ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ মোফাজ্জল

গল্প ॥ এখানে ওজন মাপা হয়

প্রকাশিত: ২১:২২, ২১ আগস্ট ২০২০

গল্প ॥ এখানে ওজন মাপা হয়

‘এখানে মানুষের ওজন মাপা হয়। মাত্র দুই টাকা।’ রেলস্টেশনের ওভার ব্রিজের ওপর লোকমানের ওয়েট স্কেল মেশিনের পাশে লেমিনেটিং করা কাগজে এমন লেখা দেখে এক পথচারী থমকে দাঁড়ান। লোকমান উৎসুক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে, ওজন মাপবেন নাকি? পথচারী লেখাটার দিকে অনড় চাহনীতে তাকিয়েই আছেন। লোকমানের মনে হলো ওজন মাপার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও লোকটি কোন কারণে তার মেশিনে ওঠে দাঁড়াতে জড়তা বোধ করছেন। লোকমান সহায্যে বলল, ভাই, মেশিনে উইঠা খাড়াইয়া পড়েন। ওজন মাপতে মাত্র দুই টেকা লাগে। পথচারী লেখাটার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে লোকমানের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার সাইনবোর্ডে এমন কঠিন কথা লিখলেন! কেমন কঠিন কথা? এই যে লেখা আছে- এখানে মানুষের ওজন মাপা হয়। মাত্র দুই টাকা। লোকমান লেমিনেটিং করা লেখাটা হাতে নিয়ে বলল, আমি লিখি নাই। কম্পিউটারের দোকানে গিয়া কইছি আর হেরা লিইখা দিছে। কিন্তু কথা তো ঠিকই আছে। আমি তো মাইষেরই ওজন মাপি। এই লেখার মানে বুঝেন? বুঝুম না ক্যান? মানুষ আমার এই ওজন মাপার মেশিনের ওপর খাড়ায় আর মেশিন ফাট কইরা কইয়া দেয় তার ওজন কত কেজি। তারপর তারা আমারে দুই টেকা দেয়। পথচারী আবার কী যেন ভাবতে থাকেন। আর লোকমান অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। পথচারী ভাব গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললেন, ধরুন, একটা লোক কোন নিরীহ শিশুকে ধর্ষণ বা খুন করল। সেই লোকটা কি আর মানুষ থাকল? লোকমান মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, মাছুম বাচ্চা ধর্ষণ বা খুন কইরা একজন মানুষ থাহে কেমনে? পথচারী আরও ভাব গাম্ভীর্য নিয়ে বললেন, ঠিক বলেছেন। আর সেই লোকটা যদি এই ব্রিজের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় আপনার মেশিনে ওঠে ওজন মাপে তাহলে কি সেটা মানুষের ওজন হবে? পড়াশোনা না জানা লোকমান যেন আকাশ থেকে পড়ে। সে মাথা চুলকিয়ে বলে, এইভাবে তো ভাবি নাই। আপনি তো আমারে চিন্তায় ফালাইয়া দিলেন। অচেনা লোকমান মনোযোগী ছাত্রের মতো তাকিয়ে আছে দেখে পথচারীর ভাললাগল। তিনি খোলা আকাশের নিচে মুক্ত পাঠশালায় অচেনা বয়স্ক ছাত্র লোকমানকে বললেন, সব শিশুই নিষ্পাপ। তাদের ওজনে ঝামেলা নেই। কিন্তু বয়স্ক লোকের ওজন সব সময় ঠিক থাকে না। কর্মের কারণে অনেক সময় তাদের ওজন একটু এদিক সেদিক হয় কিংবা কখনো একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে যায়। লোকমানের বিস্ময় আরও বাড়ে। বেকুবের মতো পথচারী শিক্ষকের দিকে তাকিয়ে থাকে। পথচারী হাঁটা শুরু করেন। মানুষটা যতক্ষণ দৃষ্টি সীমায় ছিল ততক্ষণ লোকমান তার পেছনে তাকিয়ে রইল। অক্ষর জ্ঞানহীন লোকমানের মনে হলো কিছু বিষয় বোঝার জন্য পড়াশোনার দরকার নেই। পড়াশোনা না জানার আক্ষেপটাও তাকে কিছুটা পোড়ায়। এমন সময় সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া আরেক পথচারী ওজন মাপতে তার মেশিনে পা তুলতে যাওয়ার সময় লোকমান বাধা দিয়ে বলল, ভাই, ওজন মাপা যাইব না। মেশিন নষ্ট। পথচারী ক্ষুব্ধ হলেও কিছু না বলে চলে গেল। লোকমান অনেক দিন ধরে ওভারব্রিজের ওপর এই জায়গাটায় ওজন মাপার মেশিনটা নিয়ে বসে। পথচারীদের অনেকে নিজের দেহের ওজন মেপে দুই টাকা করে দেয়। কোন পরিশ্রম নেই। অল্প পরিশ্রমের বিবেচনায় স্বল্প পুঁজিতে কেনা ওজন মাপার মেশিন থেকে তার রোজগার নেহায়েত খারাপ আসে না। দিন শেষে জমা হওয়া খুচরো টাকা ও কয়েনগুলো গুছিয়ে হালকা মেশিনটা ব্যাগে ভরে কাঁধে নিয়ে চলে যায়। বিভিন্ন ওভারব্রিজে বা রাস্তার ধারে যারা পথচারীর ওজন মাপার মেশিন নিয়ে বসে তাদের সবার মেশিনের পাশে লেমিনেটিং করা সাদা কাগজে একটা লেখা থাকে। কম্পিউটার কম্পোজের দোকান থেকে প্রিন্ট করা লেখাতে ওজন মাপতে কত লাগে তা উল্লেখ থাকে। এটা তাদের সাইনবোর্ড। সবার সাইনবোর্ডে প্রায় অভিন্ন যে কথা লেখা থাকে তা হচ্ছে- ‘এখানে ওজন মাপা হয়, মাত্র দুই টাকা।’ এমন লেখায় কখনও বানান ভুল থাকে। কিন্তু লোকমানের সাইনবোর্ডের লেখাটা নির্ভুল ও ভিন্ন। এই লেখায় তার কোন হাত ছিল না। মেশিন কিনে রাস্তায় লোকজনের ওজন মাপতে বসার আগে সে এক কম্পিউটার কম্পোজের দোকানে গিয়ে বলেছিল এমন একটা লেখা লিখে প্রিন্ট করে দিতে। কম্পোজার ‘এখানে মানুষের ওজন মাপা হয়, মাত্র দুই টাকা’ লিখে লেমিনেটিং করে সেটা লোকমানের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। লোকমান শুধু প্রিন্টিং আর লেমিনেটিংয়ের বিল দিয়ে লেখাটা নিয়ে এসেছিল। সেটাও প্রায় তিন মাস আগের ঘটনা। কিন্তু এতদিন তার মেশিনে ওঠে যেসব পথচারী ওজন মেপেছেন তাদের কেউই তার সাইনবোর্ডের লেখা নিয়ে প্রশ্ন তুলেননি। লোকমান আবার সেই কম্পিউটার কম্পোজের দোকানে গেল নতুন করে আরেকটা লেখা প্রিন্ট করিয়ে আনতে। কিন্তু যে কম্পোজার কঠিন কথাটা লিখে দিয়েছিল তাকে আর পাওয়া গেল না। অন্যত্র চলে গিয়েছে। তাকে দেখতে লোকমানের খুব ইচ্ছে করছিল। এবার কী লিখলে ভাল হয় সেটা নতুন কম্পোজার লোকমানের কাছে জানতে চাইল। তার মাথায় তখনও ঘুরপাক খাচ্ছিল বোদ্ধা পথচারী শিক্ষকের কথা। তিনি বলেছিলেন, সব শিশুই নিষ্পাপ। তাদের ওজনে ঝামেলা নেই। লোকমানের কথা অনুযায়ী কম্পোজার যে কথা লিখল তা হলো- ‘এখানে শিশুদের ওজন মাপা হয়। মাত্র দুই টাকা।’ লোকমান এখন থেকে শিশুদের ওজনই মাপবে। সে আর ভেজালে নেই। পরদিন লোকমান ওভারব্রিজের ওপর একই জায়গায় তার ওজন মাপার মেশিন নিয়ে বসল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যারা তার মেশিনে ওঠে দেহের ওজন মাপে তাদের অধিকাংশই পাশে রাখা কাগজে কী লেখা আছে সেটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখে না। দেখলেও কেউ কিছু বলে না। সে কারণে কয়েকজন বয়স্ক লোক ওজন মাপতে চাওয়ার সময় লোকমান বাধা দিয়ে তার কাগজের সাইনবোর্ডর লেখাটা দেখিয়ে দিল। তাদের কেউ কেউ বিরক্তি প্রকাশ করে বা অনুচ্চস্বরে কিছু একটা বলে চলে গেল। কিন্তু এক ঘাড়ত্যারা লোক মেশিনের ওপর পা তোলার সময় লোকমান বাধা দেয়ায় সে বিবাদে জড়িয়ে পড়ল। লোকমান তাকে মেশিনের পাশে ছোট সাইনবোর্ড দেখিয়ে দিল। লোকটি ‘এখানে শিশুদের ওজন মাপা হয়। মাত্র দুই টাকা’ লেখাটা পড়ে বলল, আপনার সমস্যা কী? লোকমান নির্লিপ্তভাবে বলল, কোন সমেস্যা নাই। আমি মানুষ না চিইনা ওজন মাপি না। রাস্তার দুই টাকার সম্মানীর লোকমানের এমন অপমানজনক কথায় লোকটার মাথায় যেন রক্ত ফিনকি দিয়ে ওঠে। দাঁত চেপে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, বড়দের ওজন মাপেন না। শিশুদের ওজন মাপেন। সব শিশুকে আপনি চিনেন? চিনুম না ক্যান? সব শিশু নিষ্পাপ। তাদের ওজনে ঝামেলা নাই। লোকটা এবার আর মেজাজ ধরে রাখতে না পেরে ধমকের সুরে বলল, এইখানে ফাইজলামি করতে বসছেন? কিন্তু লোকমান উত্তেজিত হয়নি। ঠা-া মাথায় বলল, ফাইজলামি করুম ক্যান? ভাই, আপনার কোন সন্তানাদি আছে? অনিচ্ছা সত্ত্বেও লোকটি বলল, আমার পাঁচ বছরের একটা মেয়ে আছে। মাশাল্লাহ। এখন কন আপনার মেয়েটা নিষ্পাপ কিনা? আমি না দ্যাইখাই কইতে পারি যে আপনার সন্তানডা নিষ্পাপ। নাকি আপনার কোন সন্দেহ আছে? সন্দেহ নাই। এখন কন আপনার সন্তানরে আমি চিনি কিনা? ঘাড়ত্যাড়া লোকটির রাগ এক মুহূর্তেই হাওয়া হয়ে গেল। কিছুক্ষণ বোবার মত দাঁড়িয়ে থেকে বলল, আচ্ছা, এবার কন আপনি না চিনে বড়দের ওজন কেন মাপেন না। লোকমান বলল, মাইষের মইধ্যেও পশু আছে। ধরেন, সেই পশুটা একটা মাছুম বাচ্চাকে ধর্ষণ করল। সেই পশুটা এই বিরিজের ওপর দিয়া যাওনের সময় আমি কি তার চেহারা দেইখা চিনুম? চিনুম না। সে যদি আমার মেশিনে উইঠা ওজন মাপে সেইটা কি মাইনষের ওজন হইব? ঘাড়ত্যাড়া লোকটির চোখে ভেসে উঠল তার ছোট্ট মেয়েটির চেহারা। ঘরে ফিরলে স্ত্রীর আগে মেয়েটিই দরজা খুলে লাফিয়ে কোলে ওঠে। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলে সারাদিনের সব ক্লান্তি জুড়িয়ে যায়। লোকমানের কথা শোনে এক অজানা আতঙ্কে তার বুকটা চিনচিন করে ওঠে। নরপশুদের হাতে কতশত শিশু ধর্ষিত হচ্ছে। লোকটা এবার সমীহের চাহনিতে লোকমানের দিকে তাকিয়ে হাঁটা দিল। কিন্তু লোকমানের দিনটা ভাল যায়নি। ব্রিজের ওপর দিয়ে বয়স্কদের তুলনায় শিশুদের যাতাযাত কম। যে কটি শিশু অভিভাবকের হাত ধরে তার সামনে দিয়ে গিয়েছে তাদের অধিকাংশের ওজন মাপা সম্ভব হয়নি। লোকমান মাঝে মাঝে শিশুদের বাবুসোনা কিংবা মামণি ডেকে অভিভাবকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তার মেশিনে সন্তানের ওজন মাপার জন্য। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে সাড়া দিয়েছেন মাত্র চারজন অভিভাবক। আর চার শিশুর ওজন মেপে লোকমান চার দুগুণে আট টাকা পেয়েছে। লোকমানের রোজগারে মহাধস। ব্রিজের ওপর বসে করুণ চাহনিতে সে সারা দিনের রোজগার মাত্র আট টাকার দিকে তাকায়। এবার তার ভাবনা বাঁক নেয়। সে আবার সাইনবোর্ডের লেখা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিন লোকমান নতুন সাইনবোর্ড নিয়ে ব্রিজের ওপর পথচারীদের ওজন মাপতে বসে। এবার তার ওজন মাপার মেশিনের পাশে লেখা- ‘এখানে শরীরের ওজন মাপা হয়। মাত্র দুই টাকা।’ সে পথচারীদের উচ্চৈঃস্বরে ডেকে বলে, আসেন, আসেন। শইল্লের ওজন মাপেন। নতুন মেশিন। শইল্লের ওজনে কোন ঝামেলা পাইবেন না। মাত্র দুই টেকা। ওজন নব্বই কেজি হইলেও দুই টেকা নয় কেজি হইলেও দুই টেকা। আপনাগরই লাভ। আমার সমান সমান। আসেন আসেন, শইল্লের ওজন মাপেন। কিন্তু শরীরের ওজন মাপতে লোকমানের হাঁকডাকে কিছু পথচারী বিব্রত বোধ করে মারমুখী চাহনিতে তাকায়। একজন ত্যাড়ে এসে বলল, ওই মিয়া, মানুষ তো শরীরের ওজনই মাপে। এই কথা কি চিল্লাইয়া কইতে হয়? এইখানে বইসা মানুষকে টিটকারি মারেন? লোকমান কিছু না বলে চুপ থাকে। কখনও একা মিটিমিটি হাসে। কিছুক্ষণ পর বিশাল দেহের এক লোক তার মেশিনের সামনে দাঁড়িয়ে সাইনবোর্ডের লেখাটা পড়ে কী যেন ভাবতে থাকে। লোকটা যেমন উঁচু তেমন মোটা। লোকমান হেসে বলে, ভাই, মেশিনে উইঠা খাড়াইয়া পড়েন। আমার মেশিন নতুন। শৈল্লের ওজনে কোন ঝামেলা পাইবেন না। কিন্তু লোকটি ‘এখানে শরীরের ওজন মাপা হয়’ লেখাটার দিকে তাকিয়েই আছে। তার স্মৃতিতে হানা দেয় শীর্ণকায় এক অসহায় ছেলের কথা। সেই ছেলেটি তার এক প্রতারণতার ঘটনা দেখা ফেলায় টুটি চেপে ধরে বলেছিল, ‘শরীরে নাই এক ছটাক গোস্ত, তারপরও আমার সঙ্গে লাগতে আইছস?’ জবাবে শীর্ণকায় ছেলেটি এই বিশাল দেহের লোকটিকে বলেছিল, ’শরীরে মাংস জমলেই কি মানুষের ওজন বাড়ে রে?’ লোকটি আর ওজন মাপতে লোকমানের মেশিনে ওঠার সাহস পায় না। মাথা নিচু করে হাঁটা দেয়। পেছন থেকে লোকমান বলে, ভাই চইলা যাইতেছেন যে? মাঝে মাঝে নিজের শরীরের ওজনটা চেক করতে হয়। সেদিনও লোকমানের রোজগার ভাল হয়নি। তার মনে হলো সব সর্বনাশের মূল হচ্ছে তার কাগজের সাইনবোর্ডের লেখা। পড়াশোনা না জানা লোকমানের যে উপলব্ধি হলো তা হচ্ছে, লোকজন উচিত কথা পছন্দ করে না। বেশি উচিত কথা বললে না খেয়ে মরতে হয়। পরদিন সে কম্পিউটার কম্পোজের দোকানে গিয়ে নতুন সাইনবোর্ড প্রিন্ট করিয়ে ব্রিজের ওপর পথচারীদের ওজন মাপতে বসল। এবার মেশিনের পাশে কাগজের সাইনবোর্ডে লেখা- ‘এখানে ওজন মাপা হয়। মাত্র দুই টাকা’। সে হাসিমুখে পথচারীদের তার মেশিনে ওজন মাপতে ডাকে। এবার আগের মতো ভাল রোজগারের দেখা মেলে। মাঝে মাঝে ফাঁকা ব্রিজের ওপর অবচেতন মনে লোকমান একা একা বলে, আসেন, আসেন, ওজন, ওজন, মাত্র দুই টেকা, দুই টেকা...
×