ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

দেশী টিকা-বিদেশী টিকা এবং তেঁতুল হুজুর কাণ্ড

প্রকাশিত: ২০:৫৮, ১৬ এপ্রিল ২০২১

দেশী টিকা-বিদেশী টিকা এবং তেঁতুল হুজুর কাণ্ড

এখন দেশে দক্ষিণ আফ্রিকার করোনাভাইরাসের তাণ্ডব চলছে। মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। দূরদর্শী প্রধানমন্ত্রী আগেই বিদেশী টিকা টাকা দিয়ে বুক করেছেন। পাশে ভারত থেকে টিকা উপহার হিসেবেও এসেছে। করোনায় মৃত্যু হার কমে এসেছিল। পাশাপাশি জীবন-জীবিকার কাজকর্মও চলছিল। মানুষ প্রায় স্বাভাবিক জীবন যাপন করছিল। জীবন যাপন স্বাভাবিক হওয়াতে বিশেষত মৃত্যু হার হ্রাস পাওয়াতে জাতি ও সরকারের পক্ষে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করা ও বিদেশী রাষ্ট্র নায়কদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু সুবর্ণজয়ন্তীর উৎসব শেষ হতেই মার্চের শেষে হঠাৎ করোনা আক্রান্ত ও করোনায় মৃত্যু পঞ্চাশের কাছে, তারপর দিন পঞ্চাশের ওপর, তারপর ষাট, ষাটের ওপর উঠে যেতে দেখে চিকিৎসক, গবেষক সবার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- যে টিকা এ্যাস্ট্রাজেনেকা-অক্সফোর্ড, মডার্না আবিষ্কার করেছে, সেগুলো তো দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টকে ব্যবহার করে প্রস্তুত হয়নি। তাহলে এই ব্র্যান্ডের কোটি কোটি ডোজ টিকা এই নতুন করোনাকে প্রতিহত করতে সক্ষম হবে কি? যদি হয়, কত পার্সেন্ট কার্যকারিতা এ ক্ষেত্রে দেখা যাবে? আগেও এ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাসহ সব টিকাই দুই ডোজ গ্রহণের পর বলা হয় ৮০% কার্যকর হতে পারে আগের নরম করোনার ক্ষেত্রে। এখন তো মনে হচ্ছে- টিকা নয়, ঐ মাস্ক, প্রয়োজনে ডাবল মাস্ক, বাড়ি এসে হাত মুখ ধোয়া বা গোসল করে ফেলা- এই দুই পদ্ধতিই সবচাইতে কার্যকর হবে। এই টিকা দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টকে প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে যেহেতু তৈরি হয়নি, তাহলে সে ক্ষেত্রে আমাদের দেশের যে টিকা উদ্ভাবিত হয়ে মানব দেহে পরীক্ষার অনুমোদনের জন্য অপেক্ষমাণ, সেটিকে প্রয়োজনে আরও একটু বর্তমানে ছড়িয়ে পড়া দক্ষিণ আফ্রিকান স্ট্রেনকে প্রতিরোধ করার উপযোগী করার কাজটি সম্পন্ন করা যায় নাকি? আমার মতে এটিই হবে সর্বোৎকৃষ্ট পদক্ষেপ। তাছাড়া, আমাদের এই টিকা এক ডোজের। যেটি এর প্রস্তুত প্রণালীর কারণে কোটি কোটি সংখ্যায় প্রস্তুতের জন্য অনেক বেশি সহজসাধ্য হবে। যেহেতু আমাদের দেশীয় টিকা এখনও প্রস্তুতির প্রক্রিয়ায় রয়েছে, সেহেতু এখন আমাদের পক্ষে এই টিকাতে নতুন ভ্যারিয়েন্টকেও প্রতিরোধ করার সক্ষমতা যুক্ত করার সুযোগ এখনও রয়েছে। এই সুযোগটিকে সঠিক সময়ে বুঝতে পারবেন প্রধানমন্ত্রী, এই আশা করছি। এবং দ্রুত আজকালের মধ্যে দেশী টিকা পরীক্ষার অনুমোদন দানের জন্য নির্দেশ দেবেন বলেও আশা করছি। টিকা বা ওষুধ বিশাল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কাক্সিক্ষত পণ্য, এটি জানি। আমরা সিরামের মাধ্যমে কম টিকা তো কিনিনি। বুকিং মানি এখনও দেয়া আছে। এবার তো অন্তত দেশী টিকাকে অনুমোদন দেয়া হোক। পৃথিবীর অন্য দেশের বিজ্ঞানীরা আশ্চর্য হচ্ছে যে, বাঙালী বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবনটি কেন পরীক্ষার জন্য এখনও সরকারী অনুমোদন পায়নি! ওরা