ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের প্রস্তাবনায় ‘পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস’

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ৫ মে ২০২১

বাংলাদেশের প্রস্তাবনায় ‘পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস’

শৈশবে দু’বার পানিতে ডুবে যাওয়ার পরও মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে এসেছি। দুটি ঘটনাই ৮০র দশকের মাঝামাঝি সময়ের। প্রথমবার বাড়ির অদূরে পুকুরে ডুবে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। পরে জেগে ওঠার পর সব স্বপ্নের মতো মনে হয়েছিল। বাবা বাসায় কবিরাজ ডেকে এনেছিলেন। সে বলেছিল, ছেলেকে পানির কাছে যেতে দেবেন না। পানিতে ওর বিপদ আছে! সেই থেকে পানির সঙ্গে এক রকম বিচ্ছেদ ঘটে আমার। সাঁতারটা আর শেখা হয়ে ওঠেনি। মজার ব্যাপার হলো, আমার বড় দুই ভাই খুব ভাল সাঁতারু। বড় ভাইয়ের সাঁতার দেখে ব্রজেন দাস বাবাকে বলেছিলেন, ছেলেটার যত্ন নিয়েন। আরেকবার বাসার সামনে ড্রেনের জন্য লাইন খোঁড়া হচ্ছিল। অস্থায়ীভাবে বিছিয়ে দেয়া কাঠের পাটাতন দিয়ে পারাপারের সময় হঠাৎ পড়ে গিয়েছিলাম। পানি ভর্তি বিশাল সেই গর্ত থেকে দ্রুতই উঠিয়ে আনা হয়েছিল আমাকে। নইলে ভয়ঙ্কর কিছু হয়ে যেতে পারত। আমরা যারা রাজধানীর বুকে বেড়ে উঠেছি তাদের বড় একটি অংশই সাঁতার জানি না। ফলে, সমুদ্র কিংবা নদী ভ্রমণে গেলে পরিবারের একটা বাড়তি চিন্তা থাকে আমাদের নিয়ে। এই মাঝ বয়সেও যখন পদ্মা পাড়ি দেই, ¯্রােতের তীব্রতা দেখে নিজের অজান্তেই গলা শুকিয়ে আসে। শীতের রাতে একবার ফরিদপুর যাওয়ার সময় কুয়াশায় ফেরি মাঝ নদীতে আটকে পড়ায় সারারাত সেখানেই কাটিয়েছিলাম। নদীর এপার অর্থাৎ, ঢাকা থেকে বাবার ফোন, আর ওপার ফরিদপুর থেকে শাশুড়ির ফোন পাচ্ছিলাম। জীবনে প্রথমবারের ওই ঘটনায় আমাকে নিয়ে তারা দুশ্চিন্তায় ছিলেন। তবে, সময় কাটাতে চারতলা ফেরির ওপর-নিচে ওঠা-নামা করে আর গরম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে গল্পে কেটেছে সারারাত। আরেকবার ঝড়ের কবলে পড়েছিলাম মাঝ নদীতে। স্বল্পসংখ্যক যাত্রীবাহী ছোট লঞ্চটি ঢেউয়ে দুলছিল। ভয়ে শিশুরা মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করছিল। মা বারবার সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছিলেন। ঝড়টি অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। সেই ঘটনা ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়। প্রতিবছরই বাংলাদেশের অনেক বয়স্ক মানুষ এবং শিশু পাানিতে ডুবে মারা যায়। বিশে^ও এ সংখ্যা কম নয়। সেই বাস্তবতায় জাতিসংঘের ৭৫ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গত ২৮ এপ্রিল এ বিষয়ে একটি রেজ্যুলেশন উত্থাপন করা হয় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। রেজ্যুলেশনটি সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ। গৃহীত এ রেজ্যুলেশনটি উত্থাপন করেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা। এতে পানিতে ডুবে মৃত্যুকে একটি ‘নীরব মহামারী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। নানান বিবেচনায় এখন থেকে প্রতিবছর ২৫ জুলাই বিশ্ব ‘পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস’ পালিত হবে। নীরব এ বৈশ্বিক মহামারীর বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে নিয়ে আসতে জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন ২০১৮ সাল থেকে কাজ করে আসছিল। দীর্ঘপথ পরিক্রমায় বাংলাদেশের পাশাপাশি এতে সহ-নেতৃত্ব দেয় আয়ারল্যান্ড। আর সহ-পৃষ্ঠপোষকতা দেয় ৮১টি দেশ। পানিতে ডুবে মৃত্যু বিশ্বের প্রতিটি জাতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়। পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টি, জাতীয় পদক্ষেপকে উৎসাহিত করা এবং এ বিষয়ক সর্বোত্তম অনুশীলন ও সমাধানসমূহ পারস্পরিকভাবে