ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

করোনা ॥ অমানবিকতা ও মানবতা

প্রকাশিত: ০৯:৫৬, ১৩ এপ্রিল ২০২০

 করোনা ॥ অমানবিকতা ও মানবতা

বিশ্বজুড়ে দুই শতাধিক দেশে ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম মহামারী আকারে বিস্তৃত করোনার বাংলাদেশে সংক্রমণকে এখনও তেমন বড় কিছু হিসেবে দেখা যায় না। আক্রান্ত মানুষ বা মৃত্যুর হিসাব কোনটাই আমেরিকা, ইতালী, স্পেন বা চীনের তুলনায় আতঙ্ক তৈরির মতো নয়। বরং যে পরিমাণ সতর্কতা গ্রহণ করা হয়েছে বা করোনাকে মোকাবেলা করার জন্য যতো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তাতে আতঙ্ক থাকার কোন কারণ নেই। তবে সংক্রামক ব্যাধি বিধায় করোনার বিস্তার রোধে সতর্কতা-বিধি মেনে চলা ও সংক্রমণ থেকে বেঁচে থাকা বা অন্যকে বাঁচানোর বিষয়টি কোন কোন ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মাঝে আছে। তবে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশের মানুষের সচেতনতার স্তর অনেকটাই ওপরে উঠেছে এটি নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে করোনা বিষয়ক সতর্কতা। দেশে দেশে সঙ্গনিরোধ, রুমবন্দী, সামাজিকতা বর্জন কেবল স্বেচ্ছাপ্রয়োগ নয় আইনশৃক্সক্ষলা বাহিনীর মাধ্যমে প্রয়োগ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য সেনাবাহিনী নিযুক্ত রয়েছে। বিশ্ব যেহেতু ডিজিটাল সেহেতু সারা বিশ্বের মানুষই এখন দুনিয়ার এক প্রান্তের খবর অন্য প্রান্ত থেকে পাচ্ছে। যেমন করে ভালটা ওরা জানতে পারছে তেমনি খারাপটাও তাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। এই ভাল মন্দ তথ্যের মাঝে ভয়ঙ্করভাবে যুক্ত হচ্ছে ভুয়া তথ্য বা গুজব। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বাহন হয়ে উঠেছে ডিজিটাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম-বিশেষত ফেসবুক। অবস্থা আয়ত্তের বাইরে যাবার মতো হওয়ায় এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে তীব্রভাবে সতর্কও করতে হয়েছে। মানব সভ্যতার শুরু থেকেই সত্য মিথ্যা তথ্য জন্ম নিয়েছে এবং একদল মানুষ মিথ্যা তথ্য অপপ্রচার করে ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। মানুষ যখন গুহায় বা গুচ্ছভাবে গ্রামভিত্তিক বসবাস করত তখন সত্য বা মিথ্যা তথ্যের বিস্তারের পরিধিটাও সেই ভৌগোলিক সীমানাতেই সীমিত থাকতো। কিন্তু সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তি ও গণমাধ্যমের বিকাশ ঘটতে থাকায় এর বিস্তৃতি ব্যাপক হয়েছে। এখনকার দুনিয়াতে এই ভয়াবহ বিস্তৃতির নাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এই মাধ্যমগুলো যেমনি মানুষকে সহায়তা করে তেমনি এর অপূরণীয় ক্ষতি করার সক্ষমতা রয়েছে। দুনিয়ার অন্য কোথাও যাই থাকুক বাংলাদেশে এটি স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিরও হাতিয়ার। একে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাস বা আতঙ্ক ছড়ানো ছাড়াও রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য চ্যালেঞ্জিং এ জন্য যে কেবল দেশের ভিতরেই নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে দেশের বাইরে থেকেও ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্যদিকে মূল ধারার গণমাধ্যমের বাইরে ডিজিটাল প্লাটফরমকে ব্যবহার করে বিপুল সংখ্যক মিডিয়া লাইক ও বিজ্ঞাপন পাবার আশায় গুজবের বাণিজ্য করছে। খুব মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে দেখলে এটি বোঝা যায় যে এসব গুজব বা অপপ্রচারের রাজনৈতিক চরিত্রও আছে। দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি শেখ হাসিনার সরকারকে হেয়-অক্ষম ও ব্যর্থ প্রমাণ করার জন্য করোনাভাইরাস নিয়ে মিথ্যা-বানোয়াট ভিত্তিহীন ও মনগড়া তথ্য প্রচার করছে। মার্চের শেষ দিকেও অনেকের প্রচারণা এমন ছিল যে বাংলাদেশে কেন আক্রান্তের সংখ্যা বেশি নয় বা কেন মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি নয় সেটি যেন আফসোসের বিষয়। সরকারের মন্ত্রী থেকে মসজিদের ইমাম অবধি এসব গুজবের হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না। এসব গুজব প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজে বার বার চেষ্টা করেও বিশেষ করে সোসাল মিডিয়ার গুজব নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যার প্রভাব বাংলাদেশে অত্যন্ত প্রবল তারা বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধকে মোটেই গ্রাহ্য করছে না। সরকারের পক্ষ থেকে ফেসবুকের কাছে ২৩ মার্চ থেকে ৭ এপ্রিল ৩১২টি গুজবের লিঙ্ক বন্ধ করার আবেদন করার বিপরীতে ফেসবুকে মাত্র ৩০টি লিঙ্ক বন্ধ করেছে। দৃশ্যত মনে হচ্ছে ফেসবুকের অনিচ্ছা ছাড়াও বাংলা বোঝা এবং রোমান হরফে বাংলা বোঝা নিয়ে তাদের সঙ্কট আছে। বিষয়টি যাই হোক ক্ষতিটা যা হবার তা আমাদের হচ্ছে। অশ্য এমন গুজব নিয়ে সমস্যা এবারই প্রথম নয়। যতবারই আমরা কোন সঙ্কটের মুখোমুখি হই ততবারই গুজবের ডালপালা ছড়াতে থাকে। প্রশ্ন ফাঁস থেকে করোনা কোনটাকেই ওরা বাদ দেয়নি। করোনার আরও অমানবিকতা চোখে পড়ে যখন আক্রান্ত মানুষের সঙ্গে আপনজনসহ আত্মীয়স্বজন বা পাড়া প্রতিবেশীদের আচরণ ব্যাখ্যা করা হয়। কখনও কখনও মনে হয় আমরা যেন মানবিকতা হারিয়ে ফেলেছি। মানুষ তার প্রিয়জনকে ফেলে চলে যাচ্ছে বা মৃতদেহ সৎকার করছে না। ইমাম সাহেব জানাজা পড়াচ্ছেন না- বা জানাজায় শরিক হচ্ছেন না কেউ অথবা গোসল করানোর মানুষ নেই। মসজিদের খাটিয়া করোনা আক্রান্ত রোগী বহন করতে দেয়া হয়নি এমন নজিরও রয়েছে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে যে মৃতদেহ থেকে সংক্রমণের আশঙ্কা ক্ষীণ। এসব দৃশ্য মানব ইতিহাসে অমানবিকতারই প্রমাণ। এটি সত্য যে ভাইরাসটি ছোঁয়াছে সংক্রামক। ফলে ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবন যাপন করা অতি প্রয়োজনীয়। তবে সেটি মানার ক্ষেত্রেও এমন কোন কারণ নেই যে আমরা অমানুষ হয়ে যাব। সাধারণ মানুষতো বটেই অমানবিকতার ধারাটি চিকিসৎকদের একাংশের মাঝেও বিস্তৃত ছিল। কোন কোন বেসরকারী হাসপাতালে বন্ধ নোটিস, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু, ডাক্তার ও নার্স না পাওয়া, হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেও ডাক্তার না পাওয়া বা হাসপাতালে চিকিৎসা না পাওয়া অতীতের সকল নির্মমতাকে হার মানিয়েছিল। বিশেষ করে আমাদের দেশের বেসরকারী হাসপাতালগুলো এই সময়ে তাদের কর্তব্য ভুলে ছিল বলেই মনে হচ্ছে। আমার নিজের ব্যাখ্যা হচ্ছে তাদের নিজেদের সুরক্ষা প্রস্তুতি না থাকায় তারাও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। অবস্থা এমন হয়েছিল যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেও এমন ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বেসরকারী হাসপাতালগুলো যাদের ওপর দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার শতকরা ৬০ ভাগ নির্ভর করে তাদের নীরবতা সবাইকে বিস্মিত করেছিল। তবে ৯ এপ্রিল ২০২০ বেসরকারি হাসপাতাল ও কলেজের সমিতি প্রকাশ্যে ঘোষণা প্রদান করে যে, দেশের সকল বেসরকারী হাসপাতাল ২৪ ঘণ্টা খোলা থেকে জনগণকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে থাকবে। এটি প্রকৃতার্থে একটি বড় ঘোষণা। কারণ এর ফলে চিকিৎসা সেবার প্রাপ্যতা নিশ্চিত হতে পারে। এতে মুদ্রার উল্টো পিঠটার কথাও আমরা স্মরণ করতে পারছি। করোনার প্রাদুর্ভাব হবার পর সরকারী প্রচেষ্টার বাইরেও সাধারণ মানুষ হতদরিদ্র-দরিদ্র, নিম্নবিত্ত-দিনমজুরসহ সকল মানুষের পাশেই যার যার সাধ্যমতো এগিয়ে আসছেন। একজন আশিউর্ধ মহিলা তার হজের টাকা গরিব মানুষকে দিয়ে দিলেন। অনেকে বেসরকারী সংস্থা ও সামাজিক সংগঠন নিজেরা নিজেদের সামর্থ্য থেকে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন। অনেক বাসায় বাসায় ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছেন। অনেকে স্থানীয়ভাবে হতদরিদ্র-দরিদ্র-দিনমজুর বা