ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

সাগর রহমান

লন্ডনের চিঠি ॥ কতদূর গেলে পাওয়া যাবে ঘর

প্রকাশিত: ২১:৩৯, ৫ ডিসেম্বর ২০২১

লন্ডনের চিঠি ॥ কতদূর গেলে পাওয়া যাবে ঘর

২৫ নবেম্বরের পড়ন্ত বিকেল। কাজ থেকে বেরিয়ে এক দৌড়ে স্টেশনে ঢোকার আগে ইভনিং স্ট্যান্ডার্ডটা বগলদাবা করেছিলাম। প্রচণ্ড ভিড়ের ট্রেনে স্রেফ কপালগুণে একটা সিট পেয়ে যেতেই স্বার্থপরের মতো ওটাতে বসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। কিন্তু পত্রিকাটা খুলতেই সেই স্বস্তি উবে গেল। বিষণ্ণতায় ভরে গেল সমস্ত বিকেল, সমস্ত সন্ধ্যা, সমস্ত রাত। পত্রিকার প্রথম পাতার পুরোটাজুড়ে সমুদ্রের নীল জলের ছবি। তাতে সাদা রঙের দুমড়ানো-মোচড়ানো একটি ডিঙি ভাসছে। বড় বড় অক্ষরে শিরোনাম- ‘দে ডিডনট স্ট্যান্ড এ চান্স’। কারা এরা? সতেরোজন পুরুষ, সাতজন নারী- যাদের একজন সন্তানসম্ভবা, তিনজন শিশু- সব মিলিয়ে সাতাশজন। ফ্রান্স সীমান্ত থেকে যাত্রা করে ইংলিশ চ্যানেল হয়ে অবৈধভাবে ইংল্যান্ডে ঢোকার পথে পানিতে ডুবে মারা গেছে। যে ধরনের ডিঙিতে তারা সমুদ্রে নেমে পড়েছিল তা মূলত বাতাসে ফোলানো মোটা প্লাস্টিকের তৈরি ‘পেডিং পুল’- এদেশের শিশুরা গ্রীষ্মকালে বাড়ির পেছনের বাগানে এতে পানি ভরে গ্নান করে। ইংলিশ চ্যানেল শব্দটি আমার কাছে সবসময় মধুর লাগত। ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের মধ্যবর্তী প্রায় ২১ মাইল বিস্তারের এই ছোট্ট সাগরটির ফ্রেঞ্চ নামটিও মধুর। লা মঁশ। মানে কোটের হাতা। বোধ হয় আকৃতির কারণে এমন নামকরণ। শব্দটি শুনলেই ব্রজেন দাসকে মনে পড়ে। বিক্রমপুরের এই কৃতী সন্তান ১৯৫৮ সালের ১৮ আগস্ট মধ্যরাতে ফ্রান্সের তীর থেকে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়ার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে হয়েছিলেন প্রথম। একে একে মোট ছয়বার এই ইংলিশ চ্যানেল সাঁতরে রেকর্ড সৃষ্টি করেন, যা এখনও অক্ষুণœ আছে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে শব্দটি আতঙ্কের প্রতিশব্দ হয়ে উঠেছে। কয়েকদিন পরপরই অবৈধ অভিবাসীদের সলিল সমাধির খবর পাওয়া যায় ইংলিশ চ্যানেল থেকে। ইংল্যান্ডের ‘উন্নত’ জীবনের আশায় শত শত দেশত্যাগী মানুষ কোনরকমে এসে ফ্রান্স সীমান্তে ওঠে। তারপর সেখান থেকে দালালদের টাকা-পয়সা দিয়ে ‘ডিঙি’তে চড়ার ব্যবস্থা করে। প্রায় ৩৫০ মাইল দৈর্ঘ্যরে চ্যানেলের সব জায়গায় যেহেতু সমান মাত্রায় পুলিশ পাহারা থাকে না, থাকা সম্ভবও নয়, দালালরা কোন একটা জায়গা বের করে পয়সা-কড়ির বিনিময়ে কিছু লোককে তুলে দেয় ডিঙিতে। এসব