ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

শেখ হাসিনা ॥ মাদার অব হিউম্যানিটি

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

শেখ হাসিনা ॥ মাদার অব হিউম্যানিটি

সমকালীন বিশ্বে এখন সবচেয়ে রাজনৈতিক এবং মানবিক ইস্যু বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার গণহত্যা থেকে কোনরকমে প্রাণ বাঁচিয়ে কক্সবাজারে আসা রোহিঙ্গাদের সার্বিকভাবে আশ্রয়দানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ববিবেকের নেতৃত্ব দিয়ে প্রমাণ করলেন মানবাধিকার সুরক্ষায় তিনি বর্তমান সময়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, মাদার অব হিউম্যানিটি। তাঁর মতো মাতৃ-মমতায় দুস্থ মানুষের পাশে ক’জন পারে দাঁড়াতে। আগেও এমনি মানবিক ইস্যুতে তিনি সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন; কিন্তু নোবেল শান্তি কমিটি গুরুত্ব দেয়নি। কেন দেয়নি সে কেবল তারাই বলতে পারবে। এবার সঠিক মূল্যায়ন না হলে বুঝব নোবেল কমিটি নিরপেক্ষ নয়। তারপরও এই লেখার মাধ্যমে আমি আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিচ্ছি নোবেল শান্তি পুরস্কারের মান রাখুন। গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমারে কয়েকটি পুলিশ ফাঁড়ি লুট এবং মিলিটারি ক্যাম্পে আক্রমণ করে বেশ কয়েকজন (সম্ভবত ১৩ জন) সেনা সদস্যকে হত্যা করে বলে জবাবে মিলিটারি জান্তা রোহিঙ্গা মুসলিম এলাকায় গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় এবং নির্বিচারে মানুষ হত্যা করতে শুরু করে। এ অবস্থায় প্রাণ বাঁচাতে দলে দলে রোহিঙ্গারা সমুদ্র (বঙ্গোপসাগর) পাড়ি দিয়ে নাফ নদী অতিক্রম করে বাংলাদেশের কক্সবাজার উপকূল, উখিয়া, কুতুপালং, টেকনাফ প্রভৃতি এলাকায় আশ্রয় নেয়। মূলত ১৯৭৮ সালে মিলিটারি জিয়ার আমল থেকেই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ শুরু করে। ২৪ আগস্টের আগ পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা ওই অঞ্চলে অবস্থান করছিল। গত কয়েকদিনে আরও ৪ লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে এবং আমাদের উপকূলমুখী রোহিঙ্গা স্র্রোত অব্যাহত আছে। তাদের মধ্যে নারী, শিশু ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সংখ্যাই বেশি এবং এভাবে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে এক মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে চলেছে। এরই মধ্যে গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপদ্রুত এলাকা সফর করেন এবং ঘোষণা করেন ‘¸anmar has to take back its nationals...denouncing the atrocities unclashed by the military in Rakhine state as act against humanity and violation of human rights.’ এই মুহূর্তে প্রায় ৮-৯ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজার অঞ্চলে মানবেতর জীবনযাপন করছে। শেখ হাসিনা তাদের সান্ত¡না দেন এবং এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলেন। মানবিক বিপর্যয় তাঁর মাতৃহৃদয়কে আপুøত করে এবং তিনি চোখের জল রাখতে পারছিলেন না। বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানাও সঙ্গে ছিলেন এবং তিনিও চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন একজন শরণার্থীও না খেয়ে থাকবে না। সকলকে আশ্রয়ের সঙ্গে সঙ্গে সবরকম সহায়তা দেয়া হবে। তবে হ্যাঁ, ‘¸anmar has to take back its nationals and give them safe place to live in their homeland, International community shoud put pressure on ¸anmar as it is committing such atrocities against rohingha people... this has to be stopped’ (ডেইলি স্টার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭)। মনে পড়ে ১৯৭১ সালের কথা। যখন পাকিস্তানী মিলিটারি জান্তা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার ও গণহত্যা শুরু করে তখন ১ কোটি বাঙালী পার্শ্ববর্তী ভারতের পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করে। তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী শরণার্থী শিবির দেখতে আসেন ও মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র দেখে কেঁদে ফেলেন এবং শেখ হাসিনার মতোই শরণার্থীদের মায়ের মমতায় আশ্রয় ও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আকাশবাণীতে যে বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন তাতে করে বিশ্ববিবেকে নাড়া দিয়েছিল। মঙ্গলবার কক্সবাজারে শেখ হাসিনার কান্নাজড়িত কণ্ঠের ঘোষণাও বিশ্ববিবেককে নাড়া দেয় এবং এরই মধ্যে ঢাকার বিদেশী কূটনীতিকগণ কক্সবাজার সফর করে সাহায্যের হাত বাড়াবার এবং শেখ হাসিনার পাশে থাকার প্রতিশ্রুতিও দেন। প্রথমদিকে অবশ্য চীন ও ভারত মিয়ানমারে তাদের বাণিজ্যের স্বার্থে তেমন সাড়া না দিলেও শেখ হাসিনার প্রতি বিশ্বের সমর্থনের প্রেক্ষিতে তারাও মত পাল্টাতে বাধ্য হয়েছে। এখন কথা উঠেছে আরাকান বা রাখাইন মুসলিম নাগরিকদের ওপর নির্যাতনের তদন্তের জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক গঠিত আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন করা হোক। রিপোর্টে বলা হয়েছে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব এবং আবাস ফিরিয়ে দিতে হবে। আরেকটি ব্যাপার খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর গণহত্যা শুরু করলে মানুষ কেউ শরণার্থী হয়ে, কেউ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে ভারতে গেছে। কিন্তু মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা কোন স্বাধীনতা ঘোষণা করেনি, তাদের কোন একক নেতৃত্বও নেই। বরং তাদের সশস্ত্র সংগঠন অনেকগুলো। রয়েছে বাংলাদেশের জামায়াত এবং তাদের পেছনে রয়েছে পাকিস্তানের আইএসআই। এরাই দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা বস্তি স্থাপন করে তাদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে আসছে। বাংলাদেশের শরণার্থীরা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর দেশে ফিরে এসেছে; কিন্তু মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা একবার এলে আর ফেরত যাওয়ার নাম করছে না। বরং কিছু সংখ্যক গায়ের চামড়া ও ভাষার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের সমাজে মিশে যাচ্ছে। কেউ কেউ নাগরিকত্ব কার্ড, পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে চলে যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে জামায়াত-আইএসআই তাদের সহায়তা দিচ্ছে। রোহিঙ্গা স্র্রোত এখনও থামছে না। ধারণা করা হয়, মিয়ানমারে এখনও ৮-১০ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। আগামী দিনগুলোতে তারা এলে বাংলাদেশ এই ভার সইতে পারবে না। পারলেও কেনইবা সইবে? এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন- ‘Rohingha have to go back their homeland and the ¸anmar gov. has to give them a safe homeland to live in.’ রোহিঙ্গাদের স্বদেশ মিয়ানমারের ডি ফ্যাক্টো গণতন্ত্র নেত্রী আউং সান সুচিকে আগেই নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। আমি মনে করি তার প্রাপ্য ছিল এজন্য যে, তিনি মিয়ানমারকে (সাবেক বার্মা) সামরিক জান্তার কবল থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটিয়েছেন। এর জন্য তাকে এবং তার দল এনএলডিকে অনেক জেল-জুলুম-নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। মনে পড়ে ১৯৮৯ সালের কথা। আমি তখন দেশের সর্বাধিক প্রচারিত এবং ক্র্যাডিবিলিটির দিক দিয়ে শীর্ষে অবস্থানকারী দৈনিক পত্রিকা ইত্তেফাকের রিপোর্টার। আমার একটা অভ্যেস ছিল অফিসে হাতে কাজ না থাকলে টেলিপ্রিন্টারের নিউজ আইটেম দেখা। একদিন দ্বিপ্রহরে এমনি হাতের কাজ শেষ করে টেলিপ্রিন্টার থেকে কয়েকটি রিপোর্ট (সম্ভবত রয়টার্স বা এপি) এনে টেবিলে বসে চা খেতে খেতে দেখছিলাম। একটি রিপোর্ট দেখে চোখ আটকে গেল। প্রতিবেশী বার্মার গণতন্ত্রী নেত্রী আউং সান সুচি গ্রেফতার এবং অন্তরীণ। সেইসঙ্গে মিলিটারি জান্তা তার দলের শত শত নির্বাচিত পার্লামেন্ট মেম্বার এবং নেতাকর্মীকেও জেলে পুরেছে। ওই সময়টা ছিল বাংলাদেশেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মিলিটারি স্বৈরশাসক এরশাদের উৎখাতের চূড়ান্ত পর্যায়ের আন্দোলনকাল। বলে রাখা ভাল শেখ হাসিনার মতোই আউং সান সুচিও সে দেশের জাতির পিতা জেনারেল আউং সানের কন্যা। বাংলাদেশে যেমন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পিতা এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাঙালী জাতি ও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে মিলিটারি জান্তা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিল, তেমনি বার্মাতেও (মিয়ানমার) সুচির পিতা এবং স্বাধীন বার্মার জাতির পিতা জেনারেল আউং সানকে হত্যা করে মিলিটারি জান্তা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। সুচি তখন লেখাপড়া শেষ করে বিদেশে (প্রথম দিল্লী ও পরে লন্ডন) অবস্থান করছিলেন। শেখ হাসিনাও ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট একমাত্র ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে জার্মানিতে গবেষণারত স্বামী অণু বিজ্ঞানী ড. এম ওয়াজেদ মিয়ার কাছে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান। বাবা-মা-ভাই সব হারিয়ে অসহায় অবস্থায় বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের মহীয়সী রাষ্ট্রনেতা ইন্দিরা গান্ধীর আশ্রয়ে দিল্লীতে দীর্ঘ সাড়ে ৬ বছর অবস্থান শেষে মিলিটারি জান্তাবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দাবিতে দেশে ফিরে আসেন এবং পিতার শূন্যস্থান পূরণ করেন ও আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ১৯৮১ সাল থেকে। আউং সান সুচিও বার্মার মিলিটারি জান্তাবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দাবিতে রেঙ্গুন ফিরে আসেন এবং নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন। বাংলাদেশে যেমন মিলিটারি জান্তা ছিলেন জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ, তেমনি বার্মাতেও মিলিটারি জান্তা নে উইন ও তার উত্তরসূরিরা রাষ্ট্রক্ষমতায়। দু’জনের মধ্যে অদ্ভুত এক মিল। দু’জনই জাতির পিতার কন্যা এবং দু’জনই মিলিটারি জান্তার জেল-জুলুমের শিকার। আমি এর ওপর একটি রিপোর্ট বানালাম এবং বার্তা সম্পাদক গোলাম সারওয়ারকে দিলাম। শেখ হাসিনাকে পুরো ঘটনাটি জানালাম এবং সুচির মুক্তি দাবি করে একটি বিবৃতিও তৈরি করে তাকে পড়ে শোনালাম। তিনি ওকে করলে এই বিবৃতিও গোলাম সারওয়ারের কাছে দিলে তিনি ইত্তেফাকে ছেপে দেন। আমার জানা মতে সুচির মুক্তির দাবিতে সেটিই প্রথম প্রেস বিবৃতি। কাজেই আমার মনে হয় রোহিঙ্গাদের প্রশ্নে সুচি এতখানি নিষ্ঠুর হতে পারেন না। এখানে বলে রাখা দরকার সুচির রাজনৈতিক দল ছিল এনএলডি বা ঘধঃরড়ধষ খবধমঁব ভড়ৎ উবসড়পৎধপু. সামরিক জান্তা নির্বাচন দিলে সুচির নেতৃত্বে আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতৃত্বকে ৪০৪ আসনের পার্লামেন্টের অধিকাংশ আসনে নমিনেশন দেন। ছাত্রদের ক্ষোভও ছিল। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় জেনারেল নে উইন রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয় মেশিনগান দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এটি নির্বাচনে ইয়ং জেনারেশনকে সুচির পক্ষে সংগঠিত করে এবং ৪০৪ আসনের পার্লামেন্টে সুচির এনএলডি ৪০০ আসনে জয়লাভ করে। এর পরই শুরু হয় সুচিকে গ্রেফতারসহ মিলিটারি জান্তার নতুন করে জেল-জুলুম। শুরু করেছি নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে। শেখ হাসিনা অনেক কারণেই নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার দাবি রাখেন : ১. মিলিটারি শাসন বা সামরিকতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণ; ২. একাত্তর-পঁচাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও খুনীদের বিচার করে আইনের শাসন এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা; ৩. আলোচনার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃ-গোষ্ঠী, সশস্ত্র বিদ্রোহের শান্তিপূর্ণ সমাধান; ৪. একটি খাদ্য ঘাটতি ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত অনুন্নত গরিব দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করা অর্থাৎ খাদ্যে উদ্বৃত্ত দেশে রূপান্তরের পাশাপাশি শিক্ষা, চিকিৎসা, গড় আয়ু, রাষ্ট্রীয় রিজার্ভ, জিডিপি ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রের সূচীকে অনেক উন্নত দেশকেও পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া এবং ৫. সর্বশেষ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয় দিয়ে মানবাধিকার রক্ষার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন তাতে করে তিনি ইউরোপ-মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটে জার্মানির চ্যান্সেলর এ্যাঞ্জেলা মেরকেলকেও ছাড়িয়ে গেছেন। তাই তার মূল্যায়ন এখন সময়ের দাবি। ঢাকা-১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি জাতীয় প্রেসক্লাব [email protected]
×