সমগ্র বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ প্রত্যয়টি একটি আতঙ্ক ও ভয়ের এবং তৎসংশ্লিষ্ট উপায়ে শান্তি, শৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। আলোচিত সন্ত্রাসবাদ ইস্যুটি কি কারণে সংঘটিত হচ্ছে তার কার্যকারণ নিরূপণে গবেষকরা নানা বিষয়কে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। বিষয়গুলো সবিস্তারে আলোচনা সাপেক্ষে রাষ্ট্রীয় পলিসি লেভেলে প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণই পারে সন্ত্রাসবাদের ভয়াবহতা থেকে রাষ্ট্রের জনগণকে মুক্ত রাখতে। পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ যুদ্ধে দল, মত নির্বিশেষে প্রত্যেককে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে বৈশ্বিক সঙ্কটকে মোকাবেলার স্বার্থে। সন্ত্রাসবাদের বিচরণের জন্য প্রখ্যাত গবেষক লিউলেন চারটি ফ্যাক্টরকে দায়ী করেছেন- জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান সংখ্যা, সম্পদ এবং তার সাপেক্ষে লাভের ব্যাপক পার্থক্য, ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের বিস্তার এবং আধুনিক প্রযুক্তি ও এর ব্যবহার। পল উইলকিনসন সন্ত্রাসবাদের জন্য বেশ কিছু কারণ খুঁজে পেয়েছেন। তন্মধ্যে অন্যতম হলো : রাষ্ট্র কর্তৃক সন্ত্রাসবাদকে মদদ, জাতিগত সংঘাত, ডান-বাম মতাদর্শের চরমপন্থা, ধর্মান্ধতা ইত্যাদি বিষয় সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ও সংঘটনের জন্য বহুলাংশে ভূমিকা পালন করে থাকে। আলী রিয়াজ দেখিয়েছেন, বাংলাদেশে সাধারণত দেশীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা, জঙ্গীবাদের সংস্কৃতির ব্যাপকতা এবং সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর বর্ডারের বাইরে থেকে প্রাপ্ত সহায়তা গ্রহণ ইত্যাদি কারণে সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঘটছে।
সন্ত্রাসবাদের তল্পিবাহক হিসেবে স্ট্রেস (চাপ) নানা উপায়ে সন্ত্রাসীদের প্রভাবিত করে থাকে যার প্রেক্ষিতে অন্যান্য উৎসগুলোও প্রলুব্ধ করে থাকে সন্ত্রাসের প্রসারে। রবার্ট এগনিউ (১৯৯২) তিনভাবে স্ট্রেসের (চাপ) আগমন বার্তা বহন করার ইঙ্গিত প্রদান করেছেন। আর উক্ত স্ট্রেসের কারণে উপায়ন্তরহীন হয়ে মানুষ সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে থাকে। প্রথমত: কোন কিছু হারানো থেকে সাধারণত চাপ আসে (সম্পদ কিংবা কারও ভালবাসা), দ্বিতীয়ত: কারও কাছ থেকে প্রাপ্ত অসম্মান অথবা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়া থেকে চাপ আসে, তৃতীয়ত: সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য প্রাপ্তিতে কোন বাধা বিপত্তি এলে চাপের সৃষ্টি হয়ে থাকে (প্রত্যাশায় ব্যর্থতা চলে আসলে চাপের সৃষ্টি হয়)। আলোচিত তিনটি উৎসই ব্যক্তিক পর্যায়ে সন্ত্রাসবাদের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনটি উৎসের সমন্বয়েই সন্ত্রাসবাদ হয়ে থাকে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় যে কোন একটি স্ট্রেসের কারণে মানুষ সন্ত্রাসবাদে জড়িয়ে পড়ছে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আত্মঘাতী বোমা হামলায় যারা অংশগ্রহণ করে থাকে তাদের ধারণকৃত ভিডিওবার্তা বা অন্যান্য বার্তায় তাদের আত্মঘাতী হওয়ার পিছনের কারণ বর্ণনা করা থাকে এবং সেখানে অধিকাংশ গল্পই প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার গল্প কিংবা প্রেমে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার ঘটনা সংশ্লিষ্ট হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকে। অন্যদিকে দেখা যায়, বোম্বিং এর সঙ্গে সম্পৃক্তরা প্রতিশোধপরায়ন হয়ে হত্যাকান্ডের মরণনেশায় মেতে ওঠে এবং এটি মূলত চাপ আর ক্রোধের সামষ্টিক ফলেই সম্পন্ন হয়ে (প্রতিশোধপরায়নতা) থাকে যার ফলশ্রুতিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং কর্মীরা শহীদের মর্যাদা প্রাপ্তি এবং দলের আদর্শের প্রতি আনুগত্যতার (তারা মনে করে) বহির্প্রকাশ ঘটায়। সুতরাং এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, চাপের কারণে মানুষের মধ্যে নানাবিধ সঙ্কট, আস্থাহীনতা, পাওয়া না পাওয়ার বেদনা, ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর বাধাপ্রাপ্তি ইত্যাদি কারণে মানুষ সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়।
