প্রযুক্তির মাধ্যমে পাঠ গ্রহণ সেভাবে অবারিত হয়নি। সমস্যাগুলো তাদেরও সামলাতে হয়েছে। জ্ঞানচর্চার এমন সব সঙ্কট নিয়ে তাদেরও দুঃসহ সময় পার করতে হয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় প্রাক প্রাইমারী থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে সবাই কোন না কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সময়ের অনিবার্যতায় তা কতখানি কাটানো যাবে সেটা অনেকটা নির্ভর করছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ওপর। সতর্কতার সঙ্গে শিক্ষার মতো সমৃদ্ধ ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেয়া জরুরী। বর্তমান সরকারের অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় জাতি তার সমূহ বিপর্যয় থেকে ঠিক বের হয়ে আসবে। শুধু শিক্ষা কার্যক্রম তার বড় ধরনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কিছুটা হিমশিম খাবে। উন্নয়ন যখন দৃশ্যমান সেখানে প্রাসঙ্গিক সব ব্যবস্থাপনাই গতি ফিরে পায়। শিক্ষা কার্যক্রমের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হবে না, আশা করাই যায়। তবে জ্ঞানচর্চার বিষয়টি একেবারেই অন্য রকম। ত্রুটিবিচ্যুতি থেকে সহজে বের হওয়া কঠিন। পড়াশোনার প্রতি শিক্ষার্থীদের অনেক বেশি মনোযোগী হতে হবে। বিদ্যাশিক্ষার এই জগতে নিজেকে সমর্পণ করা ছাড়া আর কোন পথ নেই। কঠোর পরিশ্রম আর নিরলস সাধনায় নিজেকে সব কিছুর উপযোগী করে তুলতে পেছনের দিকে তাকানো যাবে না। অনেক সময় অবকাশে, ঘরে বসে কেটে গেছে। করোনার দুঃসহ ছাপ মুছে ফেলতে সামনের দিকে তাকাতে হবে। বর্তমানে করোনাও সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছে। পরিস্থিতি অনেকটা স্বস্তিকর। চমৎকার এই সুবর্ণ সময়ে শিক্ষার্থীরা তাদের মূল পাঠক্রমে ফিরে যাবে। আধুনিক ও প্রযুক্তির নতুন বাংলাদেশ গড়তে তারাই হবে মূল স্থপতির ভূমিকায়। সারা জাতি তাকিয়ে থাকে দেশের আগামীর ভবিষ্যত শ্রেষ্ঠ সন্তানদের দিকে। যাদের হাতে দেশ গড়ার চাবিকাঠি থাকে। নিজেরাও উৎসাহ আর উদ্দীপনায় তৈরি হবে দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে। লেখক : সাংবাদিক
×