ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

পাকিস্তানে তালেবানবিরোধী যুদ্ধের শেষ কোথায়?

প্রকাশিত: ০৪:১০, ১০ এপ্রিল ২০১৬

পাকিস্তানে তালেবানবিরোধী যুদ্ধের শেষ কোথায়?

পাকিস্তানী লেখক, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক মোহাম্মদ হানিফ করাচীভিত্তিক বিবিসি নিউজের সংবাদদাতা। তাঁর রচিত ‘এ কেস অব এক্সপ্লোডিং ম্যাংগোস’ সেরা গ্রন্থ হিসেবে কমনওয়েলথ পুরস্কারপ্রাপ্ত। দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘আওয়ার লেডি অব এলিস ভাট্টি’ জয় করেছে ওয়েলকাম বুক প্রাইজ। সম্প্রতি ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ক্যান পাকিস্তান ইউন ইটস ওয়ার এগেইনেস্ট তালেবান?’ শীর্ষক নিবন্ধে তিনি ইস্টার সানডেতে লাহোরে নারকীয় সন্ত্রাসী হামলার পটভূমিতে দেখাতে চেয়েছেন এই পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ থেকে দেশ আদৌ উদ্ধার পাবে কিনা। নিবন্ধটির ভাষান্তর করেছেন- এনামুল হক (শেষাংশ) এই যুদ্ধে বাহ্যত একটা সহজ স্লোগান আছে। তাহলো : ওরা বোমা মেরে আমাদের উড়িয়ে দিতে পারার আগে ওদেরকেই বোমায় উড়িয়ে দাও। আর ওরা যদি বাড়িঘর ছেড়ে চলে আসে ওদের খোলা আকাশের নিচে থাকতে দাও। কিছু আটা, রান্নার তেল ও কয়েকটা প্লাস্টিকের শিট দাও। ওদের ঐতিহ্যগত বীরত্ব ও আতিথেয়তার প্রশংসা করতে ভুলো না এবং তোমাদের সেনাবাহিনীকে সমর্থন দিতেও ভুলো না। কারণ তোমাদের রাস্তাঘাট নিরাপদ করার জন্য ওরা তোমাদের নাগরিকদের ওপর বোমাবর্ষণ করছে। সেনাবাহিনীকে সমর্থন দিতে গিয়ে কখনও কখনও আমাদেরই অবাক লাগে। তথাপি সেই বিস্ময় যাতে অনুচ্চ থাকে তা আমরা নিশ্চিত করি। এই কি সেই একই সেনাবাহিনী নয় যাদের বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের গুলি করে মারার অভিযোগ আছে? ইসলামাবাদে যারা তা-ব চালিয়েছিল সেই একই ব্যক্তিদের দিয়ে ‘আই লাভ মাই আর্মি র‌্যালিস’ আয়োজনে এই সেনাবাহিনীই কি ব্যস্ত ছিল না? এই সেনাবাহিনী দেশের সবচেয়ে বড় রিয়েল এস্টেট ব্যবসা চালাচ্ছে এটা কেমন কথা? এই বাহিনীর নজর কি করে যুদ্ধের ওপর নিবদ্ধ থাকবে যখন তারা ভাল ভাল জমি তাদের অফিসার ক্যাডারদের বরাদ্দ করার কাজে ব্যস্ত? আর যাই হোক আমরা তো রিয়েল এস্টেটের দালালদের আমাদের ট্যাঙ্ক চালাতে বলতে পারি না। আমরা কি অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছি সেই সূত্রগুলো তালেবানবিরোধী সামরিক স্ট্র্যাটেজিতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেটা পেতে গেলে রসুল (দ.)-এর উম্মতরা যে যুক্তি প্রদর্শন করে আসছে সেদিকে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। যে কোন জিহাদী মতাদর্শের চাইতে সেই যুক্তি অনেক বেশি পরিব্যাপ্ত। কারণ আমাদেরকে শুধুমাত্র রসুলের সম্মান নিয়ে এত ভাবলেই চলবে না, অন্য কোন নবীর অবমাননাও আমরা কাউকে করতে দিতে পারি না। সেই নবী যদি তাদের নিজেদের হয় তবুও না। যিশুর পোশাক ঠিকমতো ছিল না কেন? এই দেশে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে ও ঘুরে বেড়িয়ে আমি এমন একজনও