ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৯ মে ২০২৪, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

সেমিনারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী

ডেঙ্গু গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০০:৪৫, ৮ মে ২০২৪

ডেঙ্গু গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে

ডেঙ্গু

প্রাণঘাতী ডেঙ্গুজ্বরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেনের মা মারা গিয়েছেন ১৯৮০ সালে। সেই দুর্বিষহ স্মৃতি এখনো তাকে তাড়া করে বেড়ায়। তাই তিনি চান না ডেঙ্গুতে আর কারও মৃত্যু হোক। এর জন্য যা যা করণীয় সব তিনি করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। মন্ত্রী বলেন, ডেঙ্গুতে আমি আমার মাকে হারিয়েছি। আর কাউকে যেন মা হারাতে না হয়, সেই পদক্ষেপ নেব।

এক্ষেত্রে শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন, ওয়ার্ড কাউন্সিলর, সংসদ সদস্যসহ সাংবাদিকদেরও একযোগে সচেতনতা তৈরির কাজ করার আহ্বান জানান তিনি। এমনকি মসজিদ-মন্দিরেও ডেঙ্গু বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচার চালানোর কথাও বলেন তিনি।
মঙ্গলবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ডেঙ্গুবিষয়ক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। এ সময় সামন্ত লাল সেন বলেন, মাত্র তিন দিনের জ্বরে আমার মা মারা গিয়েছিলেন। সে সময় আমরা ডেঙ্গু বিষয়ে জানতাম না। মারা যাওয়ার পর শরীরে স্পট দেখে বুঝতে পারি, মা ডেঙ্গুতে মারা গিয়েছেন। ডেঙ্গু নিয়ে আমার মনে একটা ভিন্ন কষ্ট আছে। আমি আমার মাকে হারিয়েছি। আর কাউকে যেন তার মাকে হারাতে না হয়, সে বিষয়ে অবশ্যই আমি পদক্ষেপ নেব।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু যদি গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তা হলে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে। আমাদের ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে হবে। রোগ হয়ে গেলে তখন আমরা চিকিৎসা করি। কিন্তু মানুষ যেন অসুস্থ না হয়, সে জন্য আমাদের কাজ করতে হবে। একইভাবে ডেঙ্গু যেন না হয়, সে জন্য আমাদের কাজ করতে হবে। এ জন্য সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। 
পরিবর্তন হচ্ছে ডেঙ্গুর আচরণ ॥ অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশিদ আলম বলেন, প্রতিনিয়ত ডেঙ্গুর আচরণগত পরিবর্তন হচ্ছে। আমরা জেনেছি ডেঙ্গু (এডিস) মশা রাতেও কামড়াচ্ছে এবং শুধুমাত্র পরিষ্কার পানিতে না জন্মে ময়লা পানিতেও জন্মাচ্ছে। এ ছাড়া গাছের কোটরেও জন্মাচ্ছে এডিস মশার লার্ভা। এ গাছের  কোটরে যদি এডিস মশা জন্মানো শুরু করে, গ্রামের জন্য এটি একটি অশনি সংকেত। গ্রামে গাছপালা বেশি,  সেখানে মশা দমন করা অনেক বেশি কঠিন হবে।
অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশিদ আলম বলেন, মশা মারার ক্ষেত্রে যেসব ওষুধ ব্যবহার করা হয় তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই জানিয়েছেন যে ফগিংয়ে মশা মরে না। ভারতেও উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় বন্ধ করা হয়েছে ফগিং কার্যক্রম। আমরা এসব বিষয়ে নোট নিয়েছি। এসব বিষয়ে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করব।

স্যালাইন সংকট রোধে কড়া নির্দেশনা ॥ গত বছর ডেঙ্গু যখন মহামারি আকারে দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল তখন দেখা দিয়েছিল তীব্র স্যালাইনের সংকট। এ বছর যেন এমনটি না হয় সে জন্য সংশ্লিষ্টদের কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। সেমিনারে তিনি বলেন, দেশে ডেঙ্গুতে যাতে মানুষ মারা না যায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। ডেঙ্গুর চিকিৎসায় আমি কড়া নির্দেশ দিয়েছি, যাতে স্যালাইনের ঘাটতি না হয়।

স্যালাইনের দামও বাড়ানো যাবে না। হাসপাতালে  যেন পর্যাপ্ত বেড থাকে।
ঢাকার বাইরেও ডেঙ্গুর ভালো চিকিৎসা আছে উল্লেখ করে ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, চিকিৎসাতে কোনো ঘাটতি হবে কিংবা চিকিৎসা জানে না এমন আর হবে না। ভালো চিকিৎসা ঢাকার বাইরেও হবে, ঢাকার ভেতরেও হবে। এতে কোনো সন্দেহ নাই। জ্বর এলে আমরা যদি সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করে হাসপাতালে ভর্তি হই, তা হলে ভালো চিকিৎসা এবং সুচিকিৎসা পাওয়া যাবে। ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিয়ে আমি বিশ্বাস করি, একেবারে উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসক যারা আছেন তারাও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।