মানুষ কেন অপরাধ করে কিংবা কি কারণে সন্ত্রাসবাদে সম্পৃক্ত হয়? অপরাধবিজ্ঞানের Strain-Deprivation তত্ত্বানুযায়ী কোন মানুষ ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে গরিব, সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন অর্থাৎ সামাজিক পরিস্থিতির কারণে হতাশায় পর্যবসিত হয়ে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। প্রখ্যাত দার্শনিক এরিস্টটল বলেছেন, দারিদ্র্যতা বিদ্রোহ এবং অপরাধ প্রবণতা এর জন্য দায়ী। এখানকার বিদ্রোহ প্রত্যয়টি বহুরূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমনটি বলা যায় সমাজের আমূল পরিবর্তনের জন্য কাক্সিক্ষত বিদ্রোহ অনেকাংশে নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, সর্বোপরী অস্থিতিশীল পরিবেশের বাতায়ন তৈরি করে এবং সেখানে সন্ত্রাসবাদসহ নানাবিধ অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে। কেননা অস্থিতিশীল পরিবেশের সুযোগ দেশী-বিদেশী চক্র লুফে নিতে চায় এবং এজন্য যে কোন ধরনের ধ্বংসাত্মক কর্মকা- করতে দ্বিধা করে না উক্ত চক্রটি।
দারিদ্র্যতা কি সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত? এ প্রশ্নের উত্তরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়; পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আল কায়েদা মধ্যপ্রাচ্য থেকে কম বয়সের দরিদ্র ছেলেদের বাছাই করে তাদের গ্রুপে মেম্বার করে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করে এবং সে মোতাবেক নিশ্চিত করে বলা যায়, সন্ত্রাসী কার্যক্রমে দারিদ্র্যতা মুখ্য প্রভাবক হিসেবে কাজ করে থাকে। অন্যদিকে দেখা যায়, ৯/১১ এর ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্তরা মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিবার থেকে এসে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। আমজনতা মনে করে সন্ত্রাসীদের অধিকাংশই দরিদ্র পরিবার থেকে আসে। কিন্তু দরিদ্র, অশিক্ষিত নয় এমন দেশ থেকেও সুনির্দিষ্ট সংখ্যক ছেলে বা মেয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে যুক্ত হয়। কাজেই, দারিদ্রতাই সন্ত্রাসবাদকে প্রলুব্ধ করে এ কথাটি জোরের সহিত বলা যাবে না। বাংলাদেশেও দেখা গিয়েছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সন্ত্রাসবাদে জড়িয়ে পড়ছে। শুধু তাই নয় উচ্চশিক্ষিত এবং বিত্তবান ছেলেমেয়েরা সন্ত্রাসবাদের অর্থায়নেও ভূমিকা রাখছে।
লরেন্স কোহেন এবং মার্কাস ফেলসনের (১৯৭৯) রুটিন একটিভিটিস তত্ত্বানুযায়ী তিনটি প্রয়োজনীয় উপাদানের সংযোজনেই অপরাধের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনটি উপাদান হচ্ছে- অপরাধীর উদ্বুদ্ধ হওয়া, উপযুক্ত টার্গেট বাছাই করার নিশ্চয়তা, টার্গেটকে সুরক্ষার জন্য যথাযথ নিরাপত্তার অভাব। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তাপ, অক্সিজেন এবং জ্বালানির সমন্বয়ে আগুনের উৎপত্তি ঘটে থাকে ঠিক তেমনিভাবে উল্লেখিত তিনটি উপাদানের সমন্বয় ঘটলেই সেখানে সন্ত্রাসবাদের (অপরাধ) ঘটনা ঘটবে। যে কোন অপরাধ তথা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড সম্পাদনের জন্য উল্লেখিত তিনটি উপাদানের সমন্বয় প্রয়োজন।