ভাগ করে নেয়ার লক্ষ্যে ২৫ জুলাইকে ‘পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয় সাধারণ পরিষদ। প্রস্তাবটি উত্থাপনকালে প্রদত্ত বক্তব্যে রাষ্ট্রদূত ফাতিমা বলেন, পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে বৃহত্তর বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি আদায়ের লক্ষ্যে জাতিসংঘে রেজ্যুলেশন গ্রহণের তাগিদ অনুভব করেছিল বাংলাদেশ। সে প্রচেষ্টায় জাতিসংঘে বাংলাদেশ নেতৃত্ব দিতে পেরে সম্মানিতবোধ করছে। তিনি বলেন, আমরা বিশ্বব্যাপী শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছি, আমরা যদি পানিতে ডুবে মৃত্যুর হারকে শূন্যের কোঠায় না আনতে পারি তবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় আমাদের সাফল্য অর্থাৎ এসডিজি-৩ অর্জন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে প্রতিবছর ২ লাখ ৩৫ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করছে। বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে পানিতে ডুবে মৃত্যু বিশেষ করে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যু অন্যতম প্রধান কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, পানিতে ডুবে বেশি শিশুর মৃত্যু ঘটে এশিয়াতে, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর হার বাংলাদশে। এখানে গড়ে প্রতিদিন ৪০টি শিশু মারা যায় পানিতে ডুবে। ইন্টারন্যাশনাল ড্রাউনিং রিসার্চ সেন্টারের (আইডিআরসি) সূত্র মতে, ভারতে পানিতে মৃত্যুর সংখ্যা বাংলাদেশের তুলনায় বেশি হলেও জনসংখ্যার অনুপাতে এ হার বাংলাদেশেই বেশি। প্রতি বছর ১৪ হাজারের মতো শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। এর মধ্যে ১০ হাজারই পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু। গবেষণায় দেখা গেছে ৮০ শতাংশ দুর্ঘটনা পুকুরেই হয়ে থাকে। যেটি বাড়ির সীমানা বা ঘরের ২০ মিটারের মধ্যে। ৬০ শতাংশ ডুবে মারা যাওয়ার দুর্ঘটনা সকাল নয়টা থেকে বেলা একটার মধ্যে। কারণ, এ সময় মায়েরা ঘরের নানান কাজে ব্যস্ত থাকেন। কাজের কারণে বাবারাও থাকেন ঘরের বাইরে। একটু বড় শিশুদের ক্ষেত্রে সাঁতার না জানাও ডুবে মারা যাওয়ার একটি কারণ। গত বছর জানুয়ারি থেকে নবেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সারাদেশে ২৫০টি ঘটনায় ৪৪৮ জন পানিতে ডুবে মারা গেছে। এদের মধ্যে ৩১৭ জনেরই বয়স ৯ বছরের কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বিশে^ প্রতিবছর তিন লাখ ৫৯ হাজার ৪শ’ জন পানিতে ডুবে মারা যায়। এদের ২০ শতাংশের বয়স পাঁচ বছরের কম। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হারে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম। বাংলাদেশে ১ থেকে ৪ বছর বয়সী শিশুদের মোট মৃত্যুর ৪৩ শতাংশের জন্য দায়ী পানিতে ডুবে মারা যাওয়া। সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দিনের প্রথমভাগে শিশুদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে রাখা হলে বাংলাদেশে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার ৭০ শতাংশ রোধ করা সম্ভব। বাংলাদেশ কর্তৃক জাতিসংঘে উত্থাপিত রেজ্যুলেশনে পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে জাতীয় ফোকাল পয়েন্ট নিয়োগ, জাতীয় প্রতিরোধ পরিকল্পনা ও কর্মসূচী উন্নয়ন, জাতীয় পর্যায়ে আইন প্রণয়ন, সচেতনতা তৈরি করা, আন্তর্জাতিক পদক্ষেপকে সহযোগিতা করা এবং এ বিষয়ক গবেষণা ও উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে সদস্য দেশসমূহকে উৎসাহিত করা হয়েছে। এমন একটি রেজ্যুলেশন উত্থাপন বিশে^ বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার পাশাপাশি পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হারই শুধু রোধ নয়, বড়দেরও প্রাণ বাঁচাতে জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণে বিশ^কে উৎসাহ জোগাবে। লেখক : সাংবাদিক
×