ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ব দর্শন দিবস ॥ গুরুত্ব ও তাৎপর্য

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ১৫ নভেম্বর ২০১৭

বিশ্ব দর্শন দিবস ॥ গুরুত্ব ও তাৎপর্য

ইউনেস্কো প্রথম দর্শন দিবস ঘোষণা করে ২০০২ সালে। প্যারিস সদর দফতর ও বিভিন্ন সদস্য দেশে আয়োজন করে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, বিতর্ক, ওয়ার্কশপসহ নানারকম অনুষ্ঠান। দৈনন্দিন জীবনে দার্শনিক যুক্তি ও নৈতিক চেতনার গুরুত্ব, যুদ্ধের ভয়াবহতা, অমানবিক যুদ্ধের অভিশাপ থেকে মুক্তির উপায়, ন্যায়পরতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, মানবাধিকার, ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা, আন্তঃধর্মীয় ও আন্তর্জাতিক সম্প্রীতি, নিরাপদ পৃথিবী প্রভৃতি বিষয় নিয়ে করে বর্ণাঢ্য আয়োজন। এসব অনুষ্ঠানের প্রতি ঔৎসুক্য তরুণ সমাজ তথা সাধারণ মানুষের আগ্রহ দেখে ২০০৫ সালে ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনে প্রতি বছর নবেম্বর মাসের তৃতীয় বৃহস্পতিবার বিশ্ব দর্শন দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। দর্শনের মূল লক্ষ্য হলো জ্ঞান ও সত্যের অনুসন্ধান। জগত ও জীবন সম্পর্কে স্বাধীন চিন্তার অধিকারী যে কোন ব্যক্তিই দার্শনিক। স্বাধীন চিন্তার অনুসারী হিসেবে সে আপোসহীন এবং লোভ ও মোহমুক্ত। সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সক্রেটিস হাসিমুখে মৃত্যুবরণ করেছেন। নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করেননি সার্ত্রে ও রাসেল। জি.সি. মনে করেন, দর্শন মানেই জীবনদর্শন। জীবনের সঙ্গে দর্শনের যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তার উদাহরণ পাই এরিস্টটলের ব্যাখ্যায়। তিনি বলেছেন, ‘আইনের ভয়ে অন্যরা যা করে থাকে, স্বেচ্ছায় ও আনন্দে তা-ই করতে প্রেরণা জোগায় দর্শন।’ এ ধরনের মনোভাব এবং স্বকীয়তাকে প্রকাশ করার ইচ্ছা যদি সভ্যসমাজের প্রতিটি মানুষের কাম্য হয় তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা চলে, দর্শন হলো : সব যুগের মানবসভ্যতার এক অসাধারণ অবদান ও অমূল্য সম্পদ। একজন সত্যিকার দার্শনিক মানে একজন আদর্শ মানুষ। দর্শনের উৎসে থাকে কৌতূহল। যাকে বলা যায় জিজ্ঞাসা। জিজ্ঞাসা থেকেই জ্ঞানান্বেষণের সূত্রপাত। জ্ঞান আবার ব্যাখ্যাও করে। পুরাতন ব্যাখ্যা নতুন ব্যাখ্যার জন্য পথ ছেড়ে দেয়। সেই পথ ধরে জ্ঞান ও ব্যাখ্যা উভয়ই এগিয়ে যায়। এই যাত্রার শেষ নেই। দর্শন বিভিন্ন ধরনের। আমরা বলি এবং মানি যে, সব উল্লেখযোগ্য বিষয়েরই একটা দর্শন থাকে। তবে এটাও আমরা জানি, দর্শনের সংখ্যা অসংখ্য হলেও দর্শনচর্চার ধারা দুটি-একটি ভাববাদী, অপরটি বস্তুবাদী। বস্তুবাদী ধারাটি বস্তুকেন্দ্রিক নয়, বস্তুর দ্বারা সেটি আকীর্ণ নয়; তবে বস্তুজগতের ওপর নির্ভরশীল বটে। এই ধারাকে ইহজাগতিক বললেও হয়ত আপত্তি থাকবে না। জ্ঞানের ক্ষেত্রে বস্তুর সঙ্গে মনের সম্পর্ক একটি অত্যন্ত পুরনো এবং প্রায় প্রাথমিক জিজ্ঞাসা। দর্শন