ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বজ্রকণ্ঠের স্বরূপ সন্ধান- একটি সমীক্ষা

প্রকাশিত: ২৩:৩৬, ২৯ আগস্ট ২০২০

বজ্রকণ্ঠের স্বরূপ সন্ধান- একটি সমীক্ষা

(গতকালের পর) মীর জাফরের বংশধর ইস্কান্দার মির্জা বংশীয় চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যের ধারায় স্বদেশবিরোধী ছিলেন। তিনি পূর্ব হতেই সর্বদা আইয়ুব খানকে গণতন্ত্র হত্যা ও গোপন কুমন্ত্রণা দিতে দিতে শেষ ষড়যন্ত্রে নিজের জালে নিজেই ফেঁসে যান। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর তিনি নিজে নিজেই প্রেসিডেন্ট হন এবং ঐ দিনই সামরিক আইন জারি করে আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং ২৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেন। এর মাত্র তিন দিন পর ২৭ অক্টোবর ‘রাজনৈতিক অবস্থার অবনতি’র অজুহাতে অতি অনুগত আইয়ুব প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে অপসারণপূর্বক দেশত্যাগে বাধ্য করেন এবং তিনি নিজেই নিজেকে রাষ্ট্রপতি বলে ঘোষণা করেন। এভাবে তিন সপ্তাহে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে পরের বছর ২৬ অক্টোবর নিজেকে ফিল্ড মার্শাল বলে ঘোষণা করেন এবং পরের দিন ‘বিপ্লবের প্রথম বার্ষিকী’ পালন করেন। এর অব্যবহিত পূর্বে একের বিরুদ্ধে অন্যের ষড়যন্ত্র, কূটচাল বার বার মন্ত্রিসভার পতনে সাধারণ নিরীহ জনগণ প্রশাসক ও প্রশাসনের ওপর বিষিয়ে উঠেছিল। এ কারণে পশ্চিমাপন্থী কেউ কেউ অথর্ব ও কুচক্রী প্রশাসনের চেয়ে সামরিক শাসনকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছিল। (মাহমুদ উল্লাহ ১৯৯৯ : ৬৬) কিন্তু কোন বাঙালি-ই তা ভালোভাবে মেনে নেয়নি। ফলে তারা সামরিক শাসনের বিরোধিতা করে। এরূপ পরিস্থিতিতে সংগ্রামী বাঙালি সাগ্রহে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের পথ খোঁজে। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনগুলোর কোনোটিতেই মুসলিম লীগ জয়ী হতে পারেনি। যেমন: ভারত ও পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র গঠনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের উদ্দেশ্যে ১৯৪৬ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে কংগ্রেসের নিকটে পরাজিত হয় এবং ‘মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত পাঞ্জাব, সিন্ধু ও সীমান্ত প্রদেশে মুসলিম লীগ এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে পারেনি’ (শেখ মুজিব ২০১৩ : ৫০) ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় চব্বিশ বছরে পাঁচবার সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। কারণ, ‘সীমাহীন দুর্নীতি, প্রশাসন বিভাগে অসমতা, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য এবং মুসলিম লীগ ও সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল নীতির কারণে জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ দ্রুত জনপ্রিয়তা হারায়’ (রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী ১৯৯৮ : XIV) এ শূন্য জনপ্রিয়তা পাক শাসকগণকে সামরিক শক্তি নির্ভর করে। ১৯৫৪ ও ১৯৭১ সালের সাধারণ নির্বাচনে দুবারই মুসলিম লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে। প্রথম নির্বাচনে বাংলার মাটি থেকে মুসলিম লীগকে নিঃশেষে নিশ্চিহ্ন করার জন্য