ডিঙিতে কোন আলো, ন্যাভিগেশন বা এ জাতীয় কোন সুযোগ-সুবিধা থাকে না। সম্পূর্ণ পরিচয়পত্রহীন এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লাইফজ্যাকেটবিহীন- এ যেন ভাগ্যের ওপর ভরসা করে মৃত্যুতরীতে উঠে পড়া! আর এমন মৃত্যুতরীতে ওঠার জন্য দালালদের দিতে হয় তিন থেকে ছয় হাজার পাউন্ড পর্যন্ত! এই অভিবাসনপ্রত্যাশী মানুষগুলো যখন ডিঙিতে চড়ে তখন তারা খুব ভাল করেই জানে, হয় তারা ভাসতে ভাসতে ইংল্যান্ড সীমান্তে পৌঁছাবে নতুবা ডিঙি ডুবে মারা যাবে। দুটোর সম্ভাব্যতাই সমান সমান। কিন্তু বড়জোর দশজনকে নিস্তরঙ্গ জলে বহন করতে পারে এমন ডিঙ্গিতে গোটা পঞ্চাশেক মানুষকে উত্তাল সমুদ্রে ছেড়ে দেয়া হলে ভাগ্যের পাল্লা দ্বিতীয় সম্ভাব্যতার দিকেই হেলে যায় পুরোপুরি। ২৫ নবেম্বর ঠিক এটাই ঘটেছে। এ ঘটনার পরদিন একজন সাংবাদিক ফ্রান্স সীমান্তে অভিবাসন প্রত্যাশীদের ক্যাম্পে একজন যুবককে প্রশ্ন করেছিল, এত ভয়াবহ বিপদ মাথায় নিয়ে ইংল্যান্ড যেতে চাও কেন? প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে যুবকটি একটুও চিন্তা না করে জবাব দিয়েছিল, “এ মুহূর্তে ‘জীবন’ বলতে আমাদের কিছু নেই। আমরা তোমাদের মতো সুন্দর জীবন চাই। একটাই তো জীবন। এভাবে বাঁচার কোন মানে নেই।” যুবকের নাম আলি। বয়স তেইশ। বাড়ি ইরাক। সাংবাদিকটি যখন তাকে এভাবে ডিঙ্গিতে করে আপাত অসম্ভব ভ্রমণের কথা মনে করিয়ে দিল আলি নির্দ্বিধায় জানাল, ‘সুযোগ পেলে আমিও পানিতে নেমে পড়ব। ওরা পারেনি, আমি হয়ত বেঁচে যাব।’ পাগলাটে বাতাস, অসম্ভব ঠাণ্ডা পানি এবং উত্তাল স্নোতস্বিনী ঢেউ ছাড়াও ডিঙি চড়ে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়ার আরেকটি বড় প্রতিবন্ধকতা হলো- কন্টেনার শিপ। এ পথে প্রতিদিন অজস্র বিশালাকারের জাহাজ চলাচল করে, যাদের সঙ্গে ধাক্কা লাগা ছাড়াও স্রেফ প্রবল ঢেউয়েই ডিঙিগুলো উল্টে যেতে পারে। পঁচিশ তারিখের ট্র্যাজিডি, ধারণা করা হচ্ছে এভাবেই ঘটেছিল। ঐ মানুষগুলোকে পানি থেকে তুলে নেয়ার কাজে নিয়োজিত একজন উদ্ধারকর্মীর ভাষ্য, ‘দৃশ্যটি যে কী ভয়াবহ! চারদিকে মানুষের লাশ ভাসছে। আমার মনে হচ্ছিল আমি বুঝি টাইটানিক সিনেমার সেটে আছি...।’ বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ, পুরুষ এবং ডিঙিতে ‘সিট’ পাবার জন্য দালালদের দেয়ার যথেষ্ট মতো টাকা নেই- এমন অভিবাসন প্রত্যাশীরা ইংল্যান্ডে ঢোকার জন্য আরেকটি পথ বেছে নেন। নর্থান ফ্রান্সের ক্যালাইস হয়ে সেসব মালবাহী লরি প্রতিদিন ইংল্যান্ডের দিকে রওয়ানা হয়, ওরা রাস্তার পাশে ওঁৎ পেতে থাকে। এই লরিগুলো কোথাও থামলে কিংবা একটু স্লো