বিজ্ঞানের বন্ধু ও সহযাত্রী। তবে এ দুয়ের ভেতর পার্থক্যও আছে। সেটা ঘটে এজন্য যে, দর্শনের তুলনায় বিজ্ঞান অধিকতর প্রায়োগিক। বিজ্ঞানেও তত্ত্ব থাকে; কিন্তু বিজ্ঞান তার তত্ত্বকে কখনোই প্রয়োগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে না। প্রয়োগের মাধ্যমে তাকে পরীক্ষা করে নিতে চায় এবং এভাবেই গ্রহণ-বর্জনের ভেতর দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। সেজন্য দেখা যায়, দর্শনের চাইতে বিজ্ঞানের চলিষ্ণুতা অধিক। বিজ্ঞানের আবিষ্কার উদ্ভাবনার কোন শেষ নেই। তৃপ্তি কাকে বলে বিজ্ঞান তা জানে না। যত তার জ্ঞান বাড়ে তত বৃদ্ধি পায় কৌতূহল। বিজ্ঞান ধরে নেয় শুধু আহরণ নয়, বিতরণেও জ্ঞান বিকশিত হয়। দর্শনের গুরুত্ব এই যে, সুস্থ সমাজ গঠনের লক্ষ্যে ভবিষ্যত প্রজন্ম ভালভাবে এগিয়ে যেতে পারবে জ্ঞানের প্রতি ভালবাসা থেকে। কারণ জ্ঞানই হলো শক্তি। ‘চযরষড়ংড়ঢ়যু’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থই হলো খড়াব ড়ভ ডরংফড়স বা জ্ঞানের প্রতি ভালবাসা। এই ভালবাসাই হলো দর্শন এবং এখানেই দর্শনের গুরুত্ব। জ্ঞানের প্রতি ভালবাসা থেকে জ্ঞানকে যে অর্জন করা সেটাই হবে শিক্ষা এবং শিক্ষাই দেবে ভবিষ্যতের পথ চলার আলো। শিক্ষা অর্জনের জন্য প্রয়োজন হবে চিন্তাশীল মনমানসিকতা এবং এই চিন্তাশীলতা হবে বিচারমূলক অর্থাৎ যুক্তিভিত্তিক। সুন্দর সমাজ গড়ে তোলার জন্য ইউনেস্কো দুটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। প্রথমত, ঋড়ৎবংরমযঃ বা দূরদৃষ্টি। সুন্দর এবং ভাল কিছু অর্জন করার ক্ষেত্রে দূরদৃষ্টির গুরুত্ব অপরিহার্য। যার দৃষ্টি সঙ্কীর্ণ এবং যে দূরের কিছু দেখতে পায় না বা অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে চিন্তা করতে পারে না, তার পক্ষে দূরে কোথাও যাওয়া কঠিন। এখানে দূরত্ব ভৌগোলিক অর্থে যেমন আছে, একইভাবে সময়ের দূরত্ব, উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যের দূরত্ব এসবও আছে। দ্বিতীয়ত, ন্যায়বিচার। বিচারমূলক চিন্তা এবং এর মধ্য দিয়ে দূরদৃষ্টি গঠন এ দুয়ের সমন্বয় থেকেই গড়ে ওঠে ন্যায়বিচার। ন্যায়বিচারের প্রত্যয় ঐতিহাসিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। প্লেটোর রিপাবলিক গ্রন্থে সক্রেটিসের আলোচনা শুরুই হয়েছে এ বিষয়টি নিয়ে। প্রতিটি মানুষ তার সামাজিক অবস্থানে থেকে সেই অবস্থান অনুযায়ী নিজ দায়িত্ব পালন করে যাবেÑ এটাই হলো ব্যক্তির ন্যায়পরতা। কিন্তু দায়িত্ব কিভাবে পালন করা হবে? একটি উপায় হতে পারে যে, মানুষ দায়িত্ব পালন করবে কর্তব্যবোধ দিয়ে। অন্য একটি মতাদর্শ হতে পারে যে, মানুষ দায়িত্ব পালন এমনভাবে করবে সেখানে লক্ষ্য হবে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের জন্য সর্বোচ্চ পরিমাণ সুখ অর্জন করা। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সুস্থ সমাজ গঠনের লক্ষ্যে এ দুটো মতাদর্শেরই গুরুত্ব আছে। কর্তব্যবোধকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। একইসঙ্গে এটাও স্বাভাবিক যে, মানুষ সুখী হতে চাইবে। এই প্রেক্ষিতে এ দুটো মতাদর্শের সমন্বিত রূপই হবে সুস্থ সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উপায়। এ দুটো মতবাদের মধ্যে কর্তব্যবাদকে পরিণতিমুক্ত মতবাদ বলা হয়। এখানে কর্তব্যের জন্য কর্তব্য করা হবে, কোনকিছু প্রাপ্তির জন্য নয়। বেদান্ত দর্শনে এমন মতবাদকে বলা হয় নিষ্কাম কর্মবাদ, অর্থাৎ এখানে কাজের পেছনে কোন কামনা-বাসনা থাকবে না, থাকবে কেবল কর্তব্যবোধ। এ মতের বিপরীত অপর মতটি হলোÑ যেখানে সুখের কামনা থেকে কাজ করা হবে। এই দ্বিতীয় মতটিতে কামনার বিষয় হিসেবে সুখকে বর্জন করব এবং সুখের পরিবর্তে কল্যাণকে গ্রহণ করব। কারণ, সুখের কামনার সঙ্গে জৈবিক প্রবৃত্তি ও ইন্দ্রিয় অনুভূতি যুক্ত থাকতে পারে এবং এমন প্রবৃত্তি ও অনুভূতি থেকে লোভ, হিংসা, মোহ গড়ে উঠতে পারে। এভাবেই ভারতীয় দর্শনের একটি মতাদর্শে বলা হয়েছে যে, সুখী হওয়ার জন্য প্রয়োজনে ঋণ করে হলেও ঘি খাওয়া যাবে। এমন অবস্থা বর্জন করার জন্যই জন স্টুয়ার্ট মিল বলেছেন যে, ‘সুখী চতুষ্পদ প্রাণী হওয়ার চেয়ে অসুখী মানুষ হওয়া ভাল এবং সুখী বোকা মানুষ হওয়ার চেয়ে অসুখী সক্রেটিস হওয়া ভাল।’ কিন্তু পার্থক্য এই যে, বিচারমূলক চিন্তা বা দূরদৃষ্টি না থাকলেও সুখকে চাওয়া এবং পাওয়া যেতে পারে। অন্যদিকে কল্যাণের ধারণাটিই বিচারমূলক চিন্তা ও দূরদৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, সুস্থ সমাজ গঠনে ভবিষ্যত প্রজন্ম কল্যাণমূলক কর্তব্যবাদকেই বেছে নেবে; কর্তব্য করা হবে মানব কল্যাণের জন্য এবং এর মধ্য দিয়েই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। বর্তমান বিশ্ব এক জটিল সময়ের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। এ সমস্যা পরিত্রাণের উপায়স্বরূপ ইউনেস্কো দিবসটি ঘোষণা দেয়। মানুষ তার প্রখর বুদ্ধি বলে প্রযুক্তিকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। সুদূর মঙ্গল গ্রহে মনুষ্যযান পৌঁছেছে। কিন্তু এটিও সত্য যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে গতিতে উন্নতি ঘটছে, মানুষের মানবিকতা ও নৈতিক চেতনাবোধের সেভাবে উন্নতি ঘটেনি; বরং অবনতিই ঘটছে। একটি দেশ তখনই সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি লাভ করতে পারে, যখন সে দেশের মানুষ তাদের দেশের উন্নতি ও কল্যাণের প্রয়াসে নৈতিক চিন্তা করে। দেশ পরিচালনাকারী ও সমগ্র রাষ্ট্রের মধ্যে যদি নৈতিক এবং সৎ ভাবনা বিরাজ করে তাহলে দেশের উন্নতি ও কল্যাণ অবশ্যই ঘটবে। দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা পাবে। এখানেই দর্শনের গুরুত্ব। আজ সময় এসেছে নিজের দেশ তথা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় নৈতিক দর্শনকে উপলব্ধি করার। ২০১৭ সালের বিশ্ব দর্শন দিবসকে সামনে রেখে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় প্রার্থনা করি ‘অন্তর মম বিকশিত কর অন্তরতম হে নির্মল কর, উজ্জ্বল কর, সুন্দর কর হে’। লেখক : এম-ফিল গবেষক ও দর্শনের শিক্ষক
×