কয়েকটি বিরোধী দলের সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। মাওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবের ‘আওয়ামী লীগ’ এর সঙ্গে, এ. কে. ফজলুল হকের ‘কৃষক শ্রমিক পার্টি’, মাওলানা আতাহার আলীর ‘নেজামে ইসলাম’, ‘গণতন্ত্রী দল’ এবং আরও কয়েকটি ছোট ছোট দল সমন্বয়ে এ ফ্রন্ট গঠিত। একুশে ফেব্রুয়ারির আদর্শিক চেতনার ভিত্তিতে একুশ দফা কর্মসূচী গ্রহণ এবং প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল মতাদর্শের কারণে যুক্তফ্রন্ট আশাতীত সাফল্য অর্জন করে। সর্বমোট ২৩৭ আসনের মধ্যে ২২৩টি যুক্তফ্রন্ট ও মাত্র ৯টি আসন মুসলিম লীগ অবশিষ্ট ৪টি নির্দলীয় ও ১টি খেলাফতে রাব্বানী অর্জন করলে (মাহমুদ উল্লাহ ১৯৯৯ : ৬৫) পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগ কোণঠাসা হয়ে পড়ে। আশ্চর্যজনক হলো তরুণ নেতা শেখ মুজিবের প্রথম জাতীয় কোন নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ। অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতা ও কার্যকর জনসংযোগের কারণে যুক্তফ্রন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রাজনৈতিক অঙ্গনে তাকে অনিবার্য করে তোলে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনেও পাকিস্তান পিপলস পার্টি আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত আসনের চেয়ে অর্ধেকেরও কম মাত্র ৮৮টি আসন পেলে ভুট্টো ভয়ে আঁতকে ওঠেন যে, ‘ক্ষমতা এখন বাঙালীদের হাতে চলে যাবে এবং পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে শাসন ক্ষমতা এবং শাসনতন্ত্র প্রণয়নের পূর্ণ ক্ষমতা এখন আওয়ামী লীগের কর্তৃত্বাধীন হবে।’ (রফিকুল ইসলাম ১৯৯৫ : ৫৩) এতে পাঞ্জাবীদের ক্ষমতাচ্যুতি ও আওয়ামী লীগের মতাদর্শ বাস্তবায়ন হলে ভুট্টোর স্বপ্নসাধ ধূলিস্মাৎ হবে। এ নির্বাচনে ৩১৩টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ এককভাবে ১৬৭ আসন পেয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় মুসলিম লীগের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। ইয়াহিয়া এ নির্বাচনের ‘তিনদিন পর তিনি ঢাকাতে বঙ্গবন্ধুকে ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও সম্বোধন করতে দ্বিধা করেননি।’ (মেজর জেনারেল সারোয়ার ২০১৯ : ১৪) এ সকল নির্বাচনের পরাজয়ই প্রমাণ করে তারা কেন এতদিন নির্বাচন দেয়নি। স্বাধীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বুর্জোয়া-আমলা-সেনা নির্ভর পাকসরকার সর্বদা জননির্ভরতাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। ১৫ মার্চ করাচীতে সাংবাদ সম্মেলনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেয়েও ভুট্টো বলেছিলেন, ‘শুধু সংখ্যাধিক্যের জন্য পাকিস্তানে শাসন পরিচালনা করা যাবে না। পিপলস পার্টিকে বাদ দিয়ে কোন সরকার গঠন সম্ভব নয়।’ (আখতার মুকুল ১৯৯৩ : ৩৩৪) তিনি বুঝেছিলেন যে, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সে কোনদিনই যৌথ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। এ জন্য তার দুটি পথ খোলা প্রথমত: পাকিস্তানকে আন্তঃবিভাজনপূর্বক দুই পাকিস্তানে দুই প্রধানমন্ত্রী ব্যবস্থা চালু করা এবং দ্বিতীয়ত: শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতারোহণ। ভুট্টোর মনের গোপনে লালিত স্বপ্ন দ্বিতীয় পথটি বাস্তবায়নে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এর মাধ্যমে গণহত্যা করে। এ প্রসঙ্গে তৎকালীন পাক ব্রিগেডিয়ার জেড এ খান তার THE WAY IT WAS’ গ্রন্থে লিখেছেন ‘শেখ সাহেবকে গ্রেফতার করার পর ৫৭ ব্রিগেডের মেজর জাফর ওয়ারলেস মেসেজ পাঠিয়েছিলেন- Big Bird in cage, small birds have flowen’.