হলেই তারা লাফিয়ে লরির বিভিন্ন জায়গায় উঠে পড়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবশ্য শেষ রক্ষা হয় না। পুলিশ নিয়মিত বিরতিতে এই লরিগুলোতে ‘বডি হিট’ এক্সরে ব্যবহার করে অবৈধ অভিবাসীদের আটকে দেয়। শুধু গত এগারো মাসে এমন অবৈধ অভিবাসনপ্রত্যাশী ধরা পড়েছে প্রায় এগারো হাজার! অনেক ক্ষেত্রে মারাত্মক সব দুর্ঘটনাও ঘটে। কেউ কেউ ঠাণ্ডায় জমে যায়। হাত ফসকে পড়ে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে নিয়মিতভাবে। গত সেপ্টেম্বরে সুদান থেকে পালিয়ে আসা ইয়াসের আবদাল্লা নামক একটি যুবক ট্রাকের তলে পড়ে মারা পড়ে। আবদাল্লার স্বপ্ন ছিল লন্ডনে এসে ক্যাব চালক হবে। এক শ্রেণীর দালাল কাজ করে এখানেও। তারা ট্রাকচালকদের সঙ্গে যোগযাজশ করে অভিবাসনপ্রত্যাশী মানুষগুলোকে মালভর্তি ট্রাকের ভেতরে ঢোকার সুযোগ করে দেয়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এই ট্রাকগুলোর পেটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে থাকতে ঠাণ্ডায় জমে গিয়ে কিংবা দম বন্ধ হয়ে মারা যাবার ঘটনাও ঘটেছে গত কয়েক বছরে বহুবার। সানডে টাইমসের বেস্টসেলিং লেখক টনি পারন্সের ‘ডাই লাস্ট’ নামক একটি উপন্যাস আছে। মূলত ক্রাইম থ্রিলার। ফ্রান্স থেকে ব্রিটেনে ট্রাকভর্তি আদম পাচার বইটির প্রেক্ষাপট। এই আদম পাচার চক্র যে কত শক্তিশালী এবং কত বিস্তৃত জাল ছড়ানো এদের আর তা প্রতিহত করার জন্য প্রতিরক্ষা বাহিনীর যে নিয়মিত মহড়া- তার বিস্তৃত বিবরণ পড়ে অবাক হতে হয়। চোখের ওপর ভাসতে থাকে আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে অমানবিক টাগ অব ওয়ার- অবৈধ অভিবাসন। অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে গলদঘর্ম প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের ছবি ছাপা হয়েছে। ফ্রান্সকে দোষ দিয়ে কিছু এলোমেলো কথা বলছেন দেখলাম। সেগুলো পড়তে পড়তে রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়ল- যারে তুমি নিচে ফেল, সে তোমার বাঁধিবে যে নিচে, পশ্চাতে রেখেছো যারে, সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে... মনে পড়ছে উইলিয়াম ফকনারকে। ‘এজ আই লে ডায়িং’ বইয়ে উইলিয়াম ফকনারের সেই বিখ্যাত উক্তিটি- যড়ি ড়ভঃবহ যধাব ও ষধরহ নবহবধঃয ৎধরহ ড়হ ধ ংঃৎধহমব ৎড়ড়ভ, ঃযরহশরহম ড়ভ যড়সব! মন খারাপ ভুলতে মনে মনে স্বপ্ন দেখছি, একদিন পৃথিবীর সব সীমানা-প্রাচীর ভেঙ্গেচুরে যাবে। নতুন দিনের শিশুরা পরস্পরের দিকে হাত বাড়িয়ে বলবে- এসো, দেখ, যেখানে তোমার ভাল লাগে, সেখানেই তোমার ঘর। লেখক : কথাসাহিত্যিক
×