ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

ফিরে দেখা ২১ আগস্ট, ২০০৪

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ২২ আগস্ট ২০১৬

ফিরে দেখা  ২১ আগস্ট, ২০০৪

(গতকালের পর) একে শেখ হাসিনার ওপর বোমা বা গ্রেনেড হামলা ধরে নিয়ে আমরা তখনি তার চারপাশে মেয়র হানিফের নেতৃত্বে মানব-দেয়াল গড়ে তুললাম। এরপর আবার আর একটি ফ্লাস আমার চোখ ধাঁধিয়ে ট্রাকটি পার হয়ে উত্তর-পশ্চিমে ট্রাক থেকে প্রায় ৫ গজ দূরে গিয়ে পড়ল। দেখলাম আইভি রহমানের দেহ রাস্তা থেকে প্রায় ৪ ফুট ওপরে উঠে নিচে পড়ে গেল। এই মুহূর্তে মেয়র হানিফ চিৎকার করে শেখ হাসিনাকে বসে পড়তে বললেন। নেত্রী বসে পড়লেন; কিন্তু মাথা উঁচু করেই রইলেন। স্কোয়াড্রন লিডার (অব.) মামুন তার বাম হাত টেনে তাকে শুয়ে পড়তে ইশারা করলেন। তিনি ডেকের ওপর লম্বালম্বি করে তার দু’হাত বিছিয়ে দিয়ে পশ্চিম দিকে ঝুঁকে গেলেন; কিন্তু মাথা নোয়ালেন না। আমরা সবাই ঝুঁকে ও হাঁটু আধা গেড়ে তার ওপর ও চারদিকে মানব-দেয়াল দৃঢ়তর করলাম। এভাবে ঝুঁকে যাওয়ার সময় আমি বাঁ হাতে প্রবীণ নেতা জিল্লুর রহমানকে টেনে ট্রাক-ডেকে শুইয়ে দিলাম। যদ্দুর মনে পড়ে দ্বিতীয় ব্লাস্টটির পর ৫ থেকে ১০ সেকেন্ডের মধ্যে আরও পাঁচটি ব্লাস্ট হয়েছিল। মনে হলো শেখ হাসিনা ঐ দুজন ফটোগ্রাফারের অনুরোধে যদি ট্রাকের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে পোডিয়ামের দিকে সরে না আসতেন এবং আমরা তাকে বসিয়ে তার চারধারে মানব-দেয়াল গড়ে না তুলতাম তাহলে ঐ গ্রেনেডের একটি বা দুটি তাকে সরাসরি আঘাত করত। যদ্দুর মনে পড়ছে ৭ম ব্লাস্টটির পর গ্রেনেড বা বোমা হামলায় যেন খানিক বিরতি এল। এই সময়ে দেখলাম শেখ হাসিনার বুলেটপ্রুফ জীপটি ধীরে ধীরে ট্রাকটির দিকে, ডানদিকে সামান্য ঘুরে তিনি তাতে উঠলেই যাতে জীবটি ট্রাকটিকে বাইপাস করে তা যেতে পারে সেজন্য এগোচ্ছে। আমরা ভাবলাম তাকে জীপের দিকে নিয়ে গিয়ে জীপে উঠাতে পারলে তিনি নিরাপদ হবেন। হামলা শেষ হয়েছে ভেবে সহযোগীরা প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে তাকে ট্রাক থেকে নামার অস্থায়ী সিঁড়ি ধরে নামিয়ে জীপের সামনের সিটের দিকে নিয়ে গেলেন। স্কোয়াড্রন লিডার (অব.) মামুন সিঁড়ির ওপর থেকে ঢালের মতো দাঁড়িয়ে তাকে প্রতিরক্ষণ দিয়েছেন, সহকারী হাজী নজীব ও তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা অফিসার মেজর (অব.) শোয়েব নিচে দাঁড়িয়ে তাকে নামতে সাহায্য করেছেন। এরূপ প্রতিরক্ষণ ও সহায়তা নিয়ে নেত্রী মাথা উঁচু করে