[১] তারা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি যে পরোক্ষভাবে তারা ভুট্টোর ইচ্ছানুযায়ী কাজ করছে। এক্ষেত্রে শেখ মুজিবকে যে তারা বিচ্ছিন্নতাবাদীর অপবাদ দেয় তা ঠিক নয়। কারণ গণতন্ত্রীমনা শেখ মুজিব ৬ দফার বাস্তবায়নে স্বায়ত্তশাসন মেনে নিয়ে অবিভক্ত পাকিস্তানের ফেডারেল গবর্নমেন্ট ব্যবস্থায় একীভূত হয়ে গণতন্ত্রের আদর্শে অনুগত থাকতে চেয়েছেন। এ জন্য তার পক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষুদ্র দলগুলোর নেতৃবৃন্দ পৃথক পৃথক বক্তব্য দিয়ে ভুট্টোর প্রস্তাবের প্রতিবাদে ঝড় বইয়ে দিয়েছিল। উল্লেখ্য, যে নেতা ‘আসগর খান পেশোয়ার আইনজীবী সমিতির সভায় বললেন, বর্তমান মুহূর্তে শেখ মুজিবুর রহমান দেশের দু’অংশকে একত্রে ধরে রেখেছেন। সংখ্যাগুরু দলের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক এবং এটাই হচ্ছে গণতন্ত্রসম্মত।’ (আখতার মুকুল ১৯৯৩ : ৩৩৪) প্রকৃতপক্ষে, ভুট্টো ও ইয়াহিয়া ছিলেন পাক বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং তাদের ক্ষমতা লাভের অভিলাসেই পাকিস্তান বিভক্ত হয়। ভুট্টো যদি ফলাফল মেনে নিয়ে আওয়ামী লীগ গঠিত সরকার ও পিপিপিকে বিরোধী দল মেনে নিতেন এবং আইয়ুব যদি ‘আন্তঃ আঞ্চলিক সমস্যাবলী, আর্থনৈতিক বৈষম্য ও জনগণের ন্যায্য দাবি পূরণের ন্যূনতম ব্যবস্থা করতে পারতেন এবং তাতে হয়তো পাকিস্তান রক্ষা পেত।’ (রফিকুল ইসলাম ১৯৯৫ : ৫২) এক্ষেত্রে সামরিক জান্তারা যত শক্তিধরই হোক না কেন ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ করার সাহস নাও পেতে পারত। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কৌশলী বাসনার কথা ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি শেখ মুজিবকে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগার হতে মুক্তি দেয়ার সময় ভুট্টো-মুজিব একান্ত আলাপে প্রমাণিত হয়েছিল, তার শেষ অনুরোধ ছিল ‘একটি অখ- এবং অবিভাজ্য পাকিস্তান গঠনের ব্যাপারে আপনি কি আমাকে সাহায্য করবেন, নাকি করবেন না?’ [...] মুক্তি পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর জবাব ছিল ‘পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো যে-বিশেষ সম্পর্কের কথা বলেছেন তা কখনোই স্থাপিত হবে না। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার পুরনো বন্ধন চিরতরে ছিন্ন হয়ে গেছে।’ (মোনায়েম সরকার ২০১৮ : ৫৪৪, ৫৭০) [1]https:// www.bbc.com/bengali/news-39460671.date 06/06/20 অবহেলিত পূর্ববঙ্গ ও বাঙালী এবং নিক্ষিপ্ত বাংলাভাষা ও সংস্কৃতি পাকিস্তান নামটির আবিষ্কার ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, কয়েকটি প্রদেশের নামের শেষ শব্দ ‘স্তান’ অন্তমিল ব্যতীত আর কোন ভিত্তি নেই যা সম্পূর্ণ কল্পনাশ্রিত ও অবাস্তব। ১৯৩৩ সালে লন্ডন হতে প্রকাশিত ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঞ্জাবি ছাত্র চৌধুরী রহমত আলীর ‘নাও অর নেভার’ গ্রন্থে সর্বপ্রথম