ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

খালেদাকে বিদেশ নিতে কূটনৈতিক পাড়ায় বিএনপির দৌড়ঝাঁপ

প্রকাশিত: ২৩:৪১, ৫ ডিসেম্বর ২০২১

খালেদাকে বিদেশ নিতে কূটনৈতিক পাড়ায় বিএনপির দৌড়ঝাঁপ

শরীফুল ইসলাম ॥ বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার জন্য সর্বশেষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। এ ব্যাপারে সরকারকে টলাতে না পেরে এখন কূটনৈতিক পাড়ায় বিরামহীন দৌড়ঝাঁপ করছেন দলের নেতারা। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলের ক’জন সিনিয়র নেতা প্রতিদিনই ঢাকায় কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকদের কাছে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার আপডেট দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে তাঁকে বিদেশে নেয়ার বিষয়ে কূটনীতিকদের সহযোগিতা চাচ্ছেন। সূত্র জানায়, বিএনপির দৌড়ঝাঁপের পর এখন কোন কোন দেশের কূটনীতিক খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে বিভিন্নভাবে খোঁজখবর রাখছেন। এর মাধ্যমে তাঁরা খালেদা জিয়ার প্রকৃত অবস্থা জানতে চাচ্ছেন। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছেও তারা এ বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে বিদেশী কূটনীতিকদের এখন নিয়মিত আপডেট দিচ্ছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের ক’জন সিনিয়র নেতা। শীঘ্রই খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে ঢাকায় কর্মরত সব দেশের কূটনীতিকদের ব্রিফ করবে বিএনপি। ১০ ডিসেম্বর এ ব্রিফ করা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। ইতোমধ্যেই কূটনীতিকদের আমন্ত্রণ জানানোর কাজ শেষ করা হয়েছে। এদিকে সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা আগের মতোই। এখনও মাঝেমধ্যে তাঁর লিভার ও পরিপাকতন্ত্রে রক্তক্ষরণ হয়। হাসপাতালের সিসিইউতে নিবিড় পর্যবেক্ষণে তাঁর চিকিৎসা চললেও ওষুধে তেমন কোন কাজ করছে না। তবে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি যাতে না হয় সে চেষ্টাই করে যাচ্ছেন চিকিৎসক বোর্ড। জানা যায়, এখন খালেদার প্রধান ২টি সমস্যা হচ্ছে লিভার আর শরীরে রক্তক্ষরণ। এ ছাড়া হঠাৎ হঠাৎ তাঁর শরীরে হিমোগ্লোবিন কমে যায়। এ বিষয়ে খালেদা জিয়ার বোন সেলিমা ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, ডাক্তাররা বলেছেন, তারা আর এখানে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা করতে পারছেন না। তাদের যতটুকু করার ততটুকুই করেছেন। বাকি চিকিৎসা দেশে সম্ভব নয়। তাই উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে বিদেশে নেয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা বারবার আবেদন-নিবেদন করছি। তারপরও সরকার খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে না দিলে আর কি করতে পারি। খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁর স্বজন ও বিএনপি নেতারা বিরামহীন চেষ্টা চালিয়ে গেলেও সরকার আইনের বাইরে গিয়ে তাঁকে সে সুযোগ দিতে পারছে না। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হচ্ছে, তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চেয়ে আবেদন করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি চাইলে তিনি বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ পেতে পারেন। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইবেন না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়া দেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা ছিল। তিনি মুক্তিযুদ্ধের অগ্রসেনানী প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা এখন খুবই খারাপ। তাই সরকারের উচিত দ্রুত তাঁকে বিদেশে গিয়ে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ করে দেয়া। আমরা আশা করব, আইনের দোহাই না দিয়ে সরকার মানবিক কারণে অবিলম্বে খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ দেবে। সরকার অনুমতি দিলে আমরা তাঁকে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা জার্মানির উন্নত হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করাতে চাই। উল্লেখ্য, দেশে করোনা পরিস্থিতি শুরুর পর স্বজনদের আবেদনের প্রেক্ষিতে সরকারের নির্বাহী আদেশে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ শর্তসাপেক্ষে সাময়িক মুক্তি পান খালেদা জিয়া। দুই শর্তের মধ্যে ছিল বাসায় অবস্থান করে চিকিৎসা নিতে হবে এবং বিদেশে যাওয়া যাবে না। ৭৬ বছর বয়সী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া পুরনো বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত। তাঁর লিভার, কিডনি, হার্ট ও চোখের সমস্যা রয়েছে। রিউম্যাটিক আর্থ্রাইটিস ও ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছেন তিনি। চলাফেরায় অন্যের সাহায্য নিতে হচ্ছে। তাঁর শরীরের জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যথা। গুলশানের বাসায় গৃহকর্মী ফাতেমাসহ ৮জন করোনাক্রান্ত হওয়ায় এ বছর ১০ এপ্রিল বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার করোনা পরীক্ষা করা হয়। ১১ এপ্রিল রিপোর্ট প্রকাশিত হয় খালেদা জিয়া করেনাভাইরাসে আক্রান্ত। এর পর থেকে অধ্যাপক ডাঃ এফএম সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ৪ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ডের তত্ত্বাবধানে বাসায় থেকেই খালেদা জিয়া চিকিৎসা নেন। ১৫ এপ্রিল এক ঘণ্টার জন্য খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে সিটি স্ক্যান করানো হয়। রিপোর্ট ভাল আসায় তাঁকে ওইদিন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়নি। ২৭ এপ্রিল খালেদা জিয়াকে আবারও এভারকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে সিটি স্ক্যানসহ বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার রিপোর্ট ভাল না আসায় ওইদিনই তাঁকে ভর্তি করা হয় এভারকেয়ার হাসপাতালে। ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় খালেদা জিয়ার হঠাৎ শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায়। ৩ মে তাঁকে সিসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। এভারকেয়ার হাসপাতালের সিসিইউতে থাকা অবস্থায় ২৮ মে খালেদা জিয়া হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হন। তবে ৩০ মে তার জ্বর নিয়ন্ত্রণে আসে। নতুন করে বড় রকমের কোন সমস্যা না হওয়ায় ৩ জুন তাঁকে সিসিইউ থেকে কেবিনে নেয়া হয়। ১৩ জুন আবারও জ্বরে আক্রান্ত হন তিনি। এর পর থেকে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হয়। এভারকেয়ার হাসপাতালে শারীরিক অবস্থার তেমন উন্নতি না হওয়ায় ৫৪ দিন চিকিৎসা নেয়ার পর ১৯ জুন খালেদা জিয়াকে হাসপাতাল থেকে গুলশানের বাসায় নিয়ে আসা হয়। ৮ জুলাই করোনার টিকা নেয়ার জন্য নিবন্ধন করেন খালেদা জিয়া। এর পর ১৯ জুলাই তিনি মহাখালী শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট হাসপাতালে গিয়ে করোনার প্রথম ডোজ এবং ১৮ আগস্ট দ্বিতীয় ডোজ টিকা নেন। ১১৫ দিন পর ১২ অক্টোবর দ্বিতীয় দফায় এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। দ্বিতীয় দফায় হাসপাতালে যাওয়ার পর খালেদা জিয়ার শরীরের একটি অংশের চামড়া ফোসকার মতো (চাকা) হয়েছিল। এ জন্য ২৫ অক্টোবর এভারকেয়ার হাসপাতালে তাঁর বায়োপসি করা হয়। অপারেশনের পর পরীক্ষার রিপোর্ট পেয়ে তার ওপর ভিত্তি করে মেডিক্যাল বোর্ড রিপোর্ট পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করে। ২ নবেম্বর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বায়োপসির নমুনা উন্নত পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে পাঠানো হয়। দ্বিতীয় দফায় ২৭দিন চিকিৎসার পর ৭ নবেম্বর এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে গুলশানের বাসায় ফিরেন খালেদা জিয়া। ১৩ নবেম্বর তৃতীয় দফায় বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন। এই দফায় হাসপাতালে ভর্তির পর থেকেই তিনি সিসিইউতে অবস্থান করেন। ২৩ নবেম্বর রাতে তাঁর রক্তের হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ায় শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। আর তখন থেকেই তাঁর মারা যাওয়ার বিষয়ে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। বেশ ক’দিন তাঁর শারীরিক অবস্থার কোন উন্নতি হচ্ছিল না। তাঁর শরীরের বিভিন্ন প্যারামিটারগুলো ওঠানামা করে। এভারকেয়ার হাসপাতালের চিকিৎসক শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে নিবিড় পর্যবেক্ষণে তাঁর চিকিৎসা চালানো হয়। হাসপাতালে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত গৃহকর্মী ফাতেমা সর্বক্ষনিক অবস্থান করছেন ।
×