ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও শেয়ারবাজার

প্রকাশিত: ২১:২৮, ৮ জানুয়ারি ২০২২

অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও শেয়ারবাজার

এটি সর্বজনবিদিত যে, করোনা অতিমারীর বিধ্বংসী আক্রমণে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় দেশই প্রচ- আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় উন্নয়নশীল ও অনুন্নত বিশ্বকে করোনা ভ্যাকসিন ও প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম ক্রয়-স্থাপনে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। লাখ লাখ মৃত্যুর মিছিল অবলোকনে মানবজাতি করুণ আর্তনাদে ছিল ভয়ঙ্কর বিপর্যস্ত। করোনা জয়ে বাংলাদেশ সফল হলেও বর্তমান ওমিক্রন সংক্রমণ নতুন করে অজানা আতঙ্ক-আশঙ্কা তৈরি করছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে জীবন-জীবিকার ভারসাম্য রক্ষার্থে বাংলাদেশ সরকারের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ ও কার্যকর বাস্তবায়নে অর্থনীতির চাকাকে সচল করার গৃহীত উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য, যে কোন ক্রান্তিকালে পর্যুদস্ত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে দেশকে নানামুখী প্রয়াসে গতিশীল করতে হয়। এক্ষেত্রে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান প্রণিধানযোগ্য উপজীব্য। পুঁজিবাজারের প্রকৃষ্ট সঞ্চারণে ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ধারাবাহিক চলমানতা অক্ষুণœ রাখার জন্য শেয়ারবাজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশের অবিন্যস্ত সঙ্কট উত্তরণে শেয়ারবাজারের বস্তুনিষ্ঠ-নৈর্ব্যক্তিক মূল্যায়ন আবশ্যক। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি বিংশ শতকের সফল বিনিয়োগকারী ও বিখ্যাত মার্কিন ব্যবসায়ী ওয়ারেন বাফেটের কয়েকটি বাণী শেয়ারবাজার পর্যালোচনায় বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি মনে করেন ‘শেয়ার কিনে ভুলে যাওয়াই ভাল, ধৈর্যশীল বিনিয়োগকারীদের কাছে সময় এক দারুণ বন্ধু হিসেবে আবির্ভূত হয়, ১০ বছর কোন শেয়ার ধরে রাখার ইচ্ছা না থাকলে তা ১০ মিনিটের জন্য কেনার কথা চিন্তাও না করা, শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে অন্যরা যখন অতি উৎসাহী হন তখন আমি ভীত হই, অন্যরা যখন ভীন হন তখন আমি সাহসী হই ইত্যাদি।’ তার পরামর্শ হচ্ছে, একটি কোম্পানির শেয়ার দশকের পর দশক ধরে রাখা। সর্বজনস্বীকৃত ধারণা এই যে, অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের উৎস হিসেবে শেয়ারবাজারের অবদান অনস্বীকার্য। শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি শক্তিশালী, নিরপেক্ষ, সুসংগঠিত ও স্বচ্ছ শেয়ারবাজার অপরিহার্য। শেয়ারবাজারকে অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্যতম সূচক বা জাতীয় অর্থনীতির প্রতিবিম্ব হিসেবেও গণ্য করা হয়। প্রতিটি উন্নত, উন্নয়নশীল, অনুন্নত দেশের অর্থনীতিতে শেয়ারবাজারের অবস্থান অত্যন্ত ইতিবাচক নির্ধারক। সাধারণত শেয়ার হলো কোন কোম্পানির মূল মালিকানার অংশ এবং শেয়ারবাজার হচ্ছে এমন একটি স্থান যেখানে বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী শেয়ার, স্টক, ঋণপত্র, সিকিউরিটিজ ইত্যাদি ক্রয়-বিক্রয় করা হয়। মূলত প্রত্যেকটি কোম্পানি বা ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন বৃদ্ধি বা মুনাফা অর্জন করার জন্য প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি দুই পদ্ধতিতে শেয়ার বিক্রি করে থাকে। স্টক এক্সচেঞ্জে রেজিস্টারের মাধ্যমে কোম্পানি বা ব্যবসার শেয়ার বিক্রি করা হয়। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইন, ১৯৯৩ জারির মাধ্যমে শেয়ার বা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থসংরক্ষণ, বাজারের উন্নয়ন এবং এতদসংক্রান্ত বিষয়াবলী বা প্রয়োজনীয় বিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে ১৯৯৩ সালের ৮ জুন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশের বৃহত্তম ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড (ডিএসই) ১৯৫৪ সালের ২৮ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হলেও এর বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৫৬ সালে এবং দ্বিতীয় চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড (সিএসই) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৫ সালে। শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে মালিকানা পরিবর্তন, রক্ষণাবেক্ষণ কাজে নিয়োজিত সেন্ট্রাল ডিপজিটারি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। দেশে ঢাকা ও চট্টগ্রাম এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে শেয়ার বেচা-কেনার কর্ম সম্পাদন হয়। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখ বিনিয়োগকারী রয়েছে। আমাদের সকলের জানা যে, ১৬০২ সালে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে বিশ্বের প্রথম আনুষ্ঠানিক স্টক এক্সচেঞ্জ আমস্টারডাম স্টক এক্সচেঞ্জের যাত্রা হয়েছিল। পরবর্তীতে কয়েক শতকে বিশ্বব্যাপী স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। স্টক এক্সচেঞ্জ পুঁজিপতিদের কারবার হওয়ার কারণে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশসমূহের স্টক এক্সচেঞ্জগুলো শীর্ষস্থানে রয়েছে। ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব এক্সচেঞ্জেস (ডব্লিউএফই)-এর সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে বাজার মূলধনের আকার বিবেচনায় বর্তমানে ২৩ লাখ ২৩ হাজার ৬৭৭ কোটি ডলার মূলধন নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্টক এক্সচেঞ্জ হচ্ছে ১৭৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ। এক্সচেঞ্জটির তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা প্রায় ২ হাজার ৩৫৬টি। ১২ লাখ ৫৮ হাজার ৪৩৫ কোটি ডলার মূলধন ও প্রায় ৩ হাজার ১০৬টি তালিকাভুক্ত কোম্পানি নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক আরেক স্টক এক্সচেঞ্জ নাসডাক। তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে জাপান স্টক এক্সচেঞ্জ, যার বাজার মূলধনের পরিমাণ ৬ লাখ ৫ হাজার ৭৬০ কোটি ডলার। চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে চীনের সাংহাই ও হংকং স্টক এক্সচেঞ্জ। তাদের বাজার মূলধনের আকার হচ্ছে ৫ লাখ ১০ হাজার ৫৮৪ কোটি ও ৪ লাখ ৮৯ হাজার ৯২৩ কোটি ডলার। উল্লেখ্য, জাপান, চীন ও হংকং স্টক এক্সচেঞ্জ এশিয়ায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে। গ্লোবাল ইকোনমি ডটকমের পরিসংখ্যান অনুসারে বাজার মূলধনের দিক দিয়ে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৩৮তম। ৮ আগস্ট ২০২১ গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে করোনা মহামারীর কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতির বিপর্যস্ততার মধ্যেও বিভিন্ন দেশের পুঁজিবাজারসহ বাংলাদেশের পুঁজিবাজারেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়। ব্লুমবার্গ ও ইনভেস্টিং