ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

দাউদ হায়দার

বেনোজলে কেউটে সাপও আছে!

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১২ আগস্ট ২০১৬

বেনোজলে কেউটে সাপও আছে!

গরিবের কথা বাসি হলে ফলে, এটা বেদবাক্য। গত বছর যখন বেনোজলের মতো শরণার্থীর স্রোত ইউরোপে, গ্রীস-তুরস্ক হয়ে, ইরাক সিরিয়া লিবিয়া আফগানিস্তান থেকে, গ্রীসই প্রথম হুঁশিয়ারি দিয়েছে, বেনোজলে কেউটে সাপও আছে। কেউটের সংখ্যা কত, বিশদ বলেনি। হাঙ্গেরীই প্রথম জানিয়েছে, উদ্বাস্তুর ভিড়ে প্রায়-চার হাজার ইসলামিক জঙ্গী আইএসও ঢুকেছে এবং আইএসের মূল আশ্রয়দাতা, সাহায্যকারী তুরস্ক। হিসাব কষে দেখিয়েছে, তুরস্কের নব্য সুলতানের (রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান) আসল খায়েস কী। আইএসের কাছ থেকে সস্তায় তেল কিনছে (প্রতিদিন ২৫ মিলিয়ন ডলার)। অন্যদিকে অস্ত্রও বিক্রি করছে তুরস্ক, স্বল্প দামে। সিরিয়ার আসাদকে সমূলে ধ্বংস করার জন্য তুরস্ক মরিয়া। কৈফিয়ত, কুর্দের সরাসরি সাহায্য করছেন আসাদ। তুরস্কের আবদারে আমেরিকাও শামিল সিরিয়ায় আইএস খতম করার নামে। তুরস্কই একমাত্র ইসলামী দেশ ন্যাটোকে জায়গা দিয়েছে ঘাঁটি করার (উত্তর তুরস্কে)। এই ঘাঁটি থেকেই মার্কিনী ড্রোন হামলা চালিয়েছে সিরিয়ার আইএস অঞ্চলে। আপাতত বন্ধ এখন। সেহেতু, তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থানের গোড়ায় মদদদাতা খোদ আমেরিকা। সুলতানের এই অভিযোগ মার্কিন কর্তারা অস্বীকার করলেও তুরস্ক মানতে নারাজ। সম্পর্কে ফাটল। মধ্যপ্রাচ্যের উদ্বাস্তু স্রোত নিয়ে তুরস্ক প্রথম থেকেই রাজনীতি শুরু করেছে। চাপ দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে। সুযোগও নিয়েছে বিস্তর, আর্থিকসহ নানা সুবিধাও। এমনকি, তুর্কিদের অবাধ যাতায়াত সেনেঘনভুক্ত দেশে, বিনা ভিসায়। ইইউতে ঠাঁইও দিতে হবে। উদ্বাস্তুর আশু সমস্যা সমাধানে শলাপরামর্শও পাকা হয়ে গিয়েছিল প্রায়। বাদ সাধে ব্রিটেন (তখনও ব্রেক্সিট গণভোট হয়নি), হাঙ্গেরী, পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, চেক রিপাবলিক । জোরালো যুক্তি এই, উদ্বাস্তু সে সমস্যা সাময়িক, যথাসময়ে সামালও দেয়া যাবে। কিন্তু তুরস্ক মূলত ইসলামী দেশ, এরদোগান ডিক্টেটর, গণতান্ত্রিক নন, সংবিধান এফোঁড়-ওফোঁড় করে, গায়ের জোরে এখন প্রেসিডেন্ট। গোটা দেশে স্বৈরাচারীর শাসন, বিরোধী দল নির্যাতিত, সংবাদপত্র তথা মিডিয়ার স্বাধীনতা নেই, মানবিকতা ও মানবাধিকার নেই। যারাই এরদোগানের বিরুদ্ধে হয় জেলে, নয় পলাতক, ইউরোপে আশ্রিত। অনেককে হত্যাও করা হয়েছে ইতোমধ্যে। অভিযোগের বয়ান কতটা পোক্ত, ব্যর্থ অভ্যুত্থান (ক্যু)-এর পরে প্রমাণিত। ভাবা যায় কি, ব্যর্থ অভ্যুত্থানে দেশের ১০৬ জন সামরিক জেনারেল জড়িত? দেড় হাজারের বেশি ডাক্তার-নার্স জড়িত? হাজারের অধিক বিচারক জড়িত? সাত হাজারের বেশি স্কুলশিক্ষক, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জড়িত? প্লেনের পাইলট, ট্রেনের চালক, ট্যাক্সি ড্রাইভার, মুদির দোকানদার, বার-রেস্তরাঁ-ক্লাবের কর্মী-মালিক জড়িত? ১৬৭ জন সাংবাদিকও জড়িত? সব মিলিয়ে কুড়ি হাজারের বেশি গ্রেফতার, বিচারাধীন। আসল কথা, এরদোগানের বিরুদ্ধে যারা, সমালোচক যারা, তাদের রেহাই নেই। তুরস্কে এমনই অবস্থা, বিদেশীরাও সন্দেহভাজন। ফল হয়েছে এই, ট্যুরিস্ট যাওয়া বন্ধ। তুরস্কের অন্যতম ব্যবসা ট্যুরিজম। ৩৬.