অমুসলমান ধর্মপ্রচারকের দেখা পাইনি যিনি আমাকে তাদের ধর্মে দীক্ষিত করার চেষ্টা করেছেন। মুসলমানরাই বরং সর্বদা আমাদের আরও ভাল মুসলমান বানানোর চেষ্টা করে চলেছে। বছর দুয়েক আগে সিন্ধুর অভ্যন্তরভাগে মিরপুর খাস নামক এক শহরে রেলওয়ে পুলিশ আরেক ব্লাসফেমি বা ধর্মীয় অবমাননার ঘটনার কথা জানিয়েছিল। সেই রেলওয়ে পুলিশদের অনুভূতি আহত হওয়ার মতো ঘটনাটি ছিল এই যে, ট্রাভেল গাইড খুলে তারা যিশুর ছবি দেখতে পেয়েছিল যেখানে অভ্যাসগতভাবে তাঁর পরিধানে কটিবস্ত্র ছাড়া আর কিছু ছিল না। তার মানে প্রায় নগ্নদেহের একজন ধর্মীয় অবতার? এর চাইতে বড় নীতিবিরুদ্ধ ব্যাপার আর কি হতে পারে? এই যুক্তিটা তেমন এক স্থানে যথার্থই অর্থবহ যেখানে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাদের নিজেদের ধর্মীয় অবতার ছাড়া অন্য কোন ধর্মীয় অবতার দেখেনি। আজ যদি তারা কোন গির্জায় গিয়ে ঢোকে তাহলে এমন দৃশ্য দেখে আতঙ্কিত বোধ করবে যে, যিশুর পরিধানে খুব একটা বস্ত্র নেই। খ্রীস্টানরা তাদের নবীকে নিয়ে যা চায় তা করার ভার তাদের উপরই ছেড়ে দেয়া হোক না কেন! না, তা হতে পারে না। কারণ যিশু আমাদেরও নবী। পুনরুত্থান ঘটার পর যিশু খ্রীস্টান হিসেবে ফিরে আসবেন বলে সত্যিই কি কেউ বিশ্বাস করে? না, করে না। বরং অতীতের ভুলত্রুটি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে থাকলে তিনি সুন্নি হিসেবে ফিরে আসবেন। আশা করা যায় ততদিনে আমাদের সবচেয়ে জটিল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। অশ্লীলতার ব্যাপারে কী করণীয়? পার্কে বোমা বিস্ফোরণে যারা আমাদের উড়িয়ে দিতে চায়, ধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধাশীল হলে যারা হত্যা করার অধিকার দাবি করে তারা একটা ব্যাপারে একমত। তা হলো- সমাজে অশ্লীলতা ও কদর্যতা খুব বেশি মাত্রায় বিদ্যমান। এর কারণ হিসেবে তারা টেলিভিশনে অত্যাধিক নৃত্যগীত পরিবেশন এবং বিলবোর্ডের বিজ্ঞাপনে বেশি মাত্রায় নারীদেহ প্রদর্শনের কথা উল্লেখ করে থাকে। আমরা সবাই জানি যেখানে যুদ্ধ এমন দীর্ঘকাল ধরে চলে সেখানে শহরে নগরে অশ্লীলতা দেখা দিতে শুরু করে। কয়েক বছর আগে পেশোয়ারে শামা নামে একটি সিনেমা হল বোমা বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। ১১ জন নিহত হয়। আমরা অবাক হয়ে ভেবেছি কি ধরনের ছায়াছবি ঐ সিনেমা হলে দেখানো হয়ে থাকে। পরে জানা গিয়েছিল এমন ছবি যা বাচ্চাদের সঙ্গে দেখা যায় না। এ ধরনের ছায়াছবি লোকে দেখে এমন দেশগুলোর তালিকায় আমরা বাহ্যত শীর্ষে। কিছু কিছু তালিকায় আমাদের স্থান শীর্ষে অথবা নিচে। পোলিও রোগের তালিকায় পাকিস্তানের স্থান শীর্ষে। পৃথিবীতে এমন একটি দেশ কি আর আছে যেখানে বাচ্চাদের পোলিও টিকার ড্রপ খাইয়ে দেয়া নারী ও পুরুষকে সিরিয়াল কিলারের মতো খুঁজে খুঁজে বের করে হত্যা করা হয়? এর পিছনে যে ব্যাখ্যা হাজির করা হয় তা নিতান্তই অযৌক্তিক। পোলিও ড্রপ খাওয়ানোর উদ্দেশ্য নাকি আমাদের যৌন অক্ষম করে তোলা এবং এই কর্মসূচী নাকি সেই একই লোকেরা চালায় যারা আরেকটা ভুয়া টিকাদান অভিযান চালিয়ে ওসামা