ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু

প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং আমাদের আগাম প্রস্তুতির ঘাটতি

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ১৪ আগস্ট ২০১৬

প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং আমাদের আগাম প্রস্তুতির ঘাটতি

ইংরেজীতে ‘চৎবাবহঃরড়হ রং নবঃঃবৎ ঃযধহ পঁৎব’ নামক একটি প্রবাদ আছে। যার অর্থ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। আমাদের দেশের মানুষকে প্রতিবছরই ভাগ্যদেবীর আশীর্বাদস্বরূপ যেসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়ে নানা সমস্যায় জর্জরিত হতে হয় বন্যা তার মধ্যে অন্যতম। বিগত বছরগুলোর মতো চলতি বছরও দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যা পরিস্থিতি মারাত্মক আকারে দেখা দেয়। এ বছর ১২টি নদীর ১৭টি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী চলতি বছর বন্যা বিপর্যয়ে ৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে পানিতে পড়ে মৃত্যু হয়েছে ৩৬ জনের। ডায়রিয়া, চর্মরোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত হন তিন হাজার ২২ জন। বন্যাক্রান্ত জেলাগুলোয় মূলত মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছিল। বন্যাক্রান্ত জেলাগুলোর মধ্যে ছিল কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুর। সরকারী হিসাব অনুযায়ী চলতি বছরের বন্যায় প্রায় ১৫ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে বহু ফসলি জমি, রাস্তা-ঘাট। স্কুল-কলেজসহ ওইসব এলাকার অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হয়। বন্যায় বসতবাড়ি ডুবে যাওয়ার কারণে মানুষ আশ্রয় নেন বাঁধ বা উঁচু স্থানে। পানিবন্দী এসব মানুষের দিন কেটেছে অর্ধাহারে-অনাহারে। বন্যার্তরা ত্রাণ বা সহায়তা খুব একটা পাননি বলে বানবাসি এসব মানুষকে শেষ পর্যন্ত ত্রাণ সহায়তার দাবিতে মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ করতে হয়েছে, যা রীতিমতো দুঃখজনক এবং বিবেককে নাড়া দেয়ার মতো একটি বিষয়। বন্যায় অধিকাংশ স্থানে নলকূপ ডুবে যাওয়ায় খাবার পানির তীব্র সঙ্কটও দেখা দেয়। এসবের পাশাপাশি ছড়িয়ে পড়ে পানিবাহিত নানা রোগ। খাবার না থাকায় অনেকে গবাদিপশু বিক্রি করে দিয়েছেন। চলতি বছরের বন্যায় প্রথম আক্রান্ত হয় সীমান্তবর্তী জেলাগুলো। সেসব জেলা থেকে এখন পানি নামছে, সেইসঙ্গে বাড়ছে ভাঙ্গনের তীব্রতা। দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলার বিপুলসংখ্যক মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে এক প্রকার বাধ্য হয়েছেন। দেখা গেছে উত্তরাঞ্চলের পানি কমতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে মধ্যাঞ্চল প্লাবিত হতে শুরু করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতিবছর দেশে বন্যা হলেও বন্যা মোকাবেলায় সরকারসহ জনগণের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি থাকে না কেন? কেন বন্যা প্রতিরোধ করার জন্য উপযুক্ত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হয় না? এক্ষেত্রে সমস্যা বা গাফিলতি কোথায়? আবার সরকার বিভিন্ন সংস্থা-সংগঠনসহ সকলের পক্ষ থেকে চলতি বছর বন্যাকবলিত মানুষের জন্য উল্লেখযোগ্য তেমন কী করা হয়েছে? দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রীকে অবশ্য বলতে শোনা গেছে, বন্যাক্রান্ত এলাকায় ত্রাণের অভাব নেই। তিনি হিসাব দিয়েছেন, ৫ থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত ১৩ হাজার টন চাল পাঠানো হয়েছে। মাননীয় মন্ত্রীর হিসাবেই ১৬ জেলার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। প্রায় ১০ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণভাবে এবং ১২ হাজারের বেশি আংশিকভাবে ক্ষতিগস্ত হয়েছে। সেই তুলনায় আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে স্থান পাওয়া মানুষের সংখ্যা নগণ্য। অসংখ্য মানুষ খোলা আকাশের নিচে দিনাতিপাত করেছেন, যা মানবতা বিপর্যয়ের ভয়াবহ রূপ। এসব মানুষের জন্য শুধু চালই যথেষ্ট নয়, বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি, শিশুখাদ্য, ওরস্যালাইনসহ জরুরী ওষুধপথ্যেরও প্রয়োজন ছিল। পাশাপাশি সরকারী ত্রাণসামগ্রী সুষ্ঠুভাবে বিতরণ করাও জরুরী ছিল। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরপরই বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ ব্যাপক আকারে দেখা দেয়। এক্ষেত্রে সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে পর্যাপ্ত ওষুধপথ্য, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরী ছিল। অবাক করা বিষয় এই যে, বন্যাকবলিত মানুষের সাহায্যার্থে সামাজিক উদ্যোগ চলতি বছরের বন্যার সময় দৃশ্যত অনুপস্থিত ছিল, যা সরকারের ত্রাণমন্ত্রী পর্যন্ত গণমাধ্যমের সামনে স্বীকার করেছেন। বেসরকারী উদ্যোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে বন্যা বা বন্যা-পরবর্তী সময় ত্রাণের যে সংস্কৃতি আগে ছিল, তা এখন যেন বিলুপ্ত হতে চলেছে, যা রীতিমতো অশনিসঙ্কেতই বটে। বিপুলসংখ্যক দুর্গত মানুষের দুঃখ-কষ্টের প্রতি সামাজিক সংবেদনশীলতার এমন অভাব সত্যিকার অর্থেই দুঃখজনক। বন্যাদুর্গত মানুষের প্রতি সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া আমার, আপনার সকলের নৈতিক দায়িত্ব এবং কর্তব্য। তবে এ কথা সকলেরই স্মরণ রাখা প্রয়োজন, বন্যাকবলিত হওয়ার পর বন্যার্তদের সাহায্য-সহযোগিতা করার চেয়ে বন্যা যে কোন মূল্যে প্রতিরোধ করার ব্যবস্থা করা উত্তম। কারণ, ‘চৎবাবহঃরড়হ রং নবঃঃবৎ ঃযধহ পঁৎব’। আগামী দিনগুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে যেন বন্যাক্রান্ত জেলাসমূহের বিভিন্ন জায়গা চিহ্নিত করে সঠিক উপায়ে বাঁধ নির্মাণ করা হয়, নদী তীরবর্তী এলাকাগুলোয় জিও টিউব (বালির বড় বড় বস্তা) ফেলাসহ এমন সব কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় যেন সহজেই বন্যা মোকাবেলা করা যায়। আর এসব সম্ভব হলে অর্থাৎ বন্যা মোকাবেলা করার সকল প্রস্তুতি পর্যাপ্ত হলে এবং শেষ পর্যন্ত তার সঠিক বাস্তবায়ন ঘটলে নিশ্চয়ই দেশের জনগণকে তখন আর চরম মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে না। লেখক : বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা [email protected]
×