ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকাবাসীর দুঃখ গাথা!

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ২৮ অক্টোবর ২০১৭

ঢাকাবাসীর দুঃখ গাথা!

জলজট আর যানজটে নাকাল নগরবাসীÑ এরকম খবরের শিরোনাম মাঝেমাঝেই হয়ে থাকে। অবস্থা এমন যে, ঢাকা এখন দুই ঘণ্টার বর্ষণ যেন সইতে পারে না। বিষয়টি নিয়ে সরকারী-বেসরকারী নানা ফোরামে ব্যাপক আলোচনা সত্ত্বেও কোন এক অদৃশ্য কারণে প্রতিবছর মার্চ-এপ্রিল থেকে মে-জুন মাসে বর্ষা মৌসুম এলে তড়িঘড়ি করে ড্রেনেজ ব্যবস্থা সংস্কারের কাজ হাতে নেয়া হয়। এই সংস্কার করতে গিয়ে রাস্তা এবং ড্রেনগুলো কেটে রাখা হয়। এতে রাস্তার পানি ড্রেনে নামতে পারে না আর কাটা ড্রেনে যে পানি জমা হয়ে থাকে তা কোথাও যেতে পারে না। অন্যদিকে পানি নিষ্কাশনের জন্য ঢাকা শহরে যে খালগুলো ছিল সেগুলোর প্রায় সবই ভরাট করে নিজেদের কাজে লাগিয়েছে ভূমিদস্যুরা। দুই ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই ঢাকা শহরের অনেক এলাকার রাস্তা দেখা যায় না। পাড়া, মহল্লা, গলিপথ তলিয়ে যায়। যানজট ঢাকাবাসীর নিত্যসঙ্গী, তারপরেও এ জলজটের সঙ্গে যুক্ত হয় তীব্র যানজট। স্থবির হয়ে পড়ে সবকিছু। অফিস আদালতে কাজকর্ম হয় না বললেই চলে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রমও বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন কর্তৃপক্ষ। একটি দেশের রাজধানী শহরের এ হাল। দিন যত যাচ্ছে ঢাকা যেন এক ব্যর্থ নগরে পরিণত হতে চলেছে। রাস্তার বিভিন্ন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষেরও অভাব নেই। সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও রাজউক আছে যারা এ নগরের বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা দেখভাল করে থাকেন। এত সংস্থার দেখভালই কী আমাদের জন্য কাল হয়েছে? এই সংস্থাগুলো কারও সঙ্গে কেউ সমন্বয় করে কাজ করেন না এটি বহু বছর আগের কথা। নগরের পানি ব্যবস্থাপনাও নগর পরিকল্পনার একটি অংশ। সেই হিসেবে নগর পরিকল্পনাবিদগণ পরিকল্পনা দেন কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয় না। পরিকল্পনার মধ্যে যে কতভাবে কাঁচি চালানো হয় তার কোন হিসাব নেই। এই কাঁচি চালকদের খপ্পরে পড়ে আজ অন্য ক্ষেত্রের মতো নগর ঢাকাও পানিতে সয়লাব হয়। এখন বর্ষাকাল আর দুই মাসে সীমিত নেই। মার্চ মাস থেকে বর্ষা শুরু অক্টোবর মাস শেষ হতে চলেছে তবু বর্ষার শেষ নেই। অনেক বছর থেকেই যদিও সারা ঢাকা শহরে বর্ষা মৌসুমে রাস্তা খোঁড়া একাধিক সেবাদানকারী সংস্থার একটি রেওয়াজ। তার ওপর এবছর দীর্ঘ বর্ষা। ফলে নগর জীবন ওষ্ঠাগত। এ বর্ষা মৌসুমেই এক সংস্থা খোঁড়া শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে আর এক সংস্থা এসে খোঁড়া শুরু করে। কারও সঙ্গে কারও সমন্বয় নেই। একটার পর একটা প্রজেক্ট বানিয়ে এই পুকুরচুরি আর কত! কেমন সংস্কার বা উন্নয়ন কাজ করা হয় যে প্রতিবছর সুয়ারেজ লাইন সংস্কার করতে হয়; রাস্তা সংস্কার করতে হয় বা অন্য কোন সংস্কার কাজে খোঁড়াখুঁড়ি করতে হয়? এ ব্যাপারগুলো গভীরভাবে খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে উন্নয়নের চেয়ে প্রজেক্টগুলোতে দুর্নীতিই যেন মুখ্য বিষয়। এ অনাকাক্সিক্ষত খোঁড়াখুঁড়ির কারণে সীমাহীন যানজট জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে। আবার এরই মধ্যে চলে রাজপথে অবৈধ পার্কিং, ফুটপাথ দখল করে অবৈধ দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্য! মনে হয় যেন বাবা-মা হীন এক এতিম নগরের বাসিন্দা আমরা। এই মুহূর্তে ঢাকার রাস্তা যদি কেউ দেখেন মনে হবে না যে এই শহরে কোন কর্তৃপক্ষ আছে। ঢাকা শহরের অনেক রাস্তা গর্তে গর্তে ভরে গেছে। মনে হবে যেন এটিই রাস্তার ডিজাইন। কয়েক বছর থেকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন কংক্রিটের রাস্তা করার জন্য। কিন্তু সেই নির্দেশের তোয়াক্কা না করে রাস্তাগুলো