০২ ভাগ। ইউরোপ, এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকার ট্যুরিস্ট। ইস্তানবুুলসহ ৮৭টি রিসোর্টে ট্যুরিস্টের সংখ্যা এতটাই কম, পর্যটন-ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত, ৭৫ ভাগ রিবেট (ছাড়)দিয়েও পর্যটক টানতে পারছে না। যেমন পারছে না ইউরোপ। গ্রীষ্ম মানেই ইউরোপে ভ্রামণিকের ঢলাঢলি, ছড়াছড়ি। গ্রীষ্মের ছুটিতে কম করেও ৩০-৪০ ভাগ ইউরোপিয়ান পৃথিবীর নানা দেশে ছুটি কাটাতে যান। ইউরোপে আসেন প্রায় দ্বিগুণ। হোটেল-রেস্তরাঁ-বার-ক্লাব ব্যবসা রমরমা। দোকানপাটে বিক্রি, ছাড়-দেয়া বহুদিনের কালচার। এই সময়, গ্রীষ্মে, বিস্তর ছাত্রছাত্রী কাজ করেন, সব ভেস্তে গেছে। ইউরোপে, বিশেষত জার্মানি-ফ্রান্স-বেলজিয়াম-স্পেন-ইতালি-হল্যান্ডে এবং অন্যান্য রাজ্য-শহরেও আইএসের আতঙ্কে পর্যটক এতটাই কম (সরকারী গণনায় ১০ ভাগও নয়), ট্যুরিজম ব্যবসায় ভয়ঙ্কর ঘাটতি, শহরে ট্যুরিস্ট চোখেই পড়ছে না। বার্লিনের ইন্ডিয়ান স্পাইস রেস্তরাঁর মালিক জসীম বললেন, ‘ভাইজান, কী আর কমু সামারেই বেশি ব্যবসা, অহন, খদ্দের কম, আহে না, হালার আইএস আমাগো ব্যবসা মারত্যাছে। হালাগো পাইলে জীবন্ত কবর দিমু।’ আন্তর্জাতিক ট্যুরিজম বোর্ড (বার্লিনে হেড অফিস) জানাচ্ছে, আইএসের ভয়ে ট্যুরিস্টরা জার্মানিসহ ইউরোপে আসছেন না, সংখ্যায় খুবই কম। বোর্ডের ডিরেক্টর ওয়াখিম গ্যোয়েরকে বললেন, আইএস এতটাই ভয়ভীতি ছড়িয়েছে, ইউরোপ দিশেহারা। ইউরোপে ১১ বিলিয়ন ব্যবসায় ধস। আইএস কেবল মানুষ হত্যাই করছে না, পর্যটন ব্যবসাও খতম করছে। ভবিষ্যতের দিনকাল আরও ভয়াবহ। গ্রীসের, হাঙ্গেরীর হুঁশিয়ারি শোনেনি, তুরস্ককে তোলায় দিয়েছে, এখন ঠ্যালা বুঝুক। দোষী জার্মান চ্যান্সেলর এ্যাঞ্জেলা মেরকেলও। মিথ্যে বলেননি। আগামী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বার্লিনে নির্বাচন। সব দলই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। গোটা দেশের চোখ বার্লিনের দিকে, প্রাথমিক জনমত জরিপে সিডিইউ (ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন) পিছিয়ে এসপিডি (সোশ্যালিস্ট ডেমোক্র্যাটিক পার্টি)-এর তুলনায় (সাড়ে ছয় ভাগ)। কেন্দ্রে যদিও সিডিইউ এসপিডি জোট সরকার (কোয়ালিশন), কিন্তু বার্লিন এসপিডির দখলে, মেয়র থেকে শুরু করে সিনেটের সব আসনেই। অবশ্য, দুই দশকের বেশি দখলদার। নানা রঙের, নানা ছবি সংবলিত (প্রার্থীর ছবি) নির্বাচনী পোস্টার-প্ল্যাকার্ড-হোর্ডিংয়ে রাস্তাঘাট-পার্ক-চত্বর সয়লাব। এএফডি (অল্টারনেটিভ ফ্যুর ডয়েচল্যান্ড)-এর প্রার্থীদের পোস্টারে লেখা, জার্মানির বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী কে? সিডিইউ বা চ্যান্সেলর এ্যাঞ্জেলা মেরকেলের নাম নেই, দরকারও নেই। কে দায়ী, স্পষ্ট। এএফডি শরণার্থী এবং বিদেশী-বিদ্বেষে মুখর, ইইউ (ইউরোপীয় ইউনিয়ন ) নিয়েও। দুই বছর আগে ছয়টি রাজ্যে ১৫ ভাগ ভোটও পেয়েছে। বার্লিন নির্বাচনে অঘটনও ঘটিয়ে দিতে পারে। যেমন পারে আগামী বছর নির্বাচনে ফ্রান্সে ম্যারি লে পেনের চরম দক্ষিণপন্থী দল। লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ফ্রাঁসোয়া ওলাঁন্দ ক্ষমতা হারাতে পারেন। লে লিবারেতছিয়ন পত্রিকার ভাষ্য, ম্যারির কাছে নয়, এ্যালান জুপে বা লিকোলাস সারকোজির কাছে। ম্যারি লে পেনের পয়লা ইস্যু শরণার্থী, ইসলামী জঙ্গী, সন্ত্রাসী। জনগণও ‘খাচ্ছে’ বেশ। ইসলামী জঙ্গী, সন্ত্রাস নিয়ে প্রত্যেকে আতঙ্কিত, ভয়ে দিশেহারা, আরও উস্কে দিচ্ছেন ম্যারি। সরকারও অবশ্য বসে নেই। প্রতিটি ট্যুরিস্ট-স্পটে, হোক তা ভার্সাই, নিস, মার্সাইয়ে পুলিশী টহলদারি, আনাগোনা, নজরদারি প্রতি মুহূর্তেই বুঝিয়ে দেবে নিরাপত্তার হরেক মহরত, ক্যারদানি। প্যারিসে আরও বেশি। কে বলেছে ক্লাব বাঁ তা ক্লা-য় হত্যাযজ্ঞের পরে প্যারিস আবার প্রাক-ছন্দে ফিরেছে? গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে এসেছি প্যারিসে, সপ্তাহ পেরিয়েছে ইতোমধ্যেই, প্রাক-ছন্দ দূরের কথা, স্বাভাবিক ছন্দেও ফেরেনি। বার্লিন-প্যারিস এপাড়া-ওপাড়া (প্লেনে ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট), ঘন ঘন কাজে প্রায়ই যাওয়া-আসা। কখনও দেখিনি প্যারিস সন্ধ্যার অন্ধকারের শুরুতে প্রায় জনশূন্য। মেট্রো-বাস অনেকটাই ফাঁকা। বার-রেস্তরাঁয় ভিড়, হল্লা নেই। এও বাহ্য। আইফেল টাওয়ার, পিগাল-অঞ্চলে (মুলা রুজসহ) দর্শক, ভ্রামণিক, স্ফুর্তিবাজের হুল্লোড়ও জমজমাট নয়। পুলিশ ও শাদা পোশাকে নিরাপত্তা কর্মী বেশি। শিল্পী শাহাবুদ্দীন, লেখিকা আনা ইসলাম (শাহাবুদ্দীনের স্ত্রী), শাহাবুদ্দীন-আনার কন্যা বললেন, সরকারী ভাষ্যেই (পর্যটন বিভাগের তথ্যে) এবার (গ্রীষ্মে) ইসলামী জঙ্গী-সন্ত্রাসের ভয়ে, আতঙ্কে ৪০ থেকে ৫০ ভাগ পর্যটক কম। রেস্তরাঁ, হোটেল ব্যবসায়ীর মাথায় হাত, চোখে অন্ধকার। নেপোয় দই মারছে স্পেন, ইতালি, হাঙ্গেরী, চেক রিপাবলিক, স্ক্যানডেনিভিয়া, এমনকি রাশিয়া (বিশেষত মস্কো, সেন্ট পিটাসবুর্গ)। গ্রীষ্মের তিন মাসে ইউরোপে (এবং তুরস্কে) পর্যটন-ব্যবসায় যে রমরমা, ভিসার বেলায় উদার, নানা রঙের মানুষের আনাগোনা, যৌনকর্মীদেরও আয়, ভেস্তে গেল আইএস তথা ইসলামী সন্ত্রাসী, জঙ্গীপনায়। প্যারিসের ডাকসাইটে দৈনিক লেঁ মদ লিখেছে (একটি প্রতিবেদনে), আইএস কেবল মানুষই হত্যা করছে না, ইউরোপসহ নানা দেশে পর্যটন ব্যবসাও খতম করছে। আইএসের সাফল্য আরও, রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থীদের উস্কে দিয়ে সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক দেশ বিভক্ত করছে। ইসলামকে যত বেশি তোল্লায় দেয়া হবে, আখের ঝরঝরে। এখনও সময় আছে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের নানা পন্থা, সমূলে ধ্বংস না করলে, দিনে দিনে বাড়ে কালকেতু। জমজমাট নয়। ফধঁফ.যধরফবৎ২১@মসধরষ.পড়স
×