শনাক্তকরণে দেশীয় কিট ॥ ডেঙ্গু শনাক্তের জন্য দেশেই তৈরি হচ্ছে ডেঙ্গু টেস্ট কিট। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান দাবি করেছে এই কিটের সাহাযে ঘরে বসেই করা যাবে ডেঙ্গু পরীক্ষা। বাংলাদেশ রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্টস-বিআরআইসিএম ডেঙ্গুর এই র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন কিটটি তৈরি করেছে, যা ডেঙ্গুর সব ধরনের সেরোটাইপ শনাক্ত করতে সক্ষম। এই কিটের বিষয়ে অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, আমি খুব খুশি, স্থানীয়ভাবে একটি ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিট তৈরি করা হয়েছে।

এটি খুবই ভালো উদ্যোগ। আমি সাধুবাদ জানাই। এ কিট যদি অনুমোদন পায়, তবে এটি যেন বাজারে আসে, সেই ব্যবস্থা আমরা করব। আমাদের দেশেই যদি কিট উৎপাদন করতে পারি, তা হলে বাইরের দেশ থেকে কেন কিনব? 
তবে সব ভ্যাকসিন তৈরির প্লান্ট একই হওয়ায় এক্ষেত্রে কিছুটা জটিলতা তৈরি হতে পারে উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, আমরা ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির সঙ্গে কথা বলেছি। তারা জানিয়েছে যে সরকার থেকে যদি অর্ডার পায় তা হলে (ভ্যাকসিনের) উৎপাদন শুরু করবেন। যেসব কোম্পানি ভ্যাকসিন উৎপাদন করে তাদের সব ভ্যাকসিন এবং স্যালাইন উৎপাদনের জন্য একই প্লান্ট।

তাই অন্য কোনো ভ্যাকসিনের সংকট যাতে না দেখা দেয়, সে জন্য আগে থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশীয় আবিষ্কারের কিট উৎপাদন বিষয়ে সরকারের সহযোগিতা প্রসঙ্গে ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, দেশীয় পদ্ধতিতে যে কিট আবিষ্কার হয়েছে সেসব কিট উৎপাদন বিষয়ে আরও বিশদভাবে পর্যালোচনা করা হবে।
আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার তৈরির সুপারিশ ॥ ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় ঢাকায় কোনো আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সেন্টার নেই। এর ব্যবস্থা করতে পারলে অনেক রোগীকে সহজে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে উল্লেখ করে অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, আরবান হেলথ কেয়ার থাকলে সাধারণ রোগীরা সেখানেই চিকিৎসা নিতে পারত। কিন্তু দেখা যায় সব রোগী সরাসরি বড় হাসপাতালে যায়। এতে করে যাদের দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন তাদের ক্ষেত্রে সেবা পেতে দেরি হয়ে থাকে।
প্রতিরোধে একযোগে কাজ করার আহ্বান ॥ ডেঙ্গু হলে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হবে। এ জন্য হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতি রয়েছে। কিন্তু হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতির চাইতে এই মুহূর্তে বেশি জরুরি ডেঙ্গু যাতে না হয় সে জন্য সবার একযোগে কাজ করা। তাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি মশা নির্মূলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, সব রোগের ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, যাতে রোগটি হওয়ার আগেই প্রতিরোধ করা যায়। মানুষের যাতে ডেঙ্গু না হয়, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। মশা নির্মূলে সবাই একসঙ্গে কাজ করবে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশন এবং যে ঘরে মানুষ থাকে সেখানকার সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।

কথা নয় কাজ বেশি করার তাগিদ ॥ ডেঙ্গু মোকাবিলায় নিজেদের অবস্থান থেকে অনেক দায়িত্বশীল লোকজন অনেক কথা বলে থাকেন। তবে যেখানে মানুষের জীবন-মরণ বিষয় জড়িত সেখানে কথার চাইতে কাজ বেশি করার তাগিদ দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, এখানে বক্তৃতা দেওয়ার পর বের হয়ে সব কিছু ভুলে গেলে হবে না। আমাদের কাজ করতে হবে। কথা কম কাজ বেশি, এটি আমি সবসময় বিশ্বাস করি। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সবার সহযোগিতা চাই। আপনারা আমাকে পরামর্শ দিন। সারাদেশে এমনকি উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসকরাও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ডেঙ্গুর চিকিৎসায় কোনো ঘাটতি হবে না। ডেঙ্গুর ভালো চিকিৎসা ঢাকাসহ সারাদেশে হবে, এতে  কোনো সন্দেহ নেই। 
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন ব্র্যাকের ইউএইচসি প্রোগ্রামের চেয়ারপারসন, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মো. খুরশিদ আলম।
আরও বক্তব্য রাখেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের পরিচালক ডা. শেখ দাউদ আদনান, বাংলাদেশ রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর ক্যামিকেল অ্যান্ড মেজারমেন্টসের মহাপরিচালক ড. মালা খাতুন প্রমুখ।

×