তো জানে না, বাঙালীরই প্রাচীনকালের এক ধীসম্পন্ন নারী, খনা বলে গেছেন- ‘গেঁয়ো যোগী ভিখ্্ পায় না’- প্রবাদটি। বিদেশী যোগীকে আমরা প্রণাম করি, তার ভজনা করি, খাওয়া-দাওয়ার সব ভার নিই! বিদেশীর মূল্য আমাদের কাছে বেশি এখনও। আমি অবশ্য এখনও অটল হয়ে বসে আছি- দেশী টিকা কবে আসবে, তাই নেব বলে। এ কা- দেখে স্বজন-পরিজনদের বিস্ময় মিশ্রিত বকুনি, আশঙ্কা ইত্যাদি এ কানে ঢুকিয়ে ও কান দিয়ে বের করে দিয়ে বসে আছি। দেখি কি হয়। তবে মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, মাস্ক ধোয়া খুব নিয়ম মেনে করি। এত গরমে ফ্রিজের ঠা-া পানি মিশিয়ে খেয়ে গলা ব্যথা, সর্দি হয়ে গেল। জ্বর জ্বর ভাব। কি আর করি, আইভেরা, ডক্সিক্যাপ, নাপা, গলায় ভাপ গ্রহণ করলাম। সেরেছে বলা চলে। তবে বাইরে যাওয়া কমিয়েছি। ভুলে যাই বয়স। ছুটে বেরিয়ে যাওয়া, বাজার-হাট-ব্যাংক, চাকরিহারাদের সাহায্য করি। নানা প্রয়োজন মেটানোর কাজে অন্যের সাহায্য নিতে ভাল লাগে না। তাই কিছুটা তো করিই। কিছু বই আছে, কিছুদিন পরপর ঐ বই না পড়লে বুক হু হু করে। অথচ সে বইগুলোই হারিয়ে গেছে। মেয়েকে দিয়ে তার মধ্যের একটি বই- ‘দিদিমার হরফ শেখা’ বইটি মেলা থেকে পেয়ে গেলাম। আঃ! বুকটা ভরে গেল। তেমনি প্রিয় বাবার বইটা- ‘শেখ মুজিব তাঁকে যেমন দেখেছি’ বইটি। এত সহজ, সুন্দর বাংলায় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সুদর্শন, সজ্জন, সংস্কৃতিপ্রেমী, খেলাধুলাপ্রেমী পুত্র শেখ কামালের সংক্ষিপ্ত উজ্জ্বল চরিত্র চিত্রণ করেছেন একজন ইমাম-পুত্র, যার জন্য নিষিদ্ধ ছিল বাংলা পড়া-লেখা! যে ভাষা আমরা এখনও আয়ত্ত করতে পারিনি। আর, ‘মৃতের আত্মহত্যা’, কি অসীম সাহসে ভর করে জিয়াকে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করার শর্ত না রাখার প্রতিবাদে এক গল্প লিখলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে, জিয়ার উপদেষ্টা পদে থেকেই! শিশু রাসেলকে ঐ মুহূর্তে কল্পনা করি- বুকটা মুচড়ে ওঠে প্রতিবার, একইভাবে। যা হোক, প্রিয় বই অনেক। কৈশোর-যৌবনে বারবার পড়ে বুক ভরে যেত পথের পাঁচালী, অপরাজিত, আনা কারেনিনা, এ্যান ফ্রাংকের ডায়েরি, বিদায় অভিশাপ, রক্ত করবী, অরক্ষণীয়সহ কত কবিতা-গল্প বুকের ধন হয়ে উঠেছিল! এখনও হারিয়ে যাওয়া ‘পিতা-পুত্র’, ‘মানুষের মতো মানুষ’, ‘ইস্পাত’ মনে করে চোখে জল আসে। তবু, কয়েকটি বই ‘বাইশে শ্রাবণ’ বা ‘প্রথম শিক্ষক’, ‘উভচর মানুষ’ ‘মা’- রোজেনবার্গের চিঠি, ভ্যানগগের থিওকে লেখা চিঠি, চোখে জল আনে। বিস্মিত হয়েছি- বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারা জীবন- এর বাংলাভাষার এত উন্নত মান দেখে। তাঁর ইংরেজীও এত মানসম্পন্ন ছিল, ভাবা যায় না। যাক, টিকা থেকে প্রিয় বই প্রসঙ্গে চলে গেছি। কিন্তু তেঁতুল হুজুররাও তো এই বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ সোনার বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তূপ করতে নিরত। তাদের কথা না বললেই নয়। তাই বারবার বলি, বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্ম ও বৃদ্ধি ঘটেছে, তেমনি গোলাম আযম-নিজামী-সাঈদীদের হাতে জন্ম হয়েছে উগ্র মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী একদল দেশদ্রোহী মোল্লা ও জঙ্গী গোষ্ঠীর। সেই ছায়ানটের পহেলা বৈশাখের নববর্ষে বোমা হামলা করে তারা বাঙালীর সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানের জানান দিয়েছিল। এরপর কাজী আরেফ হত্যা, সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলা, উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, সাংবাদিক হত্যা থেকে বাংলা ভাই-আবদুর রহমান, পরে জেএমবির জন্ম দিয়ে তাদের হাতে একের পর এক প্রগতিশীল লেখক, কবি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তিবিদ, তরুণ ব্লগারদের হত্যা পর্যন্ত আমরা দেখতে পাই, সেই ’৭১-এর পরাজিত শক্তির হাতে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালীর অস্তিত্বের ওপর বারংবার আঘাত! বর্তমানে হেফাজত কর্তৃক সংঘটিত শাল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জুড়ে তা-ব-অগ্নিসংযোগে লুটপাটে আক্রান্ত হলো সেই একই আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বাসস্থান, সরকারের প্রশাসনিক অফিস ও নিরাপত্তা বাহিনীর থানা, অফিস, পাঠাগার, সঙ্গীতচর্চা কেন্দ্র এবং হিন্দু সম্প্রদায়! একই রকম তা-ব করল সোনারগাঁর রূপগঞ্জে একই চরিত্র! সেই ’৭১, সেই ২০০১-৬, সেই ২০১৩ থেকে ২০১৫ এবং ২০২১! সরকারের উচিত হবে, প্রথমেই সব মাদ্রাসার ভূমির জরিপ করে দেখতে হবে। হাজার হাজার মাদ্রাসার অধিকাংশ নিশ্চয় অন্যের বা সরকারী খাস জমি দখল করে নির্মিত। সেগুলোর ভূমি অবশ্যই দখলমুক্ত করতে হবে। এরপর তাদের আয়ের উৎস জানতে হবে। শুনছি, লন্ডন থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পেয়েছে হেফাজত উক্ত সব নাশকতা চালিয়ে প্রধানত সরকারকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ফেলার লক্ষ্যে! হেফাজত নেতা বাবুনগরী, মামুনুল হক ল-নের নির্দেশ পালন করেছে। অর্থ বেশি হলে যা হয় মামুনুল হকের রিসোর্টে ফুর্তি করায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এক হেফাজত নেতা তো নারীদের তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। সেটি সত্য প্রমাণ করেছে মামুনুল। আশা করি সরকার হেফাজতের সাম্প্রদায়িক, উগ্রবাদী, নাশকতাকারী নেতাদের বিচার ও আইনের আওতায় দ্রুতই আনবে। ওদেরকে উগ্রবাদী উস্কানিমূলক বক্তব্য দেয়ার জন্য অনেক আগেই গ্রেফতার ও বিচার করা উচিত ছিল। শাল্লা, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ধ্বংসযজ্ঞ থেকে ওদের হামলার লক্ষ্যবস্তু-ব্যক্তি-কারা, তা তো স্পষ্ট। আমরা মনে করি, আর সময় ক্ষেপণ না করে যারা শত্রু, তাদের শত্রু গণ্য করে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমেই এই দেশদ্রোহীদের দ-িত করে জাতিকে সুরক্ষা দিতে হবে। এদেরকে খোসামোদ করা বা কোনভাবে তুষ্ট করার নীতি পরিত্যাগ করতে হবে। দুধ-কলা দিয়ে সাপ পোষা যায় না! এরা তো একবার খালেদা, একবার জামায়াত, একবার তারেকের সুতার টানে নৃত্য করছে! এটা ভাবলে ভুল হবে- বঙ্গবন্ধু কন্যার সরকার ওদের প্রিয় বা পছন্দের হবে। এদিকে করোনার উর্ধগতি চলছে। এর মধ্যে আমাদের নিজস্ব টিকাটি যাতে তৈরি হতে পারে এবং জাতির ব্যবহারে লাগে, সেটির জন্যও সরকারের সহায়ক ভূমিকা প্রয়োজন। অন্তত তরুণ প্রজন্মের জন্য এই টিকা সহায়ক হবে বলে মনে করি। পশ্চিমা দেশে দ্রুত গতিতে আবিষ্কৃত টিকার সুরক্ষা ৬ মাস থেকে ১ বছর, তাও ব্লাডকট হওয়ার সম্ভাবনাও আছে। সেই হিসেবে দেশী টিকা অনেক বেশি উপযোগী হবে বলে মনে হয়। লেখক : শিক্ষাবিদ
×