ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ব্লিডিং বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৯:১০, ১৮ আগস্ট ২০১৯

ব্লিডিং বাংলাদেশ

১৯৭১ সালের ১৮ আগস্ট দিনটি ছিল বুধবার। কুমিল্লায় পাকসেনাদের তিনটি দল মুরাদনগর থেকে হোমনার দিকে নৌকায় অগ্রসর হয়। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দল মুরাদনগর থেকে ৮ মাইল দূরে পাকসেনাদের নৌকাগুলোকে এ্যামবুশ করে। গেরিলাদের গুলিতে দুটি নৌকা পানিতে ডুবে যায় এবং এবং একজন ক্যাপ্টেনসহ ২৯ জন পাকসেনা ও ৫জন রাজাকার নিহত হয়। এ অভিযানে মুক্তিবাহিনী প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করে। বরিশালে পাকবাহিনীর ৪ খানা গান বোট শরণখোলা রেঞ্জঅফিস অতিক্রম করে উত্তরদিকে যাবার পরে পরবর্তী ৩ খানা গানবোটের ওপর ভোলা নদীর দুই পার থেকে মুক্তিযোদ্ধারা প্রবল গুলিবর্ষণ করে। এ যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা ত্যারাবাঁকা হাট নামক স্থানে একত্র হয়। মুক্তিবাহিনী সিলেট শহরের কদমুলী ঝালোপাড়ার কাছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একটি জীপ এ্যামবুশ করে। এতে একজন পাক অফিসারসহ ৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। নওগাঁর কুলফতেপুর পাকহানাদাররা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা চালায়। এতে ৬জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন ও ১২ জন আহত হন। মুক্তিবাহিনী কাংখালি থানায় অভিযান চালিয়ে ৫ জন পাকসেনা এবং কয়েকজন রাজাকার হত্যা ৪৫টি রাইফেল জব্দ করে। মুক্তিবাহিনী কোটালীপাড়া থানা আক্রমণে ৩ জন পাকসৈন্য ও ১০ জন রাজাকার হত্যা করে। তারা একটি লঞ্চ, ৩টি বার্জ এবং ১২টি রাইফেল জব্দ করে। সুন্দরবন মুক্তিবাহিনী সব-সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব.) জিয়া উদ্দিনের পরিকল্পনায় শৌলা নদীতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বহনকারী গানবোট খুলনা যাওযার পথে রকেট আক্রমণ করা হয়। রকেটে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত এবং গানবোটে থাকা পাকিস্তানী হানাদাররা নিহত হয়। রাত ২টায় পতেঙ্গা বিমানবন্দর থেকে একদল নৌবাহিনীর অফিসার আসে পিআইএ এর গাড়ি করে। গেরিলার ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত পাহারারত পদাতিক বাহিনীর সৈন্যরা গেরিলা মনে করে নৌবাহিনী অফিসারের গাড়িতে গুলি চালায়। গুলিতে গাড়ির চালকসহ ৩-৪ জন নৌবাহিনীর অফিসার নিহত হয়। অপরদিকে পিআইএর গাড়ি থেকে নৌবাহিনীর সৈন্যরা পাহারারত পদাতিক বাহিনীকে গেরিলা মনে করে পাল্টা গুলি চালালে একজন অফিসারসহ সাতজন পদাতিক সৈন্য নিহত হয়। বিমানবন্দর ও জেটির বিভিন্ন এলাকায় গেরিলা আক্রমণ শুরু হয়েছে মনে করে রাতের অন্ধকারে পরস্পর ঝড়ের মতো গুলি চালিয়ে নিজেদের মধ্যে খন্ডযুদ্ধ শুরু করে। ফলে এই রাতে বিভিন্ন জায়গায় ১৭ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। হংকংয়ের ভারপ্রাপ্ত পাকিস্তানী ট্রেড কমিশনার মহিউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ সরকারের সমর্থনে পদত্যাগ করেন। জনাব আহমেদ পাকিস্তান সরকারকে পূর্ববঙ্গে নির্মম গণহত্যার জন্য অভিযুক্ত করেন। এটা কোন ব্যক্তির পক্ষে আর সম্ভব নয় এমন সরকারের প্রতিনিধিত্ব করা যারা গণহত্যায় জড়িত। আমরা নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারি না যেখানে দেশের হাজার হাজার মানুষ নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। পাক বাহিনীর জুলুম-নির্যাতনের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রাণ-পুরুষ জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের সেক্রেটারি জেনারেল ও ভারতীয় পার্লামেন্টের লোকসভার সদস্য হজরত আসআদ মাদানী (র.)