ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

করোনাভাইরাসের ব্যবচ্ছেদ

প্রকাশিত: ০৭:৫৪, ৩০ মার্চ ২০২০

করোনাভাইরাসের ব্যবচ্ছেদ

আধুনিক বিশ্বের দেশগুলোর পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ক এত নিবিড় যে, সেটাই সার্স-কভ-২ এবং কভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস ছড়ানোর মহাসুযোগ এনে দিয়েছে। বিমান, ট্রেন ও অটোমোবাইল না থাকলে এসব ভাইরাসের পক্ষে এত দ্রুত এই পর্যায়ে আসা কখনই সম্ভব ছিল না। মাত্র কয়েক মাস আগে ভাইরাসটি চীনের উহানের কোন এক জায়গায় প্রথম মানবদেহে প্রবেশ করে। তারপর ২৪ মার্চ এই লেখাটি তৈরি করার সময় ভাইরাসটি গোটা বিশ্বের ১৯৬টি দেশে মানবদেহে ছড়িয়েছে। মোট ৩ লাখ ৬৭ হাজারেরও বেশি আক্রান্ত এবং ২৯ হাজারেরও বেশি মৃত্যুবরণ করেছে। বেশিরভাগ সংক্রমিত ব্যক্তির রোগ অনির্ণীতই থেকে গেছে। তবে বিশ্বের দেশগুলোর এই আন্তঃসংযোগই রোগটির পতনেরও কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা ভাইরাসটির জেনোম এবং যে ২৭টি প্রোটিন এটা তৈরি করে থাকে বলে জানা গেছে, তার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন। ভাইরাসটি সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানার চেষ্টা করছেন এবং কিভাবে একে ঠেকানো যায় তার উপায় খোঁজার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ নিয়ে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। ভাইরাসের জেনোম সিকোয়েন্সিংয়ের ওপর শত শত গবেষণাপত্র পাবলিক ড্যাটাবেজে চলে এসেছে। ল্যাবরেটরিতে ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা শুধু চলছেই না, উপরন্তু চীনে সার্স-কভ-২ ভাইরাস মোকাবেলায় যেসব ওষুধ ও ভ্যাকসিন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তালিকাভুক্ত করে রাখা হয়েছিল, সেগুলো মানবদেহে পরীক্ষার জন্য ইতোমধ্যে রোগী রিক্রুট করা শুরু করে দিয়েছে। ১১ মার্চ অবধি আমেরিকায় ৮৬টি প্রচলিত ওষুধ করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় কাজ দেয় কিনা তা পরীক্ষার জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ডিসেম্বরে ভাইরাসটির কথা বিজ্ঞানীরা জেনেছেন। কিন্তু এখনও সেটি দমন করার মতো ওষুধ উদ্ভাবিত হয়নি। ওষুধ উদ্ভাবনের ব্যাপারটা নিশ্চয়ই মন্থর। তবে ভাইরাসের মৌলিক বায়োলজিটা মোটামুটি ভালভাবে জানা হয়ে যাওয়ায় প্রচলিত কোন ওষুধ প্রয়োগ করলে সাফল্য লাভের খানিকটা সম্ভাবনা আছে তা নির্ণয় করা সম্ভব হয়ে উঠেছে। এতে অন্তত খানিকটা আশার ভিত্তি জোটে। কোন ওষুধে যদি করোনায় মৃত্যু বা অসুস্থতা সামান্য হলেও কমে, সেটাও এক বিরাট ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতে পারে। উহানের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে এবং ইতালির ক্ষেত্রেও দেখা গেছে যে, হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি সংখ্যক মারাত্মক অসুস্থ রোগীকে চিকিৎসা দিতে গেলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর অসহনীয় চাপ পড়ে। এক্ষেত্রে এমন কোন ওষুধ যদি কোন খাতে হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার সময়টা ২০ দিন থেকে ১৫ দিনে কমিয়ে আনা যায় তাহলে সেটাও হবে বিশাল ব্যাপার। করোনা ভাইরাসের পরিবারটি বিজ্ঞানের চোখে প্রথম ধরা পড়ে ১৯৬০-এর দশকে। কিন্তু ২০০২ সালে চীনের গুয়াংদংয়ে সেই পরিবারেরই একটি সদস্য সার্স (সিভিয়ার একিউট রেসপিটেরি সিনড্রোম)-এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার আগ পর্যন্ত জনসাধারণ তো পরের কথা, ডাক্তাররাও এ নিয়ে তেমন গা করেননি। পরিবারের সদস্যদের করোনা নামটি পাওয়ার কারণ সে সময়ে আদি অবস্থার ইলেকট্রনিক মাইক্রোস্কোপে ভাইরাসের আকৃতিটা রাজা-বাদশাহর মুকুটের মতো দেখতে লেগেছিল। আধুনিক পদ্ধতিতে দেখা গেছে যে, ভাইরাসের চেহারাটা নৌবাহিনীতে ব্যবহৃত পুরনো ধারার মাইনের মতো। করোনাভাইরাসের স্বীকৃত সদস্য এখন পর্যন্ত ৪০টিরও বেশি। এগুলো ব্ল্যাকবোর্ড, বাদুড় ও বিড়ালসহ নানা ধরনের স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখিদের সংক্রমিত করে থাকে। এই রোগগুলো শূকর, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির হয়ে থাকে বলে পশু-ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা এই ভাইরাসগুলোকে ভালমতো জানেন। কিন্তু মানুষের রোগব্যাধির ওপর মনোনিবেশ করা ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা করোনাভাইরাসের ওপর এতদিনে তেমন একটা নজর দেয়নি। দুটো সুপ্রতিষ্ঠিত করোনাভাইরাসে সাধারণ সর্দি-গর্মির ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ লক্ষণ দেখা দিলেও মানুষের ক্ষেত্রে মারাত্মক কোন রোগের কারণ ঘটায়নি। তারপর ২০০২ সালে এই পরিবারেরই একটি ভাইরাস এক জাতের বাদুড় থেকে সম্ভবত কোন মাধ্যমের দ্বারা মানবদেহে ছড়ায়। সেটাই এখন সার্স-কভ নামে পরিচিত। ওই রোগে সারা বিশ্বে প্রায় ৮শ’ জন মারা যায়। সার্স-কভের প্রাদুর্ভাবের পর পরিচালিত কিছু গবেষণায় এই তথ্যটি গুরুত্ব পায় যে, এই ভাইরাসের আত্মীয় অন্যান্য করোনাভাইরাসও সার্স-কভের পথ ধরে মানবদেহে আসতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত এমন ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ওইসব ভাইরাস দমনের সুনির্দিষ্ট কোন ওষুধ উদ্ভাবিত হয়নি। সার্স-কভ-২ যখন আঘাত হানল তখন এর চিকিৎসায় কোথাও কোন নির্দিষ্ট ওষুধ ছিল না। উল্লেখ্য, সার্স-কভ-২ নামটি দেয়া হয়েছিল এই কারণে যে, এর জেনোম ছিল সার্স-কভের জেনোমের অনুরূপ। সার্স-কভ-২ ভাইরাস পার্টিক্যাল ভাইরিয়ন হিসেবে পরিচিত। আশ্রয়দাতা কোষের বাইরে থাকা ভাইরাসকে এই নামে বলা হয়। একটা ভাইরিয়ন পার্টিক্যাল প্রায় ৯০ ন্যানোমিটার চওড়া, যা মানুষের ফুসফুসে সংক্রমিত কোষের প্রায় ১০ লাখ ভাগের এক ভাগ। ভাইরিয়নে ৪টি ভিন্ন ভিন্ন প্রোটিন থাকে আর থাকে এক গুচ্ছ আরএনএ। এটি একটি মলিকুল, যা ডিএনএর মতো জেনেটিক তথ্যাবলীকে রাসায়নিক অক্ষরগুলোর পরম্পরা হিসেবে ধারণ করে রাখতে পারে। এগুলোকে বলে নিউক্লিওটাইড। সার্স-কভ ২ ভাইরিয়নের ক্ষেত্রে সেই তথ্যাবলীর মধ্যে ভাইরাসের নিজের প্রতিরূপ তৈরির জন্য আর যেসব প্রোটিনের প্রয়োজন সেগুলো কিভাবে তৈরি করতে হয় সেই তথ্যও থাকে। তবে সেই তথ্যটি এক কোষ থেকে অন্য কোষে বয়ে নিয়ে যায় না। ভাইরিয়ন যে কোষের মধ্যে সৃষ্টি হয় সেই কোষের ঝিল্লির গায়ে বাইরের দিকের প্রোটিনগুলো আড়াআড়িভাবে বসা থাকে। লিপিডের তৈরি এই ঝিল্লি বা পর্দা পানি ও সাবানের সংস্পর্শে এলে ভেঙ্গে যায়। সে কারণেই সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য হাত ধোয়ার ব্যাপারটা এত মূল্যবান। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রোটিন এবং যে প্রোটিনটির জন্য ভাইরিয়নগুলো ক্রাউন বা মুকুটের মতো কিংবা নৌবাহিনীর পুরনো ধারার মাইনের মতো চেহারা লাভ করেছে, সেই প্রোটিনকে বলা হয় স্পাইক। এটি ঝিল্লি বা পর্দার গায়ে সগর্বে দাঁড়িয়ে থাকে। আরও দুটি প্রোটিন- এনভেলপ প্রোটিন ও মেমব্রেন প্রোটিন ঝিল্লির গায়ে স্পাইক প্রোটিনগুলোর মাঝখানে বসা থাকে এবং ভাইরিয়নকে কাঠামোগত সংহতি যোগায়। ঝিল্লি বা পর্দার ভেতরে চতুর্থ একটি প্রোটিন থাকে, যার নাম নিউক্লিওক্যাপসিড। এটি স্ক্যাফোল্ড বা ভারা হিসেবে কাজ করে, যার চারপাশে ভাইরাসটি মুড়িয়ে রাখে আরএনএর ২৯ হাজার ৯০০ নিউক্লিওটাইডকে, যা দিয়ে এর জেনোম পঠিত। জীবন্ত কোষগুলো ডিএনএর মধ্যে তাদের জিনগুলোকে মজুদ করে রাখলেও অন্য নানা ধরনের ক্রিয়াকলাপের জন্য আরএনএকে ব্যবহার করে থাকে। যেমন, কোষের জোনোমে লিপিবদ্ধ নির্দেশাবলীকে সেই মেশিনারির কাছে নিয়ে যায়, যা ওই নির্দেশাবলীকে প্রোটিনে রূপান্তরিত করে। অবশ্য নানা ধরনের ভাইরাস তাদের জিনকে আরএনএতে মজুদ করে রাখে। এইডস রোগের জন্য দায়ী এইচআইভির মতো ভাইরাসগুলো কোন কোষের মধ্যে গিয়ে ঢুকলে তাদের আরএনএ জেনোমের ডিএনও কপি তৈরি করে। এর ফলে তারা নিউক্লিয়াসের ভেতরে ঢোকার সুযোগ পায় এবং সেখানে বছরের পর বছর ধরে থাকে। করোনাভাইরাসগুলো সহজ পথ অবলম্বন করে। তাদের আরএনএ এমনভাবে ফরম্যাট করা যে, তা আরএনএর মেসেঞ্জারের মতো দেখায় এবং সেই মেসেঞ্জার কোষগুলোকে বলে দেয় কোন কোন প্রোটিন তৈরি করতে হবে। সেই আরএনএ কোষের ভেতর ঢুকে পড়া মাত্র প্রোটিন তৈরির মেশিনারি ভাইরাসের জিনগুলো পাঠ করতে এবং সেগুলোর বর্ণিত প্রোটিন তৈরি করতে শুরু করে দেয়। একটা ভাইরিয়ন ও একটা কোষের মধ্যে প্রথম সংযোগ ঘটায় স্পাইক প্রোটিন। এই প্রোটিনের একটি জায়গা আছে, যা এসিই-২ নামক একটি প্রোটিনের সঙ্গে খাপে খাপ মিলে যায়। এসিই-২ প্রোটিনটি মানবদেহের কোন কোন কোষের গায়ে বিশেষ করে শ্বাসনালীর কোষে দেখতে পাওয়া যায। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এসিই-২ এর একটা ভূমিকা আছে। উহানের একটি হাসপাতালের প্রাথমিক তথ্য পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, এই রোগে আক্রান্ত কারোর উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তার মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে। তেমনি কারোর ডায়াবেটিস ও হার্টের রোগ থাকলেও এ ঝুঁকি বাড়ে। ভাইরাসটি কোষের যে পথ দিয়ে প্রবেশ করে সেটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে যুক্ত বিধায় এই দুইয়ের মধ্যে কোন যোগসূত্র আছে কিনা সেটা দেখার বিষয়। একটা ভাইরিয়ন কোন একটি এসিই-২ মলিকুলের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে ফেলার পর কোষের বহির্ভাগে থাকা দ্বিতীয় একটি প্রোটিনকে তার ইচ্ছার অধীন করে ফেলে। ওই প্রোটিনটির নাম টিএমপিআর এসএস-২। এটি আসলে একটি প্রোটিজ। প্রোটিজ হলো একটা এনজাইম, যা প্রোটিন ও প্রেপাইডকে বিদীর্ণ করে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলে। ভাইরাস স্পাইক প্রোটিনের প্রবেশের পথ তৈরির জন্য এই টিএমপিআর এসএস-২ এর ওপর ভর করে তাকে সেই পথ তৈরিতে বাধ্য করে। এর ফলে ভাইরিয়ন কোষের ভেতর ঢুকতে পারে। সেখানে অচিরেই এটি নিজেকে উন্মুক্ত করে তার আরএনএকে ছেড়ে দেয়। করোনাভাইরাসের জেনোম অন্য যে কোন আরএনএ ভাইরাসের জেনোমের তুলনায় আকারে বড়Ñ এইচআইভির তুলনায় প্রায় ৩ গুণ লম্বা, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের চেয়ে দ্বিগুণ লম্বা এবং ইবোলা ভাইরাসের তুলনায় অর্ধেক বেশি লম্বা। এর এক প্রান্তে থাকে চারট কাঠামোগত প্রোটিনের জিন এবং ছোট সাইজের অপ্রধান প্রোটিনের ৮টি জিন। এগুলো হোস্ট বা আশ্রয়দাতা কোষের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বাধা দান করে। একত্রে এগুলো হচ্ছে জেনোমের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। বাকিটা হলো রেপ্লিকেস নামে কথিত একটি জটিল জিনের ক্ষেত্র বা এলাকা। আরএনএ মলিকুলগুলোর আরএনএ কপি তৈরি করার ব্যাপারে কোষগুলোর কেন আগ্রহ নেই এবং সেই কারণে এই কাজটির জন্য এমন কোন মেশিনারিও তাদের নেই, যা কিনা ভাইরাস হাইজ্যাক করে নিতে পারে। তার অর্থ হচ্ছে ভাইরাসকে সেই সব জিনও আনতে হয় যেগুলোর সঙ্গে সে তার নিজের প্রতিরূপও তৈরি করতে পারে। রেপ্লিকেস জিনের কাজ হচ্ছে দুটি বড় ‘পলিপ্রোটিন’ তৈরি করা যেগুলো নিজেদের কেটেছেঁটে ১৫টি কিংবা সম্ভবত ১৬টি অবকাঠামোমূলক ছোট প্রোটিনে পরিণত করে। জেনোমকে কপি করা ও প্রুফ রিডিং করার মেশিনারির যে ঘাটতি তা এর দ্বারা পূরণ হয়ে যায়। তবে এদের কারও কারও অন্য ভূমিকাও থাকতে পারে। দেহকোষ কাঠামোগত প্রোটিন ও আরএনএ দুটোই তৈরি করা শুরু করে দিলে নতুন ভাইরিয়ন তৈরি শুরু করে দেয়ার সময় এসে যায়। কিছু কিছু আরএনএ মলিব্যুল নিউক্লিরওক্যাপসিড প্রোটিনের প্রতিরূপ দিয়ে মুড়িযে যায়। তখন