ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

জয় বাংলা যেভাবে ছিনতাই হয়ে যায়

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ৩ জুন ২০১৬

জয় বাংলা যেভাবে ছিনতাই হয়ে যায়

(গতকালের সম্পাদকীয় পাতার পর) একজন শিক্ষককে কান ধরানো অপরাধ ও এতে আইন ভঙ্গ হয়- এ কথা স্বীকার করে সেলিম ওসমান বলেন, শ্যামল কান্তি ভক্তকে বাঁচানোর জন্য তিনি তা করেছেন। ঈমানদার মুসলমানরা শিক্ষকের শাস্তি চেয়েছিলেন দাবি করে তিনি সাংবাদিকদের কাছে জানতে চান, ‘আমরা কি ইবলিসের রাজত্বে বাস করছি? আপনারা জবাব দেন।’ সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সেলিম ওসমান বলেন, সেদিন সকাল ১০টার দিকে ঘটনা শুরু হয়েছিল। আমি সেখানে গিয়েছি বিকেল চারটায়। গিয়ে দেখি, চার থেকে পাঁচ হাজার লোক সেখানে জড়ো হয়েছে। গিয়ে আমি শুনেছি ওই শিক্ষক এক ছাত্রকে মেরেছিলেন। ছাত্র পরে অসুস্থ হয়ে যায়। শিক্ষক বাজার থেকে ওষুধ এনে ছাত্রকে খাওয়ান। ওই ছাত্র আরো অসুস্থ হয়ে পড়ে। এর মধ্যেই ওই শিক্ষক ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করেছেন বলে এলাকার লোকজন তাকে গণপিটুনি দিয়েছিল। পুলিশ শিক্ষককে একটি ঘরে নিরাপত্তা দিয়ে রাখে। আমি সেখানে যাওয়া মাত্র এলাকার লোক আমাকে বলে ওই শিক্ষককে আমাদের হাতে ছেড়ে দেন, কিন্তু আমি কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চাইনি। আমি তখন শিক্ষকের কাছে যাই। তিনি ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তির কথা স্বীকার করেন। শিক্ষকের কাছে জানতে চাই তোমার কি শাস্তি হবে। তিনি যে কোন শাস্তি মাথা পেতে নেবেন বলে জানান। এরপর শিক্ষক নিজেই কান ধরে উঠবস করার প্রস্তাব দেন। এতে আমি রাজি হই। শিক্ষক স্বেচ্ছায় কান ধরে উঠবস করেন। আমি যা করেছি তা একজন মানুষের জীবন রক্ষার জন্য করেছি। সেলিম ওসমান বলেন, যেহেতু আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তদন্ত হচ্ছে এবং উচ্চ আদালতের রুল হয়েছে। তাই আমি এখন থেকে বিকেএমইএ, নারায়ণগঞ্জ চেম্বার ও এফবিসিসিআইয়ের কোন সভায় যাব না। ওই চেয়ারে বসব না। এমনকি জাতীয় সংসদেও যাব না। তদন্তে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে ওই পদগুলো ত্যাগ করব। সেলিম ওসমানের দাবি তিনিই শ্যামল কান্তি ভক্তকে হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করেন। হাসপাতালের সব চিকিৎসা খরচ তিনিই বহন করছেন। হাসপাতালে তার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ হচ্ছে। আজ (গতকাল) সকালেও কথা হয়েছে। স্বেচ্ছায় কান ধরে উঠবস করেছেন বলে সাংসদ সেলিম ওসমানের বক্তব্য শুনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত। তিনি জানান, সেদিন সেলিম ওসমান তার দুই গালে দুটি করে চারটি চড় মারে। এরপর বলেন, ‘শালা কান ধর’। ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করেননি জানিয়ে শিক্ষক বলেন, সেদিনের পুরো ঘটনাই সাজানো। গতকাল নারায়ণগঞ্জে খানপুরে ৩শ’ শয্যার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি গণমাধ্যম কর্মীদের একথা বলেন। শ্যামল নিজের নিরাপত্তা এবং সাংসদ সেলিম ওসমানকে বরখাস্ত করার দাবি জানিয়ে বলেন, তদন্ত কমিটি কি কাজ করেছে- না করেছে তা তো আমাকে বলতে হবে। তারা আমাকে কিছুই জানায়নি। তবে স্থানীয় তদন্ত কমিটির প্রতি আমার আস্থা নেই। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, মসজিদের মাইকে উত্তেজনা ছড়ানো হচ্ছিল। সবার কথা শুনে স্কুলে যাই। গিয়ে দেখি পরিস্থিতি ভিন্ন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে স্থানীয় কয়েকজন আমাকে পেটায়। বিকেলে সেলিম ওসমান ঘটনাস্থলে আসেন। আমার শরীর তখন একেবারেই দুর্বল। যে ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল, সাংসদ সেখানে ঢুকে কোন কথা না বলে দুই গালে দুটি করে চারটি চড় মারেন। লজ্জায় তখন আমার মাথা হেট হয়ে যাচ্ছিল। এরপর ঘর থেকে বের করে সাংসদ লোকজনের সামনে এনে বলেন, ‘শালা কান ধর। দশবার উঠবস কর।’ জীবন বাঁচাতে তা করতে বাধ্য হই। ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করেছিলেন কিনা জানতে চাইলে শিক্ষক বলেন, আমি কোন কটূক্তি করিনি। পুরোটাই সাজানো। স্কুল থেকে বের করতেই এসব ষড়যন্ত্র হয়েছে। শিক্ষককে সাংসদ সেলিম ওসমান ‘তারছেড়া’ বলেছেন। জানিয়েছেন, ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তির ব্যাপারে তার কাছে প্রমাণ আছে। শিক্ষকের পরিবার লিখিত দিয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শ্যামল কান্তি ভক্ত বলেন, ‘আমার স্ত্রী হাসপাতালে আছেন। তাকে ডাক দেন। এগুলো ভিত্তিহীন কথা।’ শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে গণধোলাই ও কান ধরে উঠবস করানোর ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নাগরিক সমাজের নেতারা। এ অবস্থায় প্রধান শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার ঘটনা তদন্তে পুলিশকে অনুমতি দিয়েছেন আদালত। গতকাল নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট অশোক কুমার দত্ত এ আদেশ দেন। বন্দর থানার এসআই মোকলেছুর রহমান সেদিনের ঘটনাকে মানহানিকর অপরাধ বিবেচনায় নেয়ার আবেদন জানালে তিনি এ আদেশ দেন।” (আমাদের সময়, ২০.৫.২০১৬)। এই ঘটনার পর আরেকজন সাংবাদিক নাফিজ আশরাফের সঙ্গে সাংসদ সেলিম ওসমানের কথোপকথনের একটি রেকর্ড প্রকাশ হয় ইউটিউবে। প্রায় ২০ মিনিটের কথোপকথন এখন ইউটিউবে পাওয়া যাচ্ছে। এই কথোপকথন যারা শুনেছেন তাদের মুখে রা সরছে না। সাংবাদিকদের অপছন্দ হলে সমালোচনা করা যায়। কিন্তু এ ধরনের সংলাপ! সেলিম জানিয়েছেন কথোপকথন ব্যক্তিগত। এটি অবশ্য একটি পয়েন্ট, ব্যক্তিগত পর্যায়ে তিনি একজনকে অনেক কথাই বলতে পারেন সেই ব্যক্তির আপত্তি না থাকলে। কিন্তু, বিষয়টি এখন পাবলিক হয়ে গেছে। ফলে, দোষারোপ করা হচ্ছে সেলিমকে যে, ব্যক্তিগত পর্যায়েও তিনি এমন গালাগাল দিতে পারেন কিনা যিনি তার বন্ধুস্থানীয় নয়। কারণ, তিনি এখন সংসদ সদস্য। শ্যামল কান্তির ঘটনার সঙ্গে এটির কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু মুক্তাঞ্চলের ‘বীর’ রা যে কতো ক্ষমতাশালী এই কথোপকথন তার প্রমাণ। আমি কয়েকটি বাক্য মাত্র তুলে ধরছি উদাহরণ হিসেবে। কেটে দেয়া শব্দগুলো পত্রিকায় ছাপানো যাচ্ছে না- সেলিম ওসমান : ‘কোন সাংবাদিকের... মারলাম না আমি।’ সেলিম ওসমান : ‘প্রেসক্লাবের... মারে না সেলিম ওসমান।’ সেলিম ওসমান : আপনারা প্রেসক্লাবের মধ্যে বইসা বইসা আমাদের চৌদ্দগুষ্ঠীর... মারতাছেন। আই এম ফাকিং দ্য প্রেসক্লাব।’ সেলিম ওসমান : ‘আজকে থাইকা দিয়েন না কাভারেজ, কাভারেজ এর... মারলাম না আমি।’ সেলিম ওসমান : ‘সাংবাদিকের... মারি আমি।’ সেলিম ওসমান : ‘টান বাজারের ...পাড়া আর প্রেসক্লাব একই জিনিস।’ সেলিম ওসমান : ‘প্রেসক্লাবের... মারলাম না আমি।’ পাঠক, এই লিংকে ক্লিক করলে এই কথোপকথনটি শোনা যাবে। https:/ww/w.youtube.com/watch?v=TU5-EioSNoQ এটা খুব স্বাভাবিক যে প্রভাবশালী ও দুর্বলের বিবরণ দু’রকম হবে। তবে, কয়েকটি বিষয়ে সবাই ঐকমত্য পোষণ করেছেÑ ১। শ্যামল কান্তি ছাত্র রিফাতকে চড়-থাপ্পড় দিয়েছিলেন। ২। রিফাতের মা সেজন্য অভিযোগ দাখিল করেন ম্যানেজিং কমিটির কাছে। ৩। কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে স্থানীয় মসজিদের মাইকে শ্যামল কান্তিকে অভিযুক্ত করে তাকে শায়েস্তা করার এ ঘোষণা দেয়া হয়। ৪। ‘জনতা’ শ্যামলকে গণধোলাই দেয়। ৫। যেভাবেই হোক শ্যামল আশ্রয় নেন স্কুলে। ৬। সেলিম ওসমান ১০টায় খবর পেয়ে বিকেল ৪টায় যান। ৭। তার সামনে শ্যামল কান ধরে উঠবস করে। ৮। পুলিশ-জনতা বিষয়টি উপভোগ করে। অনেকে আমোদিত হয়ে জয়বাংলা ধ্বনি দেয়। আগেই বলেছি, বিষয়টি হয়ত চুকেবুকে যেত। কিন্তু পরদিন ম্যানেজিং কমিটি শ্যামলকে বরখাস্ত করে। (চলবে)
×