। পাক বাহিনীর গণনির্যাতন বন্ধে বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতে তিনি অনন্য ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বজনমত গঠনের লক্ষ্যে বিশেষ করে তার নেতৃত্বে কলকাতায় সভা ও সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতের মুসলমান সমাজে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রবল জনমত গঠনের কাজ করেন মাওলানা আসআদ মাদানী। রাজধানী দিল্লীতে বিশাল মহাসমাবেশসহ ভারতজুড়ে প্রায় ৩০০টি সমাবেশ করেন তিনি। একাত্তরের এই দিন কলকাতার মুসলিম ইসস্টিটিউট হলে আয়োজিত জমিয়তের কনভেশন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে রেজুলেশন পাস করেন। এছাড়া মাওলানা আসআদ মাদানী (র.) পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা এলাকায় বাংলাদেশীদের জন্য শরণার্থী শিবিরের ব্যবস্থা করেন এবং জমিয়তের পক্ষ থেকে নিয়মিত রিলিফ বিতরণের ব্যবস্থা করেন। ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত কথিকামালা বিশ্বজনমত অনুষ্ঠানে বলা হয়েছে, বিশ্ব জোড়া প্রতিবাদ, ঘৃনা ও কোটি ধিক্কার উপেক্ষা করে পাক সামরিক চক্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসন অব্যাহত রেখেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি ও প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত মিঃ চেস্টার বোলস শেখ মুজিবুর রহমানের তথাকথিত বিচারের কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন: পাকিস্তানী সামরিক জান্তার আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের যে গোপন বিচার চালাচ্ছে তা আগাগোড়া একটি প্রহসন মাত্র। ওয়াশিংটন পোস্ট-এ একটি তথ্যপূর্ণ প্রবন্ধে মিঃ চেস্টার বোলস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে অতীতের সব ভুলত্রুটি সংশোধন করে পাকিস্তানের কাছে সামরিক অস্ত্র ও সমরসম্ভার বিক্রয় সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা এবং পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার অর্থনৈতিক সাহায্য দান একেবারে বন্ধ করে দেবার আহ্বান জানান। মার্কিন সিনেটের উদ্বাস্তু বিষয়ক কমিটির সভাপতি সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী বলেন: পাকিস্তানী সামরিক জান্তার কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একমাত্র অপরাধ হলো তিনি নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন। তাঁর বিচার আন্তর্জাতিক আইনের দিক থেকে বিচারের ব্যাভিচার ও ন্যায়বিচারের প্রহসন মাত্র। আদ্দিস আবাবা বেতার থেকে প্রচারিত এক খবরে বলা হয়: রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক সংস্থা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য সারাবিশ্বে এক প্রচার অভিযান শুরু করবে। ব্লিডিং বাংলাদেশ’ শিরোনামে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি কর্তৃক প্রকাশিত চিত্র সংকলন সমিতির সভাপতির বক্তব্য সংবলিত একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে বলা হয়, এইটি ছবিতে নিপীড়িত বাংলাদেশের গল্প বলার প্রচেষ্টা। প্রতিটি ছবিই বাংলাদেশের দুঃখী নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের মাঝে পাক বাহিনীর রেখে