ট্রাক থেকে নেমে তার জীপে উঠলেন। তার জীপে উঠা এবং তার জীপের দরোজা বন্ধ করার সাথে সাথে জনতার ভিড় যেন তার দিকে উপচে এল। এই সময় তার দিকে বন্দুক/পিস্তলের গুলি আসার আওয়াজ শুনলাম। গুলিগুলো জীপের উইন্ডশীল্ডে, দরোজার গ্লাস প্যানে ও দু’পাশের স্টিল-বেড়ায় লাগছিল। মনে হলো পূর্বদিকের দু’পাশ ও ট্রাকটির উত্তর ও দক্ষিণ দিক এবং এ্যাভিনিউর দক্ষিণ দিয়ে পেট্রোল পাম্পের দিকের রাস্তা থেকে তাকে লক্ষ্য করে গুলিগুলো ছোড়া হচ্ছিল। জীপের বুলেটপ্রুফ উইন্ডশীল্ড ও জানালার গ্লাসপ্যান শেখ হাসিনাকে এসব ব্লাস্ট ও বুলেট থেকে রক্ষা করেছিল। জীপের বামপাশের দরোজা শেখ হাসিনার জন্য খুলে তাকে তুলে দিয়ে দেহরক্ষী মাহবুব (অবসরপ্রাপ্ত ল্যান্স নায়েক) জীপের পেছনে গিয়ে উঠতে চাচ্ছিলেন। এই সময় আমি আরেকটি ফ্লাসের ঝিলিক দেখি ও ব্লাস্টের আওয়াজ শুনতে পাই। মনে হলো এই সময় একটি গ্রেনেড জীপটির প্রায় ৩ ফুট উত্তরে গিয়ে পড়েছে। গ্রেনেডের স্পিøন্টার এবং সম্ভবত পিস্তল বা রিভলবার থেকে বেরিয়ে আসা একটি বা দুটি গুলি মাহবুবকে আঘাত করে। তিনি সেখানে মৃত্যুবরণ করেন। গ্রেনেডের স্পিøনটার জীপটির গায়েও লেগেছে মনে হলো। অন্যদের মধ্যে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও মেজর (অব.) শোয়েব জীপটির পেছনে বামদিকে উঠে দাঁড়ান। জীপটি ডানদিকে একটু ঘুরে সামনে পূর্বদিকে ধীরে ধীরে রাস্তায় ছড়ানো লাশগুলো এড়িয়ে দলের কর্মীদের দিয়ে সৃষ্ট পথ ধরে চলে যায়। নেত্রীর প্রতিরক্ষণের জন্য সরকার প্রদত্ত পুলিশ ভ্যানটি এই সময় কোথাও দেখা যায়নি। পরে জেনেছি প্রথম ব্লাস্টের পরপরই ভ্যান ও ভ্যানে নিয়োজিত পুলিশরক্ষীরা অকুস্থল থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। জীপটির পেছনে সাদা পোশাকের পুলিশরক্ষীসহ পুলিশ ভ্যানটি যা আগে থেকেই জীপের পেছনে দাঁড়ানো ছিল, জীপটিকে অনুসরণ করে। এর পেছনে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত কর্মচারী আরোহিত একটি এসইউভি চলা শুরু করে। অন্য পুলিশ ভ্যানটি কিছু সময় নিয়ে জীপটির অনুসারী হয়। পরে আমি শুনেছি যে, এই পুলিশ ভ্যানটির সরকারী চালক অকুস্থান থেকে পালিয়ে যাওয়ায় শেখ হাসিনার এক ব্যক্তিগত অনুচর এটি চালানোর ভার গ্রহণ করেন। গ্রেনেড বা বোমা হামলার সময় শেখ হাসিনার জন্য সরকার কর্তৃক নিয়োজিত পুলিশরক্ষীগণ তাকে রক্ষা করার জন্য কোন অবস্থান নেয়নি, তাদের কাছে দেয়া অস্ত্র ব্যবহার করেনি, কিংবা যারা তাকে আক্রমণ করেছিল তাদের ধাওয়া করেনি। পরে আমি জেনেছি যে, জীপটি ঐ দুটি গাড়িসহ সুধা সদনে