তাদের কিছু কিছু ঝিল্লি বা পর্দা যোগানো হয়, যেগুলো প্রচুর পরিমাণে থাকে বাইরের তিনটি প্রোটিনে। এনভেলপ ও মেমব্রেন প্রোটিনগুলো এই সংযোজন প্রক্রিয়ায় বিশাল ভূমিকা পালন করে। প্রক্রিয়াটি গোলগি এ্যাপারেটাস নামে কথিত সেলুলার কারখানায় সংঘটিত হয়। একটি কোষ এভাবেই এক শ’ থেকে এক হাজার ভাইরিয়ন তৈরি করতে পারে। এগুলোর বেশিরভাগই কাছাকাছি থাকা অথবা অপর কোন অঙ্গে থাকা নতুন কোষকে দখল করে নিতে সক্ষম। এভাবে সৃষ্ট আরএনএর সবই যে শেষ পর্যন্ত গাদাগাদি করে ভাইরিয়নের মধ্যে ঢুকে যায় তা নয়। যেগুলো পড়ে থাকে সেগুলো বৃহত্তর প্রবাহের মধ্যে চলে যায়। করোনাভাইরাসের যে পরীক্ষাগুলো এখন চালু আছে, সেগুলোতে সংক্রমিত রোগীর থুতুতে পাওয়া সার্স-কভ-২ এর সুনির্দিষ্ট আরএনএ সিকোয়েন্সগুলো তুলে নিয়ে বড় করে দেখা হয়। ভাইরাসের জেনোমের ফ্রি রাইডারের কোন সুযোগ না থাকায় সার্স-কভ-২ একটা কোষের ভেতরে ঢুকলেই যেসব প্রোটিন তৈরি করে তার সবই অতীব গুরুত্ব বহন করে। প্রতিটি প্রোটিনই ওষুধ প্রস্তুতকারকদের সম্ভাবনাময় টার্গেট হতে পারে। বৈশ্বিক মহামারীর কবলে পড়লে চিকিৎসার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়া হয় সেই টার্গেটগুলোকে, যেগুলো আগে থেকেই হাতে আছে এমন ওষুধে কাজ দিতে পারে। এক্ষেত্রে সুস্পষ্ট টার্গেট হচ্ছে রিপ্লিকেস ব্যবস্থা। যেহেতু অসংক্রমিত কোষগুলো আরএনএ মলিকুলের আরএনএ কপি তৈরি করে না, তাই যেসব ওষুধ ওই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে যায় সেগুলো শরীরের স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপের কোনরূপ ব্যাঘাত না ঘটিয়ে ভাইরাসের জন্য প্রাণঘাতী হতে পারে। বলা বাহুল্য এ ধরনের চিন্তাভাবনা থেকেই প্রথম জেনারেশনের এইচআইভির ওষুধ উদ্ভাবিত হয়েছিল। ওই ওষুধের টার্গেট ছিল সেই প্রক্রিয়া যেটিকে ভাইরাস তার আরএনএ জেনোমকে ডিএনএতে রূপান্তরের কাজে ব্যবহার করে থাকে। এক্ষেত্রেও বলা বাহুল্য সূক্ষ্ম কোষগুলো এ কাজটি করে না। এইচআইভির ওই প্রথমদিকের ওষুধগুলোর মতো সার্স-কভ ২ এর সবচেয়ে সম্ভাবনাময় চিকিৎসা হচ্ছে নিউক্লিওটাইড এনালগ নামে পরিচিত মলিকুলগুলো। এগুলো দেখতে সে সব বর্ণের মতো, যা দিয়ে আরএনএ বা ডিএনএ সিকোয়েন্স তৈরি হয়। কিন্তু যখন কোন ভাইরাস আরএনএ সিকোয়েন্স তৈরির জন্য ওগুলোকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে, তখন সেগুলো নানাভাবে সেই উদ্দেশ্য সাধনকে ব্যাহত করে। সার্স-কভ ২ চিকিৎসার জন্য যে নিউক্লিওটাইড এনালগ ওষুধটি সবচেয়ে কার্যকর হিসেবে দৃষ্টি কড়েছে সেটির নাম রেমডেসিভির। গোয়াভে এটি ইবোলা ভাইরাসের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য আমেরিকার একটি বায়োটেকনোলজি ফার্ম ‘গিলিড সায়েন্স’ এটি তৈরি করে। মানদেহের জন্য ওটা নিরাপদ হিসেবেও দেখা হয়। কিন্তু যেহেতু এন্টিবডি ওষুধ ইবোলা চিকিৎসার উন্নততর উপায় বলে প্রমাণিত হয়, তাