ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. প্রণব কুমার পাণ্ডে

রসিক নির্বাচন এবং বিএনপির রাজনীতি

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ৯ জানুয়ারি ২০১৮

রসিক নির্বাচন এবং বিএনপির রাজনীতি

গত ২২ ডিসেম্বর ২০১৭ শান্তিপূর্ণভাবে ও উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। মিডিয়া থেকে শুরু করে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সকলেই এই নির্বাচনকে সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য বলে আখ্যায়িত করেছে। এর জন্য সর্ব প্রথমে ধন্যবাদ প্রাপ্য নির্বাচন কমিশনের। সরকারও ধন্যবাদ প্রাপ্তির দাবিদার এই নির্বাচনকে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে দেয়ার জন্য। এটি সত্যিই উৎসাহব্যঞ্জক এই জন্য যে, প্রথম থেকেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এই নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার জন্য তাদের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। তারা প্রথম থেকেই একটি বিষয় পরিষ্কার করেছে, আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে এমন কিছু করবে না যাতে করে জাতির কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। নির্বাচনের ফল থেকে দেখা গেছে, জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাফা আওয়ামী লীগের প্রার্থী শরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুর চেয়ে প্রায় এক লাখ ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেছেন। আমার লেখার মূল উদ্দেশ্য হলো এই নির্বাচনের রাজনৈতিক গুরুত্ব আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির রাজনীতির স্বরূপ বিশ্লেষণ করা। এই নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক নীতি ও মূলবোধের জয় হয়েছে। নির্বাচন কমিশনসহ নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান এই বিষয়টি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে, যদি ইচ্ছা থাকে তাহলে যে কোন লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠনের পর থেকে বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে এই কমিশনের যোগ্যতা এবং নিরপেক্ষতা নিয়ে বিভিন্ন সময় সন্দেহ প্রকাশ করেছে। এ প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন এই নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। তবে এ কথা ঠিক যে, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গুরুত্ব এক নয়। কারণ, সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হয়। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্য যে, আমরা যদি নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর বিশ্বাস রাখতে না পারি এবং তাদের সহায়তা না করি তবে কারও পক্ষেই সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে না। আমরা যদি সবসময় সব কাজে তাদের বিরোধিতা করি এবং ভুল ধরার চেষ্টা করি তাহলে এই প্রতিষ্ঠানসমূহ কখনই তাদের গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারবে না। প্রকৃতপক্ষে বর্তমান কমিশন শুধু রংপুর সিটি কর্পোরেশন নয়, চলমান সকল নির্বাচন সুষ্ঠু করার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা একটি বিষয় ভালভাবেই জানেন যে, এই সমস্ত নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার মাধ্যমে তারা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হবে। ফলে এই নির্বাচনের মাধ্যমে একটি জিনিস পরিষ্কার হয়েছে, নির্বাচন কমিশন চাইলে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারে। এই নির্বাচনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিবাচক ভূমিকা। প্রকৃতপক্ষে সকল রাজনৈতিক দলই নির্বাচনকালীন ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। কোন দলই নির্বাচনকে কলুষিত করার ব্যাপারে সরকারের ভূমিকার তেমন কোন সমালোচনা করেনি। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে তার প্রশান্তির কথা মিডিয়াকে জানিয়েছেন। এমনকি বিএনপির পক্ষ থেকেও নির্বাচনের সার্বিক পরিবেশ নিয়ে তেমন কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। এই নির্বাচনের ফলাফলকে যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখা যাবে, রংপুর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের জন্মস্থান হওয়ার কারণে এই অঞ্চলে জাতীয় পার্টির একটি ভোট ব্যাংক রয়েছে। ২০১২ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জিতলেও জাতীয় পার্টির দুইজন প্রার্থীর মোট ভোট আওয়ামী লীগের প্রার্থীর চেয়ে বেশি ছিল। মোঃ মোস্তাফিজুর রহমার মোস্তাফা সেবার জাতীয় পার্টির বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েও ভোট প্রাপ্তির দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন। সেইদিক থেকে বিচার করলে এবারের নির্বাচনে রংপুর সিটি কর্পোরেশনে জাতীয় পার্টির বিজয় অনেকটাই সুনিশ্চিত ছিল। কারণ এবার জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিলেন মাত্র একজন। তাছাড়া মি. ঝণ্টু গত পাঁচ বছরে বেশ জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন। এই নির্বাচনটি বিএনপির জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ওই অঞ্চলের ভোটারদের মন জয় করার জন্য এই নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীর আরও ভাল করা উচিত ছিল। নির্বাচনের আগে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিএনপির বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় নেতা এই নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু ফলাফলে দেখা গেল বিএনপির প্রার্থী কাওসার জামান বাবলা পেয়েছেন মাত্র ৩৫,২৩৬ ভোট, যেটি বিএনপির প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। ফলাফলের ধরন বিশ্লেষণ করলে এই বিষয়টিই স্পষ্ট হয় যে, বিএনপি রংপুর অঞ্চলের ভোটারদের মন জয় করার ক্ষেত্রে বেশ খানিকটা পিছিয়ে আছে। এই পিছিয়ে থাকার বিষয়টি আগামী সংসদ নির্বাচনে তাদের ভোগাতে পারে। রংপুর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে এক ধরনের সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা গেছে। নির্বাচন শেষে বিএনপির শীর্ষ দুই নেতা নির্বাচনের সার্বিক মূল্যায়ন করতে গিয়ে দুই ধরনের মতামত ব্যক্ত করেছেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেনÑ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। অন্যদিকে রিজভী আহমেদ বলেছেনÑ নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। শীর্ষ নেতাদের মধ্যে এই ধরনের সমন্বয়হীনতা দলীয় নেতাকর্মী এবং দেশবাসীকে কি বার্তা দিচ্ছে? তাহলে কি দেশবাসী ধরে নেবে দ্বৈত নেতৃত্বে বিএনপি পরিচালিত হচ্ছে? রংপুর নির্বাচনকে বাদ দিয়ে যদি আমরা জাতীয় নির্বাচনের দিকে নজর দেই তাহলেও দেখব জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে বিএনপির হাইকমান্ড থেকে একেক সময় একেক ধরনের মন্তব্য করা হচ্ছে। কয়েক মাস আগে বেগম জিয়াসহ শীর্ষস্থানীয় সকল নেতা আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে ইতিবাচক মন্তব্য করছিলেন। কিন্তু বেগম জিয়া লন্ডন থেকে ফিরে এসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কোন ধরনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্তের কথা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরছেন। আবার একই সঙ্গে বিএনপির কোন কোন শীর্ষস্থানীয় নেতা এখনও নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে তাদের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন। ফলে দেশবাসীর মধ্যে বিএনপির নেতৃত্বের প্রতি এক ধরনের আস্থাহীনতার জন্ম দিয়েছে, যেটি ভবিষ্যতে বিএনপির জন্য নেতিবাচক ফল আনতে পারে। আমরা সকলেই জানি যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নির্বাচনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, একমাত্র নির্বাচনের মাধ্যমেই রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হতে পারে। রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিএনপি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ভোটের রাজনীতিতে তারা জনগণের তেমন সমর্থন পায়নি। সুতরাং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির সকল কর্মকা- পরিচালিত হওয়া উচিত। বিএনপি নেতাদের প্রথম কাজ হওয়া উচিত আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এবং পরবর্তীতে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা নিয়ে সরকারের সঙ্গে দরকষাকষি করে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করা। বিএনপি নেতাদের স্মরণ রাখা উচিত- পরপর দুইবার সংসদ নির্বাচন বয়কট করলে রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হতে পারে। আর একবার মূল ধারার রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়লে আবার সেখানে ফিরে আসা তাদের জন্য খুবই কঠিন হতে পারে। দেশবাসীর প্রত্যাশা বিএনপির নেতারা এই বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত্র গ্রহণ করবেন। লেখক : অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
×