প্রায় ২০ মিনিট পরে পৌঁছেছিল। হামলা শেষে জানা গেল শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতাকে তাক করে সেদিন সর্বমোট ১১টি গ্রেনেড ছোড়া হয়েছিল। প্রথম গ্রেনেডটি সিটি হোটেল ইমারত থেকে ছোড়া হয়েছিল বলে মনে হয়েছে। দ্বিতীয়টি একই গতিপথ অনুসরণ করেছিল। অন্যগুলো রাজ্জাকস নামীয় দোকান সংবলিত ইমারত থেকেও ছোড়া হয়ে থাকতে পারে। এটি সম্ভবত রমনা ভবনের পূর্বপাশে উত্তর থেকে দক্ষিণে যাওয়ার সড়ক, যা পেট্রোল পাম্প স্ট্রিট নামে অভিহিত, থেকেও ছোড়া হয়ে থাকতে পারে। ট্রাকের চারপাশে জনতার মাঝে লুকিয়ে আততায়ীরা সম্ভবত গ্রেনেড ছোড়েনি। ওসব স্থান থেকে ছোড়া হয়ে থাকলে যে বা যারা ছুড়েছিল তাকে বা তাদের (গ্রেনেড ছোড়ার পর যে গ্রেনেড ছুড়েছে সে প্রতিরক্ষণবিহীন হয়ে যায়) সহজে শনাক্ত করা ও ধরা যেত। পিস্তল/রিভলবারের গুলি সম্ভবত ট্রাকের উত্তর-পশ্চিম কোণ থেকে প্রশিক্ষিত পেশাদাররা জনতার ভিড়ে লুকিয়ে থেকে ছুড়েছিল। রাইফেল/বন্দুকের গুলি দু’পাশের ইমারত, সম্ভবত উত্তর-পূর্বদিকের রাজ্জাকস নামীয় দোকানের সামনে থেকে এবং দক্ষিণ-পূর্ব কোণের সিটি হোটেল ইমারত থেকে ছোড়া হয়েছিল। গ্রেনেডগুলো পরে আর্জেস ৮৪ লেখা গ্রেনেড হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছিল। এসব গ্রেনেড দেশের বাইরে, সম্ভবত অস্ট্রিয়ায় তৈরি। এগুলো সশস্ত্র প্রশিক্ষণ বা ঐ ধরনের যুদ্ধে ব্যবহার্য। এগুলো হয় সেনাবাহিনীর জন্য আমদানি করা, কিংবা দেশের অভ্যন্তরে বা প্রতিবেশী দেশের সীমান্ত এলাকায় সন্ত্রাসী তৎপরতা চালনার জন্য চোরাচালান করে আনা হয়েছিল। পরে নেত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা অফিসার মেজর (অব.) শোয়েব আমাকে বলেছেন, এই ধরনের গ্রেনেড (আর্জেস ৭৪-৮৪) বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ব্যবহার করে। তিনি আরও বলেছেন যে, কয়েক মাস আগে চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরির প্রত্যন্ত এলাকার জেটি দিয়ে অস্ত্র চোরাচালানের সময় পুলিশ যেসব গ্রেনেড আটক করেছিল বলে দেখানো হয়েছে, এসব ঐ ধরনের গ্রেনেড। জানা যায়, যেসব গ্রেনেড ছোড়া হয়েছিল তার মধ্যে ৩টি ফাটে নাই। পরে পুলিশ এগুলো উদ্ধার করে এদের ফরেনসিক, ধাতুগত বা বিস্ফোরক ক্ষমতা পরীক্ষা না করেই ফাটিয়ে ধ্বংস করেছিল। মেজর (অব.) শোয়েব বলেছেন, অবিস্ফোরিত এসব গ্রেনেড নিরাপত্তার জন্য হুমকি ছিল না এবং পুলিশ সেনাবাহিনীর সহায়তায় এগুলো যেভাবে ও যে সময় ফাটিয়েছে, সেভাবে ওসময়ে সেগুলো ফাটানোর প্রয়োজন ছিল না। আমার