দুস্থদের পাশে রয়েছেন। এরই মাঝে নতুন ধরনের মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপিত হতে শুরু করেছে। বহু মানুষ নিজেরা তাদের গ্রাম, পাড়া, মহল্লা বা এলাকাকে অন্তরীণ করে রাখছে। এসব এলাকায় কেউ ঢুকতে পারে না-বেরোতেও পারে না। দেশের বাণিজ্য সংগঠন, সামাজিক সংগঠন, যুব সংস্থা ইতাদির স্বেচ্ছাসেবা ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছে। কেউ কেউ ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালের ব্যবস্থাও করেছেন। এলাকা জীবাণুমুক্ত করা থেকে শুরু করে মাস্ক-সুরক্ষা সামগ্রী ও খাদ্য সামগ্রী বিতরণ ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। মানুষ আবার প্রমাণ করছে-মানুষ মানুষের জন্যই। প্রাথমিকভাবে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সামগ্রীর অভাব থাকায় বাংলাদেশের ডাক্তার ও নার্সদের মাঝে করোনায় সেবা দেয়ার বিষয়ে সংশয় ছিল হয়তো। কিন্তু যখনই ন্যূনতম সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যবস্থা হয়েছে তখন অন্তত সরকারী হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্সরা সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। নিজের ও পরিবারের ঝুঁকি নিয়েও রোগীদের পাশে থাকার এই মহতী প্রচেষ্টাকে একটি অসাধারণ মানবিক উদ্যোগ বলে মনে করা যায়। নারী পুরুষ-যুবা-বয়স্ক নির্বিশেষে বাংলাদেশের ডাক্তার ও নার্সদের এই অবদান জাতি অবশ্যই স্মরণ রাখবে। এটি অবশ্য কেবল বাংলাদেশে নয়, যে চীনে করোনার সূচনা সেখান থেকে সারা দুনিয়ার ডাক্তার ও নার্সরা এই মহাবিপদে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। এদের অনেক জীবন দিয়েছেন এবং তারা প্রতি মুহূর্তে বিপদের মাঝেই থাকছেন। তাদের একে অপরের মানবিক সম্পর্ক দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ডাক্তারী বা নার্স শিক্ষা গ্রহণের সময় তারা যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন এখন বা এরকম মহামারীর সময়ে সেটি পূরণ করে তারা সেরা মানুষের পরিচয় দিতে পারেন। যেসব ডাক্তার ও নার্স এখনও এই পথে পা দেননি তারাও আশা করি তাদের প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করে মানুষের পাশে দাঁড়াবেন। এটি কেবলমাত্র একটি চাকরি নয়। এটি বস্তুত মানবতার পাশে থাকা ও বিপন্ন মানুষের সেবা করা। সকল পেশায় থেকে এই অসাধারণ কাজ করা সম্ভব হয় না। ডাক্তারদের মতোই বিপদ মাথায় নিয়ে ব্যাংক, ডাক বিভাগ, বিদ্যুৎ বিভাগ, টেলিফোন, পরিবহন, ই-কমার্স, গণমাধ্যম, ওষুধসহ জরুরী পণ্য সরবরাহ ও বিতরণ অব্যাহত রাখার কাজে নিয়োজিত ইত্যাদি বিভিন্ন খাতের কর্মীরা জরুরী অবস্থায় জনগণকে সেবা দিচ্ছে। আমি একটি খবর শুনে বিস্মিত হয়েছি যে আমার ডাক বিভাগের মহিলা ড্রাইভাররা (এমনকি গর্ভবতী অবস্থাতেও) গাড়ি চালিয়ে জেলায় জেলায় চিকিৎসা ও সুরক্ষা সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা ডাকঘর খুলে সাধারণ মানুষকে ডাক সঞ্চয়পত্র ও পেনশনের টাকা দিয়েছে। টেলিফোনের বা ইন্টারনেটের লাইনম্যানরা ভয়কে জয় করে তাদের সেবা অব্যাহত রেখেছে। এই অবস্থাতে নিরলস কাজ করছেন কৃষিকর্মীরা। বিশেষ করে এখন ধানকাটার সময়। এই সময়ে দিনে রাতে শ্রম দিয়ে ধান কাটায় যারা নিযুক্ত তারা অবশ্যই ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। যদি আমরা সামগ্রিক অবস্থার ব্যাখ্যা করি তবে এই কথা বলতেই হবে যে বিশ্বজুড়ে বিরাজিত এউ মহাদুর্যোগ থেকে অবশ্যই আমরা পরিত্রাণ পাব। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সেই বাণীটা আমাদের স্মরণ রাখা দরকার। তিনি বলেছেন যে, বাঙালী বীরের জাতি এবং এবারও আমরা বিজয়ী হব। আমাদের সকলের বিশ্বাসও তা-ই। (মতামত লেখকের নিজস্ব) ঢাকা, ১০ এপ্রিল ২০২০ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান-সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা এর প্রণেতা [email protected], www.bijoyekushe.net.bd
×