ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

অভিনব থেরাপি ভাইরাস দিয়ে প্রাণঘাতী ব্যাকটেরিয়া দমন

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ১৫ জানুয়ারি ২০১৮

অভিনব থেরাপি ভাইরাস দিয়ে প্রাণঘাতী ব্যাকটেরিয়া দমন

সুপারবাগ বা মারাত্মক ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ দমনে এক শ’ বছরের পুরনো একটি বিস্তৃত প্রায় চিকিৎসার এখন পরীক্ষামূলক প্রয়োগ চলছে এবং তাতে বিস্ময়কর সাফল্যও পাওয়া ব্যাকটেরীয়ওফেজ নামে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাস ব্যবহার করা হয়। ভাইরাসগুলোর ওষুধ প্রতিরোধী কতিপয় অতি ক্ষতিকর এমনকি প্রাণঘাতী প্রকৃতির ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করার রহস্যময় ও অস্বাভাবিক ক্ষমতা রয়েছে। চিকিৎসাটি অবশ্য বিতর্কের উর্ধে নয়। দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রের পিটাস্্বার্গের গ্যালারি স্মিল নামে ২৫ বছরের এক তরুণীর সিসটিক-ফাইব্রেসিস অপারেশনের সময় বুর্কহোল্ডেরিয়া সেপারিয়া নামে এমন এক ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত হয় যা কোন ওষুধ দিয়ে দমন করা যায় না। নানা ধরনের এ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করে দেখা গেছে সেই ব্যাকটেরিয়াকে নিয়ন্ত্রণে আনা দূরে তো থাক বরং তা এ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেছে এবং ম্যালরির ফুসফুসে আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে গেড়ে বসেছে। তাকে ইনফেকশন মুক্ত করতে ডাক্তাররা চরম ব্যবস্থা নেন- দুটো ফুসফুসই ট্রান্সপ্লান্ট করেন। কিন্তু ব্যাকটেরিয়াকে দমন করা যায়নি। সেগুলো তার মাইনাসে গিয়ে বাসা বাঁধে। অস্ত্রোপচারের পর সেগুলো পূর্ণ শক্তিতে ফিরে আসে। কন্যার জীবন বাঁচাতে মরিয়া হয়ে পিতা মার্ক স্মিথ বিকল্প ব্যবস্থার দিকে ঝোঁকেন। পত্রিকার খবর পড়ে তিনি জানতে পারেন কিভাবে ফেজ থেরাপিতে ভাইরাস ব্যবহার টম পিটারসন নামে এক ব্যক্তির ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ দমন করে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তিনি তখন এই চিকিৎসার শরণাপন্ন হন এবং সেই চিকিৎসার বদৌলতেই শেষ পর্যন্ত তার কন্যা সেরে ওঠে। প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত ২০ লাখ আমেরিকান এমন ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণে আক্রান্ত হয় যা এ্যান্টিবায়োটিকে কোন কাজ করে না। রক্ষণশীল হিসেবে তাদের মধ্যে ২৩ হাজার শেষ পর্যন্ত মারা যায়। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, সেদিন বেশি দূরে নয় যখন গাত্রচর্ম সামান্য কেটে যাওয়া ক্ষত কিংবা কানের সংক্রমণ এত মারাত্মক আকার ধারণ করবে যে সেগুলো মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এমনও ভবিষ্যদ্বাণী আছে যে, ২০৫০ সাল নাগাদ প্রতি বছর এক কোটি লোক এমন সব সংক্রমণে মারা যাবে সেগুলোর বিরুদ্ধে কোন ওষুধই কাজ করবে না। এই বিপদ যে কি ভয়াবহ লোকে তা বুঝতে পারছে না! এটা একটা সঙ্কট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুপারবাগ তথা এ্যান্টিবায়োটিকেও ধ্বংস হয় না এমন ব্যাকটেরিয়াকে মানব স্বাস্থ্যের প্রতি আশু হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেছে। নতুন কোন এ্যান্টিবায়োটিকও উদ্ভাবিত হচ্ছে। তথাপি এই ব্যাকটেরিয়া এক বছরের মধ্যে ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে এই সীমাবদ্ধতা বা ঘাটতিই ফেজ থেরাপির প্রতি আগ্রহ সঞ্চার করেছে। কোন কোন গবেষক এটাকে যে ধরনের ব্যাকটেরিয়া ঘটিত ইনফেকশন ম্যালরির জীবন বিপন্ন করেছিল তেমন ইনফেকশন দমনের গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র বলে অভিহিত করেছেন। অবশ্য ফেজ থেরাপি অন্যান্য দেশে তো পরের কথা কেবল এই চিকিৎসা লাভ করেছে। এর জন্য বিশেষ ক্লিয়ারেন্স নেয়ার দরকার হয়। কারণ এখনও এফবিএর অনুমোদন পাওয়া যায়নি। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন চলতি বছরেই ফেজ থেরাপি চিকিৎসার মূল ধারায় চলে আসবে। এ সময়ে বেশকিছু পরীক্ষামূলক চিকিৎসা পরিচালিত হবে এবং এর কার্যকারিতা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হলে প্রতি বছর সুপারবাগ ইনফেকশনে আক্রান্ত সারা বিশ্বের লাখ লাখ মানুষের জীবন এই ফেজ থেরাপিতে রক্ষা পেতে পারে। ফেজ হলো ব্যাকটেরিয়া দমনকারী ভাইরাস যার উপস্থিতি পৃথিবীর সর্বত্রব্যাপী। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন যে, পৃথিবীতে ফেজ রয়েছে ১ কোটি ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন। এত বেশি সংখ্যায় আর কোন প্রাণের অস্তিত্ব নেই। ফেজ তাদের ডিএনএ ব্যাকটেরিয়া কোষের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে কাজ করে। ব্যাকটেরিয়া কোষের মধ্যে এরপর ফেজগুলোর প্রতিরূপ দ্রুত সৃষ্টি হতে থাকে এবং এর চাপে এক পর্যায়ে ব্যাকটেরিয়া ফেটে সরে যায়। ফেজের বিশেষত্ব হলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এগুলোর প্রতিটি জাত শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট ধরনের ব্যাকটেরিয়াকেই আক্রমণ করে যে ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করার জন্য সেগুলোর আবির্ভাব। এখানেই এ্যান্টিবায়োটিকের সঙ্গে পার্থক্য। এ্যান্টিবায়োটিক ভাল ব্যাকটেরিয়াসহ নানা ধরনের ব্যাকটেরিয়াকে যুগপৎ আক্রমণ করে। ব্যাকটেরীয়ওফেজ ১৯১৫ সালে ইংল্যান্ডে ফ্রেডেরিক স্টুয়ার্ট ও ১৯১৭ সালে ফ্রান্সে ফেলিক্স দ্য হেরেন আবিষ্কার করেন। ১৯২০ ও ১৯৩০ এর দশকজুড়ে সংক্রমণ মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের অন্যত্র ব্যাকটেরিও ফেজের ব্যবহার হয়েছে। তখনও এই চিকিৎসা নিয়ে মেডিক্যাল বিশ্বে দ্বিধাবিভক্তি ছিল। ১৯৪০ ও ১৯৫০-এর দশকে এ্যান্টিবায়োটিকের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হলে ডাক্তাররা ফেজ থেকে সরে এসে এ্যান্টিবায়োটিককেই গ্রহণ করে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ২৬ কোটি ৬০ লাখ এ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবস্থাপত্র লেখা হয়। গত শতাব্দীতে পূর্ব ইউরোপের বিজ্ঞানীরা ফেজের ব্যবহার অব্যাহত রাখলেও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমী বিশ্বে এটি উপেক্ষিত হয় এই যুক্তিতে যে, এটা এক অনিরাপদ ও সেকেলে চিকিৎসা। ফেজ থেরাপির প্রথমদিকে তো আর ডিএনএ উদ্ভাবিত হয়নি। ফলে এই চিকিৎসায় কিছু অসম্পূর্ণতা ছিল। এখন খোদ যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসকরা এই থেরাপি নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছেন। এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন স্টেফনি স্ট্রামডি নামে এক সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ। তার স্বামী