তিনি এ প্রস্তাব প্রকাশ করেন, পাকিস্তান [...] composed of letters taken from the names of all our homelands– India and Asian. That is Panjab; Afganistan; (NWFP). Kashmir; Iran; Sind; Tukharistan; Afganistan, Baloochistan’ (রফিকুল ইসলাম ১৯৯৫ : ৫৭) এভাবে প্রথমে নাম সৃষ্টি এবং পরে দেশ গঠন হওয়ায় নামের উদ্দেশ্য ও মতবাদের মধ্যে বিশালাকার ব্যবধান সৃষ্টি করে। মুসলমানদের স্বাধীন যে আবাসভূমি সৃষ্টির লক্ষ্যে পাকিস্তান গঠিত তা উপেক্ষিত হয়ে ইরান তুখারিস্তান ও আফগানিস্তান বাদ পড়ে, বিপরীতে বাঙালী মুসলমান সংখ্যাধিক্য বঙ্গদেশের একাংশের সংযুক্তি ঘটলেও তার নামের কোন অংশই পাকিস্তান নামে সংযুক্ত হয়নি। (মযহারুল ইসলাম ১৯৭৪ : ১৫৪) কারণ পূর্ববঙ্গকে তারা হিসাবের মধ্যে গণনা করে না এবং সমগ্র কাশ্মীরকেও আজ পর্যন্ত এককভাবে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি। উপরন্তু পাঞ্জাব রাজ্যটি ভাগ হয়ে পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশের অন্তর্ভুক্ত হলেও তাদের নাম ছিল অপরিবর্তিত। কিন্তু বঙ্গদেশটিকে তারা দুটো আলাদা দেশ হিসেবে ভাগ করে নাম পরিবর্তন করে, যা পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ হিসেবে বিভাজিত। মোটকথা গুরুত্বপূর্ণ কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে এবং বড় ধরনের কোন সংযোজন বিয়োজনে পূর্ব পাকিস্তানকে তারা কখনোই মূল্যায়ন করেনি এবং একাত্মকভাবে গ্রহণ করেনি। পূর্ববঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন বাঙালীর মৌলিক দাবি উপেক্ষা করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ভাষা আন্দোলনের মিছিলে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। (সুব্রত বড়ুয়া ২০১২ : ২৬) আন্দোলনের এক পর্যায়ে গণদাবির চাপে এবং পাক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের সঙ্গে নুরুল আমিন ও খাজা নাজিমুদ্দিনও একাত্মতা ঘোষণা করেন এবং ৮ দফা চুক্তি মেনে নিয়ে স্বাক্ষর করেন। অথচ এ আন্দোলনে কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ শুধু বিরোধিতাই করেননি, তাদের সমর্থনও করেছেন। জনাব জিন্নাহ সবকিছু জেনেও অস্বীকার করে বলেছিলেন, ‘যে ভাষা চুক্তি হয়েছে সেটা তিনি স্বীকার করেন না। কারণ জোরপূর্বক সেই চুক্তিতে নাজিমুদ্দিনের সই আদায় করা হয়েছে। (রফিকুল ইসলাম ১৯৯৫ : ১৩) প্রকৃত ঘটনা হলো ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির রক্তক্ষয়ী ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিক প্রেক্ষাপটে আন্দোলন চলাকালীন গ্রেফতারকৃত শেখ মুজিবকে ২৬ ফেব্রুয়ারি মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এরপর ১৫ মার্চ প্রাদেশিক গণপরিষদে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের আত্মপোলব্ধিতে বাংলাভাষাকে সরকারী ভাষা করার স্বপ্রণোদিত প্রস্তাব খাজা নাজিমউদ্দিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। (রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী ১৯৯৮ : XV) ১৯৫০ সালের শেষ দিকে লিয়াকত আলীর মন্ত্রিসভার নির্দেশে গঠিত বেসিক প্রিন্সিপ্যাল কমিটি (বিপিসি)-র রিপোর্টে পাকিস্তানের ভবিষ্যত সংবিধানের খসড়া রূপরেখা প্রকাশ করে। এ সংবিধানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা ও পূর্ববঙ্গের বাঙালীদের ‘সংখ্যালঘু’ সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক দল হিসেবে গণ্য করা হয়। (রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী: ১৯৯৮: XIV) কিন্তু এই বাঙালী জাতিটিই ছিল ৫৫.