যাওয়া হস্তক্ষেপের চিহ্ন যা আসল এবং প্রকৃত প্রমাণ। ছবির পাতাগুলো উন্মোচন করে যে, তারা আসলে খুবই সাধারণ লোক, যাদের একমাত্র দোষ ছিল যে তারা তাদের নিজেদের দেশকে ভালবাসতো। আর্মিদের তৈরি এই ধ্বংসলীলা হতে মুক্তভাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছাধারীদের কেউই রক্ষা পায়নি-শিশু, নারী, বৃদ্ধ জনতা-সবাই আক্ষরিক অর্থেই নির্যাতিত হয়েছে, তাদের সাধারণ ঘরবাড়ি এবং সকল ধরনের সাধারণ আমানত হয় লুন্ঠিত হয়েছে অথবা পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এই ছবিগুলো সেইসব কথা বলে এবং এইসব ছবি যেই নৃশংসতাকে উন্মোচিত করেছে তা আমরা আমাদের ক্রুদ্ধ উন্মত্ত মানসিক অবস্থাতেও আদৌ কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি কি না তা নিয়ে গুরুতর সন্দেহের উদ্রেক জাগায়।... এই ছবিগুলো আসলে নিপীড়িত বাংলাদেশের বিষয়ে প্রকৃত ঘটনার শুধু একটি ক্ষুদ্র অংশের প্রকাশ মাত্র। সেই দুঃখী দেশটিতে যা কিছু হয়েছে এবং এখনো যা ঘটে চলেছে তার সব কিছুর চিত্র ধারণ করা সম্ভব হয়নি, এমনকি যে সব ছবি ধারণ করা হয়েছে এবং সেই দেশ হতে বাইরে তা পাচার করে দেয়া হয়েছে তার সবগুলো সংগ্রহ ও ছাপানো সম্ভব হয়নি। দৈনিক পাকিস্তনে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভারত ও পাকিস্তানের উত্তেজনাকর এলাকাগুলো সফর করে সেখানকার আশংকাজনক পরিস্থিতি নিরসনের উদ্দ্যেশ্যে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের সমন্বয়ে একটি মধ্যস্থতা কমিটি গঠনের জন্য পাকিস্তান প্রস্তাব করেছে। এক সরকারী বিবৃতিতে জানানো হয় যে, নিরাপত্তা পরিষদের চলতি অধিশেনের প্রেসিডেন্ট ইটালীর রাষ্ট্রদূত মিঃ ভিনসির নিকট গত ১১ই আগস্ট প্রদত্ত এক চিঠিতে জাতিসংঘে নিযুক্ত পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি জনাব আগা শাহী উপরোক্ত প্রস্তাব করেন। প্রস্তাবে উক্ত প্রতিনিধি দলের পাকিস্তান ও ভারত বিশেষ করে উভয় দেশের উত্তেজনাপূর্ণ এলাকাগুলো সফর করার প্রস্তাব করা হয়। চিঠিতে বলা হয় যে, পাকিস্তান সরকার তার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ বরদাশত করবে না। তবে ভারত যাতে সৌহার্দ্য ও শান্তির পথে অগ্রসর হয় তার উদ্দেশ্যে ভারতকে পরামর্শ দেবার জন্য চিঠিতে পাকিস্তান ও ভারত উভয়ের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন রাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়। চিঠিতে উল্লেখ করা হয় যে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট যে কোন স্থানে যে কোন সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করার প্রস্তাব করেছেন। কিন্তু এটা দুর্ভাগ্যজনক যে উক্ত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। চিঠিতে আরও বলা হয় যে, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে কতিপয় প্রশ্নে বিরোধ বহুদিন যাবত অমীমাংসিত থাকায় উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও খারাপ হয়ে পড়ে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সম্পর্কের এতদূর অবনতি হয়েছে যাতে এমন একটি সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যা হয়ত এই এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। চিঠিতে বলা হয় যে, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি উন্নয়নের চেষ্টা চালানো হয়েছে এবং বাস্তচ্যুত ব্যক্তিদের প্রত্যাবর্তনের জন্য সম্ভাব্য সব রকমের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×