ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

দুইদিনব্যাপী আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী শিল্প উৎসব শুরু

​​​​​​​সংস্কৃতি প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৩:১৩, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

দুইদিনব্যাপী আন্তর্জাতিক  প্রতিবন্ধী শিল্প  উৎসব শুরু

শিল্পকলার নাট্যশালায় আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী শিল্প উৎসবে মঞ্চস্থ নৈঃশব্দ ’৭১ নাটকের দৃশ্য

শিল্পকলা একাডেমির নাট্যশালার লবিতে প্রবেশ করতে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় নানা শিল্পকর্মে। মেঝেতে বৃত্তাকারে ছড়িয়ে আছে এক ধ্যানমগ্ন ঋষিসহ নানা অবয়বময় ভাস্কর্য। আর দেওয়ালে ঝুলে আছে বৈচিত্র্যময় কিছু চিত্রকর্ম। এসবের সঙ্গী হয়েছে কিছু কারুপণ্য। অদম্য শীর্ষক এই প্রদর্শনীর সকল কিছুই সৃজন করেছেন প্রতিবন্ধী শিল্পীরা। এখানেই শেষ নয়।

লবি পেরিয়ে মিলনায়তনে প্রবেশ করতেই দেখা মেলে মুক্তিযুদ্ধনির্ভর মঞ্চনাটকের। যে নাটকে সংলাপের পরিবর্তে মুখ্য হয়ে উঠেছে মঞ্চাভিনেতাদের শরীরী ভাষা। সংগীতের বাণীর সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রের সুরের সহযোগে মঞ্চস্থ হলো  ‘নৈঃশব্দ৭১শীর্ষক নির্বাক থিয়েটার। নাটকের মঞ্চশিল্পীদের কারোর নেই দৃষ্টিশক্তি, আবার কেউ কানে শোনে না কিংবা কথা বলতে পারে না। তবে তাদের ইশারা ভাষার অনবদ্য অভিনয়ে মুগ্ধ হলো দর্শক। আর এভাবেই সুন্দরের প্রতিচ্ছবি এঁকে শুক্রবার থেকে শিল্পকলা একাডেমি আঙিনায় শুরু হলো দুইদিনব্যাপী আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী শিল্প উৎসব। উৎসবে দেশের আট বিভাগের প্রতিবন্ধী শিল্পীদের নিয়ে নির্মিত নয় নাটকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারতের কলকাতার জনসংস্কৃতি সেন্টার ফর দ্য থিয়েটারের প্রযোজনাদ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড- জার্নি শুক্রবার মঞ্চস্থ হয়েছে পাঁচটি নাটক। আজ শনিবার উৎসবের সমাপনী দিনে মঞ্চস্থ হবে আরও পাঁচ নাটক। নাট্য মঞ্চায়নের সঙ্গে রয়েছে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী প্রতিবন্ধীবিষয়ক সেমিনার। প্রতিবন্ধীদের সুষ্টিশীলতা উদ্যাপনে জীবনের বহুমুখিনতার বিকাশে কার্যকর ভূমিকা রাখার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত উৎসবটির যৌথ আয়োজক ঢাকা থিয়েটার ব্রিটিশ কাউন্সিল। সহযোগিতায় রয়েছে প্রতিবন্ধীদের শিল্প সংগঠন সুন্দরম এবং আইআইডি (ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেটিকস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট)

শুক্রবার দুপুরে জাতীয় নাট্যশালার মিলনায়তনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সমাজক্যালমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। অতিথি হিসেবে আলোচনায় অংশ নেন ঢাকায় নিযুক্ত ডেপুটি ব্রিটিশ হাইকমিশনার ম্যাট ক্যানেল, গ্রেআই থিয়েটার কোম্পানির আর্টিস্টিক ডিরেক্টর জেনি সিলি, ব্রিটিশ কাউন্সিলের পরিচালক শ্যানন ওয়েস্ট আইআইডির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাঈদ আহমেদ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন উৎসব পরিচালক ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা নাসির উদ্দীন ইউসুফ। উৎসববিষয়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাণী থেকে পাঠ করেন শিমূল ইউসুফ। 

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডা. দীপু মনি বলেন, বঙ্গবন্ধু নিজেও সমাজের সব রকমের  বৈষম্য দূর করতে চেয়েছিলেন। বর্তমান সরকার সেই বৈষম্য দূর করে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়তে চায়। সকল প্রতিবন্ধীকে সমাজের মূল ধারায় আনার চেষ্টা রয়েছে আমাদের। কারণ, যারা নানা রকম প্রতিবন্ধিতায় আক্রান্ত, তাদের অনেকেই সৃজনশীলতায় অনেক সাধারণ মানুষের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। উৎসব সে বার্তাই দেয়। তাই প্রতিবন্ধীদের সমাজের মূল ধারায় নিয়ে আসার জন্য নীতিমালা করেছে সরকার। সরকার প্রতিটি মানুষের পাশে আছে। সবাইকে উন্নয়নের মূল ধারায় নিয়ে আসতে চায়। সেই বাস্তবতায় সাভারে ৪৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রতিবন্ধী ক্রীড়া কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে।  