৮% অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ অথচ এদের পরিচয় লেখা হয় সংখ্যালঘু হিসেবে। এ জন্য ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে তৎকালীন নবজাত আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশে এন্টি বিপিসি মুভমেন্ট করে এবং পাকশাসক এ মুভমেন্ট জেল জুলুম ও অস্ত্রের মাধ্যমে বন্ধ করে রাখে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান প্রেক্ষাপটে ২৩ মার্চ পৃথকভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। ১৯৪০ সালের এ দিনে লাহোর প্রস্তাব গৃহীত, ১৯৫৬ সালে সর্বপ্রথম পাকিস্তান শাসনতন্ত্র পাস, ১৯৭১ সালে গণপরিষদে সর্বপ্রথম বৈঠক আহ্বান ইত্যাদি কারণে এ দিনটি ‘পাকিস্তান দিবস’ হিসেবে পালিত হতো। কিন্তু ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান করা হলে শেখ মুজিব এর প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ‘এরা আমাদের বাংলা নামটি মুছে ফেলতে চায়’। (সুব্রত বড়ুয়া ও অন্যান্য ২০১২ : ৩২) ১৯৭১ সালের এই দিনটিতে পাকবাসীর সবচেয়ে বেনাদায়ক অধ্যায়ের সৃষ্টি করে, কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিজ হাতে তার নিজ বাসভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন এবং Sheikh Mujibur Rahman ordered that this day should be observed as Resistance Day’ (হাসান হাফিজুর ২০১০ : ৩০২) ‘প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চেই আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের সমাধি রচিত হয়। পাকিস্তান দিবস-এর নাম ইতিহাসের পাতা থেকে চিরদিনের জন্য মুছে যায়।’ (রফিকুল ইসলাম ১৯৯৫ : ১৩৮) ‘বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির কথা উঠলেই পাক শাসকগণ বলতেন-এটি মুসলমানের নয় হিন্দুর!’ (সুব্রত বড়ুয়া ২০১২: ৩০) এ জন্য বাংলা বর্ণমালা এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত বিরোধী সরকারী অভিযান চলেছিল। তাদের দাবি মুসলমানের ভাষা উর্দু কিন্তু এটি ঠিক নয়। কারণ মুসলমানের ভাষা উর্দু নয় আরবি। উপরন্তু উর্দু যৌথ পাকিস্তানের মাত্র ৩.৬৫ শতাংশ মানুষের ভাষা। এ সকল কারণে বাংলা সাহিত্য হতে স্বনামধন্য কবির কবিতার শব্দ বদলে তথাকথিত হিন্দুত্ব বর্জন করার অপচেষ্টা করেছিল যেমন- সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি। চরণ দুটিতে দুটি শব্দ পরিবর্তন করে লেখা হয়েছিল- ফজরে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি সারাদিন আমি যেন নেক হয়ে চলি। এছাড়াও পাঠ্যপুস্তকে কাজী নজরুল ইসলামের চল্ চল্ চল্-কবিতাটির- নব নবীনের গাহিয়া গান সজীব করিব মহাশ্মশান। পংক্তির শেষ শব্দটির স্থানে ‘গোরস্থান’লেখা হয়েছিল। (মাহমুদউল্লাহ ১৯৯: ৬৭)। শুধু তাই নয় উদ্ভট নিয়ম আবিষ্কার করে রোমান, আরবী ও উর্দু হরফে বাংলাভাষা লেখার চেষ্টা চালিয়ে এবং সম্রাট আকবর কর্তৃক সকল ধর্মের সমন্বয়ে সৃষ্ট ধর্ম ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’র অনুকরণে সমগ্র পাকিস্তানের সকল ভাষা বিলুপ্ত করে একটি