বিন লাদেনের অবস্থান বের করতে পেরেছিল। আমরা প্রায়শই দুর্নীতিগ্রস্ত শীর্ষ দশ দেশের তালিকায় থাকি। আমরা থাকি ভঙ্গুরতার সূচকে নিচের দিকের কোন এক জায়গায়। অর্থাৎ আমাদের অবস্থা বড় বেশি ভঙ্গুর। পাকিস্তানে জনপ্রিয় এমন একটি কাল্পনিক তালিকা অনুযায়ী আমরা বিশ্বে চতুর্থ সর্বাধিক বুদ্ধিমান জাতি। এ ধরনের আরেক অনির্ভরযোগ্য তালিকা অনুযায়ী পর্নো ছবির দর্শক হিসেবে বিশ্বে আমাদের স্থান শীর্ষে। কয়েক বছর আগে আমরা ‘সেক্স’ শব্দটা যত বেশি খুঁজে বেড়িয়েছি তেমনটা বিশ্বের আর কোন দেশ করেনি। ‘সেক্স’, ‘গার্ল’, ‘এ্যানিমেল’ বা ‘রুশদী’ শব্দগুলো যে কোন রূপেই থাক না কেন এমন বেশির ভাগ ওয়েবসাইট পাকিস্তানে ব্লক করে দেয়া হয়। এমন বাস্তবতাকে বিবেচনায় নেয়া হলে এটা বেশ বড়সড় এক অর্জন বলতে হয় (এবং সম্ভবত এর দ্বারা চতুর্থ সর্বাধিক বুদ্ধিমান জাতির তত্ত্বটিও সমর্থিত হয়)। শামা সিনেমা হলের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে উদ্ধারকাজ চলার সময় নবনির্বাচিত রাজনীতিকরা টিভি ক্যামেরার সামনে বসে মাথা নেড়ে মন্তব্য করছিলেন ‘এমন বর্বরতা কে সমর্থন করতে পারে? আমরা অবশ্যই এর নিন্দা করি। কিন্তু সিনেমা হলে তো ব্লু ফিল্ম দেখানো হচ্ছিল।’ এই ব্যাখ্যার মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করার কিছুই নেই। নৈতিকতার এসব রক্ষককে একথা জিজ্ঞাসা করার চিন্তাও আমাদের মধ্যে উদয় হয়নি যে, ব্লু ফিল্মের মতো মহামারী মোকাবেলার অপেক্ষাকৃত নমনীয় উপায় থাকার সম্ভাবনা তারা কি বিবেচনা করে দেখেছেন? যেমন, সিনেমা হল মালিককে নোটিস ইস্যু করা অথবা ব্লু-ফিল্ম যাতে না দেখানো হয় তা নিশ্চিত করতে পুলিশ পাঠানো। না, তা করা হয়নি। মনে হয়, পর্দায় প্রদর্শিত দৃশ্যাবলীর ক্লেদ থেকে নিজেদের পরিশুদ্ধ করে তোলার আকাক্সক্ষা আমাদের এতই সুতীব্র যে কয়েকজনকে বোমায় উড়িয়ে দিতেই হবে। আমাদের নৈতিকতার ওপর নজরদারি করার জন্য পুলিশের চাইতে মোল্লাদেরই যে বেশি পছন্দ তার হয়ত কারণ আছে। প্রাইভেট বাহিনী আমরা যুদ্ধে যাওয়ার বেশ আগেই নিজেদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং প্রাইভেট গার্ডদের বাহিনী গড়ে তুলতে শুরু করেছিলাম। মরচে ধরা রিভলভারধারী অবসরপ্রাপ্ত লোকজন থেকে শুরু করে ঝকঝকে বন্দুক ও ওয়াকিটকি আছে এমন শক্ত সবল তরুণদের দিয়ে এই বাহিনী গড়ে ওঠে। সাধ্য থাকলে এমন নিরাপত্তা কিনে নেয়া যায়। ওরা সাধারণত বড় বড় বাড়ির বাইরে ছোট তাঁবু খাটিয়ে থাকে। সদয় নিয়োগকর্তা ওদেরকে দেখার জন্য ছোট টিভি সেট দেন। ওদের সঙ্গে যে বন্দুক থাকে তার দাম তাদের সারা বছরের বেতনের সমান। কোন গাড়ি দ্রুত গতিতে আসতে দেখলেই তারা সজাগ হয়ে যায়। মাঝে মাঝে তারা নিয়োগকর্তার বাচ্চাদের স্কুলে অথবা ফুটবল খেলা দেখতে নিয়ে যায়। কখনও কখনও তারা মনিবের বাচ্চাদের জন্য ফাস্টফুডের দোকান থেকে খাবার কিনে নিয়ে আসে। যে দেশের বিমানবন্দর ও সেনাঘাঁটির নিরাপত্তা লঙ্ঘিত হয়; সে দেশের মানুষের নিজের নিরাপত্তা কিনে নেয়ার অধিকার থাকে। বিশেষ করে সেটা যদি তাদের সাধ্যের আয়ত্তের মধ্যে হয়।
×