বিবেচনায় এভাবে গ্রেনেডগুলো ফাটিয়ে বেআইনীভাবে সাক্ষ্যমূলক উপাদান নিশ্চিহ্ন করা হয়েছিল। আমার জানা মতে পরে বা কোন সময়েই পুলিশ অকুস্থল থেকে গুলির খোসা, পুড়ে যাওয়া স্পিøন্টার, বুলেট বা পেলেট বা এই নারকীয় ঘটনার সম্ভাব্য সাক্ষ্য-প্রমাণাদি সংগ্রহ বা উদ্ধার করার কোন চেষ্টা করেনি। শেখ হাসিনার যাওয়ার পর আমি মাথা তুলে ও সামনে পাশে চেয়ে দেখলাম, ট্রাকের দক্ষিণে, পশ্চিমে ও উত্তরে রক্তমাখা অনেক লাশ, আহত লোকজন এবং দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গাদি রাস্তায় ছড়িয়ে আছে। আমি লক্ষ্য করেছি পূর্বদিক থেকে একটি পুলিশ ভ্যান এসে ট্রাকটার দক্ষিণ-পূর্বদিকে থামল, ৫/৬ জন পুলিশ ভ্যান থেকে লাফিয়ে নেমে লাশগুলো, কয়েকজন আহত মানুষ ও বিচ্ছিন্ন হাত-পা ট্রাকে উঠিয়ে ঘুরে দ্রুতগতিতে পূর্বদিকে চলে গেল। এই পিকআপ ভ্যানটি ট্রাকের পশ্চিমে বা উত্তর দিক থেকে আসেনি। ট্রাকের উত্তর ও পশ্চিম দিকে ছড়ানো লাশ ও আহত মানুষজনকে আমাদের দলীয় কর্মীরা এ্যাম্বুলেন্স, মাইক্রোবাস, গাড়ি ও রিক্সা ভ্যানে পাঠাতে থাকেন। কর্মীরা যখন মৃত ও আহতদের নিয়ে ব্যস্ত এবং অন্যরা দলের কেন্দ্রীয় অফিস ও আশপাশের দোকানগুলো ও রাস্তার পূর্বপ্রান্তের দিকে নিরাপত্তার জন্য দৌড়ে যাচ্ছিলেন তখন পুলিশ তাদের ওপর বেধড়ক লাঠিচার্জ করে ও টিয়ারগ্যাসশেল ছোড়ে। গোলাপশাহ মাজারের দিক থেকেও টিয়ারগ্যাস ছোড়া হয়। শৃঙ্খলা রক্ষার মোড়কে এর চেয়ে অধিকতর নিন্দনীয় অন্য কোন কাজ পুলিশ এ সময় করতে পারে বলে ভাবতে পারিনি। এভাবে লাঠিচার্জ করে ও টিয়ারগ্যাস ছুড়ে সম্ভবত পুলিশ অপরাধীদের অকুস্থল থেকে নিরাপদে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছিল। যে সংখ্যক পুলিশ তখন বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে মোতায়েন ছিল, সে সংখ্যক পুলিশ ইচ্ছা করলে বা নির্দেশ করলে পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে সকল ব্যক্তিকে তালাশ করে অপরাধীদের খুঁজে বের করতে পারত। এ তারা করেনি বা তাদের করতে দেয়া হয়নি। প্রাথমিক শক কাটিয়ে উঠে ট্রাকে দাঁড়িয়ে আমি দেখলাম আমার গায়ের কুর্তা পাজামা রক্তে ভিজে গেছে। আমি ভেবেছি গ্রেনেডের স্পিøন্টার বা গুলি আমার শরীরে লেগেছে, ঘটনার শকে ¯œায়ু কাজ করেনি বলে শরীরে কোন ব্যথা অনুভব করছি না। চার বছর আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে প্রথমদিকে এমনি আমি শরীরে কোন ব্যথা অনুভব করিনি। চলবে... লেখক : সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা
×