আক্ষেপ প্রকাশ করে নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, সরকার ভাতা দিলেও আমাদের সমাজ প্রতিবন্ধীবান্ধব নয়। তাদের উপযোগী যানবাহন নেই, বিপণনকেন্দ্র নেই। এমনকি বিনোদনকেন্দ্রও নেই। এভাবে প্রতিবন্ধকতার শিকার পঞ্চাশ লাখ মানুষকে আমরা অদৃশ্য করে দিয়েছি। অথচ সুযোগ পেলে তারাও অনেক কিছু করতে পারে। তাদের অভিনীত নাটক দেখলে চোখ  ফেরানো যায় না।

সাইদ আহমেদ বলেন, প্রতিবন্ধকতাটা আসলে সমাজের। সমাজ তা দূর করতে পারলেই আমরা এগিয়ে  যেতে পারি। ঘরের বাইরে গেলে প্রতিবন্ধী মানুষকে খুব কম দেখা যায়। কারণ তাদের ঘরে বন্দি করে রাখা হয়। তাই তাদের  ভেতরের কথা তুলে ধরতে আমরা শিল্পমাধ্যমকে বেছে নিয়েছি। সহানুভূতির জায়গা থেকে এই উৎসব করা হয়নি, বরং অদম্যভাবে প্রতিবন্ধীদের এগিয়ে যাওয়ার চিন্তা থেকে উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। স্টিফেন হকিংয়ের কাজ দেখলে যেভাবে মনে হয় না তিনি একজন প্রতিবন্ধী, তেমনি এই শিল্পীদের শিল্পনৈপুণ্য দেখলেও মনে হবে না তারা প্রতিবন্ধী।

উৎসবের মাধ্যমে দেশের আট বিভাগের দুই শতাধিক শিল্পীর সম্মিলন ঘটেছে। নিবন্ধনের মাধ্যমে বিনা দর্শনীতে সকলের জন্য উন্মুক্ত এই প্রদর্শনী।  সারাদেশের প্রতিবন্ধী শিল্পীদের নিয়ে কাজ করার লক্ষ্যে ব্রিটিশ কাউন্সিলের সহযোগিতায় ঢাকা থিয়েটার ২০১৯ সালে (ডেয়ার) ‘ডিজ্যাবিলিটি আর্টস : রিডিফাইনিং এমপাওয়ারমেন্টশীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করে। প্রকল্পের আওতায়  দেশের আট বিভাগে সুন্দরম নামে আটটি প্রতিবন্ধী শিল্প চর্চাকেন্দ্রও প্রতিষ্ঠা করে ঢাকা থিয়েটার। সুন্দরমের সৃষ্ট নয়টি নাটক ঠাঁই পেয়েছে উৎসবে।

উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে মঞ্চস্থ হয় রমেশ মেয়াপ্প্যান নির্দেশিত নাটকনৈঃশব্দ৭১ এতে অভিনয় করেছেন আট বিভাগের ১৬ প্রতিবন্ধী শিল্পী। এর পর মঞ্চস্থ হয় মোস্তাফিজ শাহিন নির্দেশিত বরিশালের প্রযোজনাসার্কাস সার্কাস’, কাজী নওশাবা আহমেদ নির্দেশিত রংপুরের প্রযোজনাত্রিবেণীএবং এশা ইউসুফ রফিকুল ইসলাম নির্দেশিত ঢাকা বিভাগের প্রযোজনাকেন্দ্র বরাবর সুড়ঙ্গটির নাম পৃথিবী ছাড়া মঞ্চস্থ হয় . সঞ্জয় গাঙ্গুলী নির্দেশিত কলকাতার জনসংস্কৃতি সেন্টার ফর দ্য থিয়েটার অব দ্য ওপ্রেসড প্রযোজনাদ্য ওয়েস্ট ল্যান্ডÑ জার্নি ছাড়া প্রথম দিন সকালেডিজ্যাবিলিটি ইন দ্য আর্ট সেক্টরশীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।

আজ শনিবার উৎসবের সমাপনী দিনে দুপুর সোয়া বারোটা থেকে রাত সোয়া আটটা পর্যন্ত পাঁচটি পৃথক সময়ে মঞ্চস্থ হবে পাঁচটি নাটক। এসব প্রযোজনার মধ্যে রয়েছে- শামীম সাগর নির্দেশিত খুলনার প্রযোজনাঅতঃপর করিম বাওয়ালি’, আল জাবির নির্দেশিত ময়মনসিংহের প্রযোজনাকাজলরেখা’,  অসীম দাশ  নিদের্শিত চট্টগ্রাম সুন্দরমের প্রযোজনাস্বপ্নকাহন’, সামিউন জাহান দোলা নির্দেশিতসঙ্গতি . আমির জাহান নির্দেশিতপিতৃগণ  উৎসবের সমাপনী আয়োজনে বিশেষ অতিথি থাকবেন তথ্য সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আরাফাত এবং সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার খান।

×