মনস্তত্ত্বের অধ্যাপক মি. প্যাটারসন ২০১৫ সালের শেষ দিকে এসাইনোব্যাক্টর বাউমানি নামে এক মারাত্মক ধরনের সুপারবাগে সংক্রিমত হন। তাকে শক্তিশালী এ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করে প্রথমদিকে কিছুটা ফল পাওয়া গেলেও পরে সেই ব্যাকটেরিয়াটি এ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। প্যাটারসনের অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে থাকে এবং তার মৃত্যু অনিবার্য হয়ে ওঠে। তখন শেষ চেষ্টা হিসেবে তাকে পরীক্ষামূলকভাবে ফেজ থেরাপি দেয়া হয়। প্যাটারসন সুস্থ হয়ে কাজে ফিরে গেছেন। এ এক নতুন জীবন পাওয়ার মতো। প্যাটারসনের সাফল্যের কাহিনী গত বছরের এপ্রিল মাসে প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হলে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। সুপারবাগে ইনফেকশনে ভুগছে এমন ব্যক্তিরা বা তাদের স্বজনরা এই চিকিৎসার সুযোগ লাভে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। বিশেষজ্ঞরা আশাবাদী যে ফেজ থেরাপির এফডিএ অনুমোদন পেতে বেশি সময় নেবে না। এখন এই চিকিৎসা আরও ব্যাপক পরিসরে প্রাপ্তিসাধ্য হয়ে উঠবে। এ্যান্টিবায়োটিকের তুলনায় ফেজ থেরাপির অন্য কিছু সুবিধা আছে। প্রথমত, ব্যাকটেরীয়ফেজ পৃথিবীর সর্বত্র এমনকি সুয়ারেজও পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, এটা শুধু টার্গেট করা ব্যাকটেরিয়াকেই আক্রমণ করেÑ আক্রান্তের শরীরের সব ব্যাকটেরিয়াকে নয়, যার ফলে ভাল ব্যাকটেরিয়াগুলো বেঁচে যায়। তৃতীয়ত, এই চিকিৎসা খুব তাড়াতাড়ি করা যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে সুপারবাগ সংক্রমণ নির্ণীত হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বিজ্ঞানীরা রোগীকে দেয়ার জন্য ফেজ ককটেল তৈরি করতে পারেন। ব্যাকটেরিয়াও এক সময় ফেজ প্রতিরোধী হয়ে উঠতে পারে। তবে সুবিধা হচ্ছে ভাইরাস সংখ্যাতীত জাতের আছে যা এ্যান্টিবায়োটিকের নেই। তাই বলে যে, এ্যান্টিবায়োটিক একেবারে বাদ হয়ে যাবে তা নয়। কখনই তা হবে না। গতানুগতিক ইনফেকশনে এ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ সর্বদাই অধিকতর সুবিধাজনক ও সহজ। সুপারবাগ অর্থাৎ এ্যান্টিবায়োটিকেও কাজ হয় না এমন ব্যাকটেরিয়া দমনে ফেজ শক্তিশালী প্রতিষেধক হতে পারে। তবে ফেজ থেরাপিকে সত্যই কার্যকর হতে হলে ব্যাকটেরীয়ফেজের বিশাল ভা-ার থেকে ব্যাকটেরিয়ার স্যাম্পল স্ক্যান করার উপায় পরিশীলিত করতে হবে। নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসের জন্য নির্দিষ্ট ভাইরাস দ্রুত বেছে নেয়ার কৌশলটি সহজতর করতে হবে। গবেষকরা আশাবাদী যে এমন একটা সময় আসবে যখন ফার্মেসিগুলোকে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া ইনফেকশনের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন ভাইরাসযুক্ত ফেজের ডায়াল লাগানো যাবে। তখন কারও কোন ইনফেকশন হলে তার জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া ঠিক কোনটি তা রক্ত পরীক্ষার দ্বারা এক ঘণ্টার মধ্যে শনাক্ত করা এবং সেই ব্যাকটেরিয়া দমনের সঠিক ভাইরাসটি চিহ্নিত করে ফার্মেসি থেকে প্রয়োজনীয় ফেজ ডায়াল কিনে তা প্রয়োগ করা সম্ভব হবে। এক হিসাবে দেখা গেছে যে, ফেজভিত্তিক চিকিৎসার ৬ হাজার কোটি ডলারের বাজার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য এখনও অনেক কাজ বাকি রয়েছে। সূত্র : টাইম
×