ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

তুরস্কে অভ্যুত্থানÑএই ভীতি এরদোগানকে সামনের দিনগুলোতে তাড়া করবে

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ২০ জুলাই ২০১৬

তুরস্কে অভ্যুত্থানÑএই ভীতি এরদোগানকে সামনের দিনগুলোতে তাড়া করবে

আধুনিক তুরস্ক প্রতিষ্ঠা করেন মোস্তফা কামাল পাশা ১৯২৩ সালে। তিনি মোট ১৫ বছর ১২ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি আধুনিক তুরস্কের প্রথম রাষ্ট্রপতি হলেও পেশায় তিনি ছিলেন সৈনিক। তুরস্ক রাষ্ট্রটিতে সেনাবাহিনী যে বার বার ক্ষমতায় উঁকি দেয় তার বীজও কিন্তু রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সম্পর্কিত। কামাল আতাতুর্ক তুরস্ক রাষ্ট্রটির মান নির্ধারণ করেছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তির ওপর। তুরস্কের সেনাবাহিনী এই ভিত্তি মেনে নিয়েছে। প্রতিটা সেনা বিদ্রোহের পর তারা সে দাবি করেছে। তুরস্কে সেনা অভ্যুত্থান পাকিস্তানের মতো নতুন কিছু নয়। তবে পাকিস্তানীদের থেকে তুরস্কের সেনাবাহিনী চিন্তা-চেতনায় আধুনিক। দেশটিতে সেনা অভ্যুত্থান হয় ১৯৬০, ১৯৭১, ১৯৮০ এবং ১৯৯৭ সালে। প্রতিবার সেনাবাহিনী দাবি করেছে তারা রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বজায় রাখার জন্যই ওই হস্তক্ষেপগুলো করেছে। যথারীতি এবারও সাময়িকভাবে ক্ষমতা দখলের পরে বিদ্রোহী সেনারা গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বজার রাখার জন্যই এই অভ্যুত্থান বলে জানিয়েছিল। কিন্তু এবার টিকতে পারেনি। বলা হচ্ছে এই অভ্যুত্থান ঠেকিয়ে দিয়েছে জনগণের শক্তি। যদিও পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি থাকতে পারে। তবে যে কোন ষড়যন্ত্র জনগণ সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করে দিতে পারে। এই দৃষ্টান্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে। আসলে জনগণ যে কোন দেশের অন্তর্নিহিত শক্তি। জনগণ জনগণের কাজ করেছে, রাষ্ট্রকে রাষ্ট্রের কাজ করতে হবে। কারণ সামনের দিনে তুরস্কের সামনে চ্যালেঞ্জ অবিরাম বাড়তে থাকবে। বাড়তে থাকবে পারস্পরিক অবিশ্বাস। সরকার ও সেনাবাহিনীর মাঝে গোপনে বিরাজমান থাকবে সন্দেহ। তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের উত্থান একটি সাধারণ পরিবার থেকে। তার দল ‘জাস্টিস এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’ ২০০৩ সালে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসে। তারপর থেকে ইসলামিক ভাবাদর্শভিত্তিক দল দ্বারা পরিচালিত দেশটি মুসলিম বিশ্বের কাছে গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেলই ছিল। বিশ্ব এতদিন জানত দেশটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের সম্পর্ক মধুর। কিন্তু বিশ্ব ধাক্কা খেল এবং বলা যায় তুরস্কের সাধারণ জনগণও ধাক্কা খেল। তবে এবারে ইতিবাচক দিকও আছে, ক্ষমতাসীন দলটির মতাদর্শ তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও দেখা গেল অভ্যুত্থান ঠেকাতে জনগণের অভাবিত অংশগ্রহণ। এরদোগান যখন প্রথম ক্ষমতায় আসেন তখন তার প্রতি ছিল জনগণের বিপুল সমর্থন। তার কারণ হলো তিনি সেনাবাহিনীকে তুরস্কের রাজনীতি থেকে ব্যারাকে ফেরত পাঠাতে পেরেছিলেন ভালভাবে। কিন্তু গত এক দশকে তিনি অনেক ভুলও করেছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার, সাংবাদিকদের গ্রেফতারের, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিচিত ও পরিজনদের বসানোর, আমলাতন্ত্র থেকে অপচ্ছন্দের লোকদের সরিয়ে দেয়ার এবং দুর্নীতির। এসব কারণে তার বহু ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতা তাকে ছেড়ে দূরে সরে গেছেন। এরদোগানের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ সুহৃদ ছিলেন ফেতুল্লা গুলেন। ইনি একজন ধর্মপ্রচারক। গুলেনের সমর্থকরা হিজমত নামে একটি আন্দোলন করেন। হিজমত মানে হলো সেবা। সুফিবাদ এবং সব মানুষের সহাবস্থানের পক্ষে এই গোষ্ঠী আন্দোলন করেন। সাম্প্রতিক তুরস্কে এই আন্দোলন জনপ্রিয় হয়ে উঠলে এরদোগানের সঙ্গে গুলেনের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ২০১৩ সালে এরদোগানের ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছিল। তখন গুলেনের সঙ্গে এরদোগানের বৈরিতা প্রকাশ্য রূপ নেয়। এই সময় বহু বিচারক এবং সামরিক কর্মকর্তা গুলেনের পক্ষে অবস্থান নেন। সে সময় ক্ষুব্ধ এরদোগান ওই সব বিচারক ও সামরিক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করেন। বর্তমানে