প্রতিবারই সংস্কার করা হয় পিচের রাস্তা হিসেবে। ছয় মাসও স্থায়ী হয় না এই রাস্তা। অল্প সময়ে গর্তে ভরে ওঠে রাস্তাগুলো। অন্যদিকে কংক্রিটের রাস্তা টেকসই হয় বছরের পর বছর। কংক্রিটের রাস্তা এজন্য করা হয় না যাতে প্রতিবছর রাস্তা সংস্কার বাবদ বাজেট বের করা যায়। প্রকল্প আর বরাদ্দ মানেই তো দুর্নীতির সুযোগ। আর যার পরিণতি আমাদের অভাগা নগরবাসীর সীমাহীন ভোগান্তি। রাস্তার খানাখন্দের কারণে গাড়ির গতি কমে যায় যেটি নগরবাসীকে যানজটে নাকাল করে ছাড়ে। ঢাকায় বিগত ১০ বছরে যান চলাচলের গড় গতি প্রতি ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার থেকে ৭ কিলোমিটার পর্যন্ত নেমে এসেছে। এভাবে চলতে থাকলে ২০২৫ সাল নাগাদ এটি ঘণ্টায় ৪ কিলোমিটারে নেমে আসবে। যেটি হেঁটে চলার গতির চেয়েও কম। হেঁটে চলার গড় গতি হচ্ছে ৫ কিলোমিটার। ঢাকার যানজটের কারণে দিনে ৩২ লাখ কর্ম ঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক ‘টুওয়াডর্স গ্রেট ঢাকা: এ নিউ আরবান ডেভলপমেন্ট প্যারডাইম ইস্টওয়ার্ড’ বিষয়ক প্রতিবেদনে এমনই তথ্য তুলে ধরেছে। গত দেড় দশকে ঢাকা শহরে বেশ কিছু ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে। এখনও শহরে নির্মাণযজ্ঞ চলছে। ক’দিন আগেও মগবাজার-মালিবাগ এলাকায় একান্ত বাধ্য না হলে কেউ যেতে চাইতেন না। ওই এলাকায় নির্মাণ যজ্ঞের প্রভাব এতটাই ছিল যে রাস্তা আর চলতে চাইত না। সেখানে নানাভাবে স্থবিরতা বিদ্যমান ছিল। ওই এলাকার স্থবিরতা সারা ঢাকা শহরেই প্রভাব ফেলতো। নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ায় এখন খানিকটা উন্নতি হয়েছে। আর ফ্লাইওভারগুলোও অনেক ক্ষেত্রে কতটা কাজে লাগছে সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকে যায়। যথাযথ নক্সা বাস্তবায়ন না হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্প গ্রহণ আর বাজেট খরচ করার রুটিন কাজে পরিণত হয়ে দাঁড়িয়েছে এগুলো। যেমন একটি উদহারণ দেয়া যায় মগবাজার ফ্লাইওভারের একটি অংশ সোনারগাঁ হোটেলের সামনে এসে নেমেছে। এতে করে সোনারগাঁ ক্রসিংয়ে যানজট লেগেই থাকে। এটি সেখানে না নেমে সোনারগাঁ ক্রসিং পার করে পান্থ পথে নামলে নিশ্চই কাজে লাগত। এরকম বেশ কিছু অসঙ্গতি নিয়েই এগুলোর জন্ম হচ্ছে। এগুলো এক সময় কংক্রিটের জঞ্জালে পরিণত হবে কীনা সেটিও ভাববার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে যানবাহনের তুলনায় ঢাকার রাস্তার স্বল্পতা একটি স্বীকৃত বিষয়। ক’দিন আগে এক টিভি টকশোতে একজন বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ বলছিলেন, ‘একটি পানির লাইনে পাইপের মাঝে কিছু জায়গায় মোটা পাইপ লাগানো হলে আর পুরোটা চিকন পাইপ থাকলে কী পানির ফ্লো বাড়বে?’ ঢাকার রাস্তার দশা ঠিক অনুরূপ। ফ্লাইওভারের মাধ্যমে কিছু জায়গা মোটা হয়ে উঠছে আবার ফ্লাইওভার থেকে নামলে সেই সরু রাস্তা। ফলাফল যানজট। ঢাকার মধ্যবিত্তের চলাচলের বাহন গণপরিবহন। পর্যাপ্ত গণপরিবহনও নেই বলেই চলে। যাও আছে সেটি জোড়াতালি দিয়ে চলে। এ গণপরিবহনে কী পরিমাণ নৈরাজ্য ভুক্তভোগীমাত্রই জানেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অনেক কষ্টে একটি পরিবহন পেলে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছোটেন নগরবাসী। দীর্ঘ অপেক্ষা, রাস্তার যানজট সবমিলিয়ে দশ কিলোমিটার রাস্তা নগরবাসীকে এক শ’ কিলোমিটার পাড়ি দেয়ার মতো সীমাহীন কষ্ট ভোগ করতে হয়। এরকম আরও নানান সমস্যা গ্রাস করছে ঢাকাবাসীকে, যেটি একটি নিবন্ধে লিখে শেষ করা সম্ভব নয়। এভাবেই ঢাকাবাসীর প্রতিদিনের সকাল হয়; দিনে শেষে রাত আসে। সমস্যার সমাধান যেন হতে চায় না। যতদিন যায় সমস্যা যেন পাহাড়ে রূপ নেয়। অনেকেই এ নিয়ে লিখেন, টিভি টকশোতে আলোচনা করেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা; কে পড়ে কার লেখা। এই তো এভাবেই চলছে ঢাকার জীবন! লেখক : বিটিভির অনুষ্ঠান সঞ্চালক [email protected]
×