ডটকমের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ঢাকার স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সার্বিক মূল্যসূচক ৮৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ৬ষ্ঠ অবস্থানে উঠে আসে। বিশ্ব পুঁজিবাজারে সবচেয়ে বেশি উত্থান হয়েছে থাইল্যান্ড, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, শ্রীলঙ্কা ও জার্মানির পুঁজিবাজারে। দেশগুলোর এসইটি সূচকের পয়েন্ট বেড়েছে যথাক্রমে ১২৪, ১০৯, ৯৩, ৯১ ও ৮৭ শতাংশ। বিশ্বের কয়েকটি দেশের পুঁজিবাজারের সার্বিক মূল্য-আয় অনুপাত (পিই রেশিও) পর্যালোচনায় দেখা যায়, ভারতের সেনসেক্সের পিই রেশিও সবচেয়ে বেশি ৩০ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেড়েছে। বৃদ্ধির তালিকায় এর পরে রয়েছে থাইল্যান্ডের এসইটির ২৭ দশমিক ০২, যুক্তরাষ্ট্রের ডাওজোনসের ২৩ দশমিক ৯১, ভিয়েতনামের ডিএন ইনডেক্স ১৬ দশমিক ৮৮, বাংলাদেশের ডিএসইএক্সের ১৫ দশমিক ৮৬, হংকংয়ের হ্যাং সেংয়ের ১১ দশমিক ৩৬, পাকিস্তানের কেএসই ১০০-এর ১০ দশমিক ৭৫ এবং শ্রীলঙ্কার সিএসইঅলের ১০ দশমিক ০৯ শতাংশ। ১০ আগস্ট ২০২১ গণমাধ্যম সূত্র অনুযায়ী ৯ আগস্ট দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সূচকের বড় পতনে লেনদেন শুরু হলেও দিন শেষে ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে। শেয়ারবাজারের বেশিরভাগ নির্দেশক সূচকের রেকর্ড ছিল ২০১০ সালে। কিন্তু ডিএসই সূচক, লেনদেন, বাজার মূলধনসহ ৮টি নির্দেশক সূচকের মধ্যে ৬টিতেই রেকর্ড করে ২০১০ সালের পরিবর্তে সূচক রেকর্ডের খাতায় যুক্ত হয় ২০২১ সাল। ডিএসই-এর তথ্য অনুযায়ী ঢাকার বাজারের প্রধান সূচক ডিএসইএস, বাজার মূলধন, ক্রয়াদেশের সংখ্যা বা হাওলা ও হাতবদল হওয়া শেয়ার সংখ্যায় রেকর্ড হয়েছে। ডিএসইএক্সের সূচক ৩২ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৩২৮ এবং বাছাই করা কোম্পানির সমন্বয়ে গঠিত ডিএস-৩০ সূচকটি বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৩৯৩ পয়েন্ট। ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি সূচক দুটি চালু হওয়ার পর উক্ত সময়ে সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠেছে। ২০ জানুয়ারি ২০১৪ সালে চালু হওয়া অপর সূচক শরিয়াভিত্তিক ডিএসইএস একদিনে ১৩ পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১ হাজার ৪৫২ পয়েন্ট। ওই দিন রেকর্ড ৯৭ কোটি ৭ লাখ ৭৫ হাজার ৫৪৯টি শেয়ারের হাতবদল হয়েছে, যা ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারি হয়েছিল ৯৪ কোটি ৯ লাখ ৮ হাজার ৬৫২টি শেয়ারের। এছাড়াও ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বরের ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৩১০টি ক্রয় বা বিক্রয়াদেশ নিষ্পন্নের বিপরীতে উল্লেখ্য সময়ে হয়েছে ৪ লাখ ২১ হাজার ৮০৩টি। বাজার মূলধনের ক্ষেত্রে ১ হাজার ২১০ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা। লেনদেনেও ভাল গতি থাকায় ২০১০ সালে ৫ ডিসেম্বরের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। শেয়ারবাজরের এই পরিস্থিতি বিশ্লেষণে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা গণমাধ্যমকে জানান, ‘নানা কারণে এখন উর্ধমুখী বাজারে প্রতিদিন রেকর্ড হলেও সার্বিকভাবে বাজার এখনও ঝুঁকিপূর্ণ নয়। ব্যাংকের সুদহার তলানিতে নেমে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের একটি অংশ বেশি মুনাফার আশায় ব্যাংকের বদলে শেয়ারবাজারে অর্থ বিনিয়োগ করছেন। আবার করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাব বিরাজ করায় কিছু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকা অর্থ ব্যাংকের পরিবর্তে শেয়ারবাজারে খাটাচ্ছে। সব মিলিয়ে বাজারে বিনিয়োগ বেড়েছে বিধায় কয়েকদিন পরপর রেকর্ডও হচ্ছে। তিনি আরও জানান, সার্বিকভাবে বাজার নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। তবে কিছু শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এসব শেয়ারে বিনিয়োগের আগে বিনিয়োগকারীদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে এবং উর্ধমুখী বাজারে কারসাজি রোধে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে নজরদারি বাড়াতে হবে।’ শেয়ারবাজারে বিবিধ কূটকৌশলে প্রায় সময় বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এমনকি বাজারের প্রতি তাদের আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি হয়। ফলে হারিয়ে যায় তাদের কষ্টার্জিত মূলধন। বিগত বছরের ২৬ ডিসেম্বর গণমাধ্যমে প্রকাশিত সিডিবিএল তথ্যানুসারে শেয়ারবাজারে মন্দাভাবের জন্য বিনিয়োগকারীদের অনেকেই আতঙ্কে তাদের শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। ১৫ ডিসেম্বর লেনদেন শেষে শেয়ারবাজরে শেয়ারশূন্য বিও (বেনিফিশারি ওনার্স) হিসাব ছিল ৪ লাখ ২৪ হাজার ১৩৩টি। ২৩ ডিসেম্বর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ লাখ ৬৯ হাজার ২৭৩টি। অর্থাৎ ৬ কার্যদিবসে ৪৫ হাজার বিও হিসাবের সব শেয়ার বিক্রি করা হয়েছে। ২৪ ডিসেম্বর গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, দেশের শেয়ারবাজার দুই সপ্তাহে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার মূলধন হারিয়েছে। বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পুঁজিবাজারকে প্রভাবিত করছে রাঘববোয়ালরা। দুর্বল তদারকির কারণে আইপিও, লেনদেনসহ বিভিন্ন ছলচাতুরী হয়ে খাকে। পুঁজিবাজারকে আকর্ষণীয় করতে সুশাসন জরুরী। সুকুক বন্ড পুঁজিবাজারের জন্য সম্ভাবনাময়। এটি কার্যকরভাবে পরিচালনা করা গেলে বাজারের গভীরতা বাড়বে। তবে তা নির্ভর করবে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ওপর। রোড শো করে বিনিয়োগকারীদের মনে আত্মবিশ্বাস আনা যাবে না।’ চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছেÑ নতুন বছরের প্রথম কার্যদিবসে দেশের শেয়ারবাজারে উল্লম্ফন হয়েছে। ঢাকা স্টক একচেঞ্জের প্রধান মূল্যসূচক প্রায় ১০০ পয়েন্ট বেড়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে দাম বাড়ার তালিকায় যুক্ত হয়েছে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান এবং অর্ধডজন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম বাড়ার সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করেছে। ডিএসইর পাশাপাশি চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সার্বিক মূল্যসূচকে সিএএসপিআই বেড়েছে ৩৮৮ পয়েন্ট। লেনদেনে অংশ নেয়া ২৬২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২০৯টির দাম বৃদ্ধির বিপরীতে দাম কমেছে ৪১টির এবং অপরিবর্তিত ছিল ১২টির দাম। বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ২৭ কোটি ১২ লাখ টাকা। সদ্য বিদায়ী ২০২১ সালের শেষ তিন কার্যদিবসেও উর্ধমুখী ছিল শেয়ারবাজার। বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রি-ওপেনিং পদ্ধতি চালু থাকায় নতুন বছরের লেনদেন শুরু হওয়ার আগেই বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বাড়িয়ে বিনিয়োগকারীরা ক্রয়-বিক্রয় আদেশ দেয়ায় ডিএসইতে লেনদেন শুরু হতেই প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ২১ পয়েন্ট বেড়ে যায়। লেনদেনের সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বড় হতে থাকে দাম বাড়ার তালিকা এবং একই সঙ্গে বাড়তে থাকে সূচকের উর্ধমুখী প্রবৃত্তি। দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ৯৬ পয়েন্ট বেড়ে ৬ হাজার ৮৫৩ পয়েন্টে উঠে আসে। অপর দুই সূচকের মধ্যে ডিএসই-৩০ সূচক ২৮ পয়েন্ট বেড়ে ২ হাজার ৫৬০ এবং ডিএসই শরিয়াহ ১৪ পয়েন্ট বেড়ে ১ হাজার ৪৪৫ পয়েন্টে অবস্থান করছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বিশ্বের বা দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশের অর্থনীতির আকার আমাদের দেশের চেয়ে ছোট হলেও তাদের স্টক এক্সচেঞ্জগুলো আমাদের থেকে বেশ সমৃদ্ধ। বিশেষজ্ঞরা এর মূল কারণ হিসেবে স্টক এক্সচেঞ্জে বেশ কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানির তালিকাভুক্তিকে চিহ্নিত করেছেন। অনেক বহুজাতিক কোম্পানি আমাদের অর্থনীতিতে ভাল ব্যবসা করলেও তারা শেয়ারবাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। সরকার এসব ক্ষেত্রে অর্থবহ উদ্যোগ গ্রহণ করলে বাংলাদেশের শেয়ারবাজার এমনিতেই ঘুরে দাঁড়াবে বলে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তবে আশা জাগানিয়া বিষয় হচ্ছে ২০২০ সালে শেয়ারের অব্যাহত দরপতনের প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সামগ্রিক বাজার পরিস্থিতি এবং এ বাজারে বিশ্বাস ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য ৬টি দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। তার মধ্যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বাংলাদেশে ব্যবসা করছে এমন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্তি করার উদ্যোগ নেয়া এবং সরকারের লাভজনক কোম্পানিগুলোকে বাজারে নিয়ে আসা। মুক্তির মহানয়ক জাতির জনকের সুযোগ্য তনয়ার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার ২০৪১ সালে উন্নত দেশে উত্তরণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তা বাস্তবায়নে দেশের পুঁজিবাজার সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে- তা সহজেই অনুমেয়। শেয়ারবাজারের দরপতন বা উর্ধ-নিম্নমুখী হওয়ার প্রবণতা অনেকটা সিন্ডিকেটেড মাফিয়াচক্রের নিয়ন্ত্রণে থাকে। অর্থ-সম্পদলিপ্সু মানবরূপী কিছু দানব দেশের সবকিছু গিলে খাওয়ার অভিশপ্ত অভিপ্রায় থেকে এসব কর্মকান্ড পরিচালনা ও কদর্য কর্মকৌশল গ্রহণ করে। গণমানুষের জীবনোন্নয়নে বা শেয়ারবাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ী-ব্যক্তিদের আর্থিক লয়-ক্ষয় তাদের বোধে ন্যূনতম আঘাত করে না। সুনামির মতো সংশ্লিষ্টদের চরম ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে তাদের লোলুপ শকুনি দৃষ্টিভঙ্গি অধিকতর উল্লসিত হয়ে ওঠে। সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর তদারকি-পর্যবেক্ষণ-নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণের ব্যর্থতায় শেয়ার-পুঁজিবাজারের উত্থান-পতনের দোলাচলে অর্থ ব্যবস্থাও যে কোন সময় পঙ্গুত্ববরণ করতে পারে। বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে শেয়ারবাজারের সামগ্রিক দিক এবং ক্ষয়ক্ষতির প্রভাব গভীরভাবে উপলব্ধিতে আনা উচিত। অন্যথায় শেয়ারবাজারের চক্রাকার পুঁজি নষ্ট চরিত্রের মানুষগুলোর মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচারকে অধিকতর দেশপ্রেম বিচ্যুত অপরিমেয় শক্তিমান করে তুলবে- অবস্থাদৃষ্টে নিঃসন্দেহে তা বলা যায়। লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×