জাতীয় ভাষা প্রণয়নেরও ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল। শেখ মুজিবের আন্দোলন ও উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড ১৯৬৩ সালে লেবাননের রাজধানী বৈরুতের এক হোটেলে অসুস্থতার চিকিৎসাকল্পে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হঠাৎ ও নিঃসঙ্গ মৃত্যু অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। তাঁর অবর্তমানে আওয়ামী লীগের সকল নেতাকর্মী ও জনগণ শেখ মুজিবের ওপর সভাপতির গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেন। দায়িত্ব পেয়ে তিনি এককভাবে দলকে সংগঠিত ও আন্দোলনে সফলভাবে সম্পৃক্ত করেন। পাক গোয়েন্দা সংস্থার গোপন একটি রিপোর্টের ভিত্তিতে ১৯৫৮ সালের ১২ অক্টোবর শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। রিপোর্টটিতে অন্যান্য গোপন সংবাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগকে বিলুপ্ত করা হয়েছে মর্মে একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর ছিল। এ সংবাদ গোপনে কর্ণগোচর হলে পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যত অন্ধকার দেখে গ্রেফতারের অব্যবহিত পূর্বে শেখ মুজিব তাঁর বিশ্বাসী কয়েকজন নেতাকর্মীকে ভবিষ্যদ্বাণী করে বলে গিয়েছিলেন: ক। পূর্ব পাকিস্তানে পাঞ্জাবি শাসনের সূত্রপাত হয়েছে ফলে চলমান সামরিক আইন চিরস্থায়ী হবে। খ। পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের কলোনি হবে। গ। চিরদিনের জন্য পূর্ব পাকিস্তান শেষ হয়ে যাবে। ঘ। সামরিক আইন থাকাকালীন সকল নেতাকর্মী যেন নিষ্ক্রিয় থাকে এবং সকলের কানে কানে প্রচার চালায়। পরবর্তীকালে দেখা যায় তার ভবিষ্যদ্বাণীগুলো সবই ফলেছে। (সুব্রত বড়ুয়া ও অন্যান্য ২০১২:৩৫) ভারত বিভাগ পরিকল্পনায় বাংলা ও বাঙালীকে একত্রে রাখার জন্য ১৯৪৬ সালের ১৬ মে ব্রিটিশ ক্যাবিনেট এর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সৃষ্ট ‘ব্রিটিশ ক্যাবিনেট মিশন’ বাংলা ও আসামকে ‘(৩) গ্রুপ সি’ এর অন্তর্ভুক্ত করেছিল। (মযহারুল ইসলাম ১৯৭৪ : ৬৫) তদুপরি ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান সৃষ্টির সময় সিলেটের অন্তর্ভুক্তি ছিল অমীমাংসিত। সিলেট ছিল না ভারতের না পাকিস্তানের অংশ। ঐ সময়ে সিলেটকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য শেখ মুজিব প্রায় ৫০০ নেতাকর্মী নিয়ে অক্লান্ত কর্মতৎপরতা চালান। তিনি সিলেটকে পূর্ববঙ্গের অন্তর্ভুক্তি এবং ভাষা আন্দোলনে সশরীরে উপস্থিত থেকে আন্দোলনকে বেগবান করেন। এ কারণে সিলেট অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণে গণভোট (Referndam) অনুষ্ঠিত হয় এবং ভোটে বিজয়ী হয়ে সিলেট পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। বাংলাদেশের সিলেট প্রাপ্তির সম্পূর্ণ কৃতিত্বই শেখ মুজিবের অথচ তখন তিনি ছিলেন একজন বিএ শ্রেণীর তরুণ ছাত্র মাত্র। অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের উদাসীনতায় গুরুত্বপূর্ণ নগরী কলকাতা হারাতে হয়েছে। কলকাতায় সোহরাওয়ার্দীর জনপ্রিয়তায় ভীত জিন্নাহ গোপনে চাচ্ছিলেন যেন তার পরিবর্তে নাজিমুদ্দিন ক্ষমতায় আসে। ফলে কৌশলী ইলেকশনে নাজিমুদ্দিন বিজয়ী হয়েই সোহরাওয়ার্দীকে কোণঠাসা করতে এবং কলকাতাকে এড়িয়ে যেতে লাগলেন। তিনি ‘মুসলিম লীগ বা অন্য কারও সঙ্গে পরামর্শ না করেই ঘোষণা করলেন ঢাকাকে রাজধানী করা হবে। তাতেই আমাদের কলকাতার ওপর আর কোন দাবি রইল না।’ (শেখ মুজিব ২০১৩ : ৭৮) ফলে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের জন্য দেশ বিভাগ সহজ হলো, যেমন: শিয়ালদহ, মুর্শিদাবাদ, দার্জিলিং শহরগুলো এবং বনগাঁও জংশন, নদীয়া, কৃষ্ণনগর, রানাঘাট, মালদহ, দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি শহরগুলোর আংশিক হারাতে হয়। (শেখ মুজিব ২০১৩ : ৭৮) ঐ সময়ে চলমান ‘কলকাতা রাখ’ আন্দোলনটি খাজা সাহেবের বেগবান করা উচিত ছিল। যেমন শেখ মুজিব প্রায় ৫০০ ততোধিক নেতাকর্মী নিয়ে আন্দোলন করে সিলেট অর্জন করেছিলেন তেমনি তিনি যদি কলকাতার মুসলমানদের আহ্বানে তাদের সঙ্গে এবং পূর্ববঙ্গের বাঙালীদের নিয়ে জোর দাবি জানিয়ে আন্দোলনটি করতেন তবে ভাষা বিচারের বিবেচনায় এবং দেশ বিভাজনের যুক্তিতে অবশ্যই সিলেট প্রাপ্তির মতো কলকাতাও বাংলাদেশেরই অংশ হতো। কিন্তু নাজিমুদ্দিন সাহেব গুরুত্ব না দিয়ে অবহেলা করে স্বেচ্ছায় ‘কলকাতা রাখ’ আন্দোলন এড়িয়ে গেছেন। তিনি বাংলা অধ্যুষিত এবং বাংলা ভাষা চর্চার সংখ্যাধিক্যের জনপদ কলকাতাকে পাকিস্তানের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তির কথা বিবেচনায়ই নিলেন না। (মযহারুল ইসলাম ১৯৭৪ : ৭৭)। তার ধারণা ছিল যে পূর্ববঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হলে কলকাতাই হবে বাংলার রাজধানী ফলে ঢাকা তার গুরুত্ব হারাবে কিন্তু উদাসীন খাজা সাহেব জানতেন না যে ১৯৪৭ সালের ৩রা জুন ‘ভারত স্বাধীনতা আইনে’ ঢাকাকে পূর্ব বাংলার রাজধানী হিসেবে পাস করা হয়েছে এবং তা অপরিবর্তনীয়। (মযহারুল ইসলাম ১৯৭৪: ৭৭) প্রতিবাদী শেখ মুজিব কঠিন পরীক্ষণোত্তর ফল যেমন পরিশুদ্ধ, লক্ষ্য অর্জনের একাগ্রতা তেমনি সাফল্যের চিহ্ন। শেখ মুজিবের প্রতিবাদী সত্তার বিস্ফোরণ একক কোন ঘটনা বা কারও অনুপ্রেরণায় সৃষ্ট নয়। এটি তার সত্তাজাত একটি জন্মবৈশিষ্ট্য। নেতাজি, গান্ধীজি, তিতুমীর, সিরাজউদদৌলাহ প্রমুখদের মতো দেশপ্রেমের মন্ত্র তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রোথিত। ‘তাঁর সংগ্রামী জীবনের প্রথম অধ্যায়ে তিনি যে উদ্দেশ্য ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার বাসনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজনীতির দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন, সেই অচরিতার্থ বাসনাই বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে সংগ্রাম করতে করতে তাঁকে সাফল্যের সিংহ দ্বারে উপস্থিত করেছে।’ (মযহারুল ইসলাম ১৯৭৪: ১২) যে আশা আকাক্সক্ষা নিয়ে শত মায়ের কোল খালি করে এবং স্বদেশী আন্দোলনোত্তর ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছিল তা-তো পূরণ হয়ই নি বরং কথিত সভ্য ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের কঠোরতার চেয়ে পাক শাসন ছিল নির্মমতর। এ যেন হতভাগা বাঙালীর তপ্ত কড়াই হতে জ্বলন্ত উনুনে পতন। এ জন্য শেখ মুজিব আক্ষেপ করে বলেছিলেন ‘[...] -এ কথা কোন দিন ভাবিনি। নিজ দেশে নিজেদের সরকারের বিরুদ্ধেও ব্রিটিশ আমলের মতো জনগণের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে হবে ভাবলে মন আমার শিউরে ওঠে।’ (মযহারুল ইসলাম ১৯৭৪ : ২৩৯) চলবে... লেখক : অধ্যক্ষ, সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ
×