গুলেন দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে আমেরিকার পেনসিলভানিয়ায় থাকেন। সেনা অভ্যুত্থানে গুলেনকেই দায়ী করেছেন এরদোগান। তবে তুর্কী সেনাবাহিনীতে অস্থিরতাতে এরদোগানেরও দায় আছে। সিরিয়ার লড়াইয়ে দ্বৈত নীতি তার অবস্থান সম্পর্কে বিভ্রম তৈরি করেছে। সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রথমে তিনি বাসার আল আসাদবিরোধী শক্তিকে সমর্থন করেন। এই সময়ে তুরস্ক জিহাদীদের প্রিয় গন্তব্য হয়ে ওঠে। তখন আইএসে যোগ দেয়ার প্রধান রাস্তা হয়ে যায় তুরস্ক। আইএস অর্থ সংগ্রহের প্রধান হাতিয়ার তেল বিক্রি করত তুরস্কের মাধ্যমে। আবার আমেরিকা জোটের চাপে নিজের বিমানঘাঁটি আমেরিকাকে ব্যবহারের অনুমতি দেয় আইএসের বিরুদ্ধে। আইএসবিরোধী লড়াইয়ে কুর্দি যোদ্ধাদের কোবানেতে যাওয়ার অনুমতি দেয় তুরস্ক। আবার তুর্কী সরকারের বিরুদ্ধে কুর্দিদের রয়েছে ৩০ বছরের অবিরাম যুদ্ধ। সেই সূত্রে মিসরে মুরসির ক্ষমতার বিচ্যুতি এবং রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির প্রেক্ষাপটে কুর্দিদের সন্দেহের চোখে দেখা হয়। তার জেরে দক্ষিণ-পশ্চিমের কুর্দি বিছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন এরদোয়ান। কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আঙ্কারা, ইস্তানবুলে পাল্টা হামলা চালায়। অন্যদিকে আইএসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ায় তারাও ইস্তানবুল বিমানবন্দরে হামলা করে ৪২ জনকে হত্যা করে। এরকম হযবরল অবস্থায় এরদোগান আবার সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হন। পাশাপাশি রাশিয়া ও মিসরের দিকেও বন্ধুত্বের হাত বাড়াবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। এরকম পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর ভেতরে হতাশা তৈরি হয়। আর হতাশ সেনাবাহিনী সব সময় বিপজ্জনক। তবে অভ্যুত্থানটি ব্যর্থ হওয়ার এও একটি কারণ যে, সংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের অন্যতম বিশাল তুর্কী সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ সদস্যের সমর্থন এই অভ্যুত্থানে ছিল না। তুরস্কের অভ্যুত্থান চেষ্টার প্রভাব বোঝা যাবে ভবিষ্যতে। এই অভ্যুত্থানের লক্ষণীয় দিক হলো অভ্যুত্থান ঠেকানোতে মসজিদে মাইকের ব্যবহার। ধারণা করা যায় এই পথে রাষ্ট্রটি ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দিকে আরও ঝুঁকে যাবে। অনেক অপবাদ থাকলেও বর্তমান বিশ্বে রাষ্ট্র ক্ষমতায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রভাব এখনও মধ্যযুগ থেকে যোজন যোজন দূরেই ছিল। মধ্যযুগে রাষ্ট্র পরিচালনায় গির্জার শক্তি ছিল অসীম। তখন ইউরোপে টেটজেল বা পাপ মুক্তির সনদ বিক্রি করা হতো। রেনেসাঁর যুগে আরেক আধুনিক ধর্মপ্রচারক মার্টিন লুথার ধর্মের নামে এই অধর্মকে ঠেকিয়ে দেন। ইউরোপে রেনেসাঁয় তুরস্কের সংযোগ নিবিড়। ১৪৫৩ সালে অটোমানরা রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টানটিনোপল দখল না করলে গ্রীক প-িতেরা প্রাণ ভয়ে ইতালির বিভিন্ন নগর রাষ্ট্রে আশ্রয় নিতেন না। আর তা না হলে ইউরোপে রেনেসাঁ হতো না। রেনেসাঁ না হলে আজও পৃথিবী শাসন করত গির্জা ও সামন্তপ্রভুরা। পৃথিবী আধুনিক হতো না। কলম্বাস, পেত্রাক, লিওনার্দো, মাইকেল এ্যাঞ্জোলো কিংবা গ্যালিলিও, কোপার্নিকাস, কেপলারের জন্ম হতো না। পৃথিবীর ইতিহাস লিখে জয়ীরা, তবে পৃথিবীর বেশিরভাগ ইতিহাসের আসল জন্মদাতা পরাজিতরা। আমরা মনে রাখব, ১৯৩৮ সালে টাইম ম্যাগাজিন এ্যাডলফ হিটলারকে ‘ম্যান অফ দ্য ইয়ার’ নির্বাচন করে। সে হিটলারকে আজ ইতিহাস মনে করে খলনায়ক। বর্তমান বিশ্বের যে কোন সমস্যার মূলে আমেরিকার হাত আছে বলে বিশ্ববাসী বিশ্বাস করে। আজও আমেরিকায় স্কুলের চেয়ে কারাগারের বরাদ্দ বেশি। তার মানে সে সমাজে অপরাধী বেশি। অপরাধীরা যে ইতিহাস লিখে তার লাইফটাইম দীর্ঘ হওয়ার কথা নয়। পৃথিবীর অবমুক্ত জ্ঞানই তার দলিল। বলছিলাম তুরস্কের ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান নিয়ে। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ায় আপাতত প্রেসিডেন্ট এরদোগান সুরক্ষিত। কিন্তু প্রায় এক দশকের প্রতাপের শাসনের গদি কি একটু টলে গেল না! অভ্যুত্থানটি ব্যর্থ হলেও তার ভীতি আগামী দিনগুলোতে এরদোগানকে তাড়া করবে। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রটি অস্থিরতা দিকে চলে যেতে পারে। বিশ্বের শান্তির জন্য এটা আমাদের চাওয়া নয়। লেখক : ব্যাংকার
×