নিয়ম নীতির অবক্ষয়ই মূলত আগ্রাসনের সৃষ্টি করে থাকে। নিয়ম নীতি বলতে বোঝানো হচ্ছে, সমাজের প্রচলিত রীতি নীতি যে বিষয়গুলো আদর্শ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহযোগিতা করে থাকে। নিয়ম নীতি হল প্রথার ন্যায় যেটি মূলত অঘোষিত আইন, বই পুস্তকে কোথাও লেখা নেই কিন্তু সমাজের প্রত্যেকটি মানুষ দীর্ঘদিন ধরে মেনে চলছে। ইমিল ডুর্খেইম বলেছেন, সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির অবক্ষয়ই মূলত আগ্রাসনের উৎপত্তি ঘটায়। উনিশ শতকের গবেষণায় দেখা যায়, আত্নহত্যা বিশেষ করে নিয়ম নীতির ব্যত্যয় ও অনাচারের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে সংশ্লিষ্ট। রবার্ট মার্টন (১৯৩৮), ডুর্খেইমের গবেষণার ফলাফলের সূত্র ধরেই গবেষণাকর্ম চালিয়ে যান এবং তৎসাপেক্ষে বিচ্ছিন্নতাকে সামনে নিয়ে আসেন। অনাচার এবং নিয়মনীতির অনুশাসনের অবক্ষয়ই বহুলাংশে বিচ্ছিন্নতার সুযোগ তৈরি করে দেয়। আর বিচ্ছিন্নতাই মানুষকে অপরাধ প্রবণ করে তোলে। আর বিচ্ছিন্নতার অন্যতম একটি প্রধান অনুসঙ্গ হচ্ছে সমাজ কাঠামোর বিশৃঙ্খলা। সামাজিক বিশৃঙ্খলা মূলত সমাজের অধঃপতনের জন্য নানাভাবে দায়ী। সমাজের অধঃপতন সমাজকে অস্থির, অস্থিতিশীল, প্রতিক্রিয়াশীল করে তোলে যার প্রেক্ষিতে সমাজ অপরাধের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়ে উঠে। অর্থাৎ সারসংক্ষেপ এমন বিচ্ছিন্নতাই মূলত একটি বিশেষ শ্রেণিকে সন্ত্রাসবাদের দিকে ধাবিত করে। পরবর্তীতে বাস্তবিক উদাহরণ এবং গবেষণায় বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেন আকবর আহমদ (২০০৩, ২০০৭), মার্ক সেগম্যান (২০০৪) এবং কাস সানস্টেইন (২০০৩)।
বিচ্ছিন্নতার আরও বেশ কয়েকটি মাধ্যম রয়েছে উল্লেখিত স্কলারদের মতামত অনুযায়ী। আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার ও পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির ছোঁয়ায় ধনী-গরিবের পার্থক্যের ব্যাপকতায় বিচ্ছিন্নতাবাদের সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে একদল মানুষ সন্ত্রাসবাদে জড়িয়ে পড়ে রাষ্ট্র ও বিশ্ব শান্তির বিনষ্ট সাধন করে থাকে। দারিদ্রতা এবং অজ্ঞতা বর্তমানে মিডিয়ার অবাধ বিচরণের ক্ষেত্রে কোন বাঁধা হিসেবে কাজ করতে পারে না অর্থাৎ প্রযুক্তির যুগে সকলেই মিডিয়া ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে। তবে মিডিয়ার প্রতিচ্ছবি ও অনুষ্ঠানমালা যেমনিভাবে মানুষের মনন ও মগজে প্রভাব ফেলছে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া সন্ত্রাসবাদসহ অন্যান্য অপরাধের অনুসঙ্গ হিসেবে কাজ করে থাকে। কাজেই, বিচ্ছিন্নতা এবং নীতি বিবর্জিত কার্যকলাপ সন্ত্রাসবাদের অনুসঙ্গ হিসেবে কাজ করে থাকে।
সন্ত্রাসবাদের নিয়ামক হিসেবে বয়স এবং লিঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে থাকে। রাস্তাঘাটের অপরাধীর ন্যায় সন্ত্রাসীরা সাধারণত পুরুষ শ্রেণির এবং তাদের বয়স অধিকাংশের ক্ষেত্রে ২০ এবং তদুধর্ব হয়ে থাকে। লাইফ কোর্স তত্ত্বে মূলত জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে অবস্থান বিবেচনায় বয়স, বিচ্ছিন্নতা এবং অপরাধ নিয়ে আলেচনা করা হয়েছে। এটার উদ্দেশ্য হচ্ছে- কিশোর এবং কিশোর পেরিয়ে মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতার যে বহিঃপ্রকাশ পাওয়া যায় সেটি নিয়ে আলোকপাত করা। রবার্ট পেপ এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক সুইসাইড বোম্বিং এর উপর কাজ করেছেন এবং যাদের সম্পৃক্ততা পেয়েছেন তাদের অধিকাংশই তরুণ। বিশ্লেষণে জানা যায়, হিজবুল্লাহ্র সন্ত্রাসীদের বয়স ২১.১ বছর, তামিল টাইগারদের ২১.৯; ফিলিস্তিনিদের ২২.৫ বছর, কুর্দিদের বয়স ২৩.৬ এবং আল কায়েদার সন্ত্রাসীদের বয়স ২৬.৭ বছর। এ কথাটিও গবেষকগণ দেখিয়েছিন, শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্যের কারণে সন্ত্রাসবাদে সম্পৃক্ত হওয়ার নজির বাস্তবক্ষেত্রে পাওয়া যায়নি। এমতাবস্থায়, উপর্যুক্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য দেশে সন্ত্রাসবাদের কারণ হিসেবে আলোচিত বিষয়গুলো বিবেচ্য হিসেবে পরিগণিত করে সমাধানের জন্য পলিসি লেভেলে গবেষকদের সুপারিশের ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমেই সন্ত্রাসমুক্ত পৃথিবীর স্বপ্ন প্রণয়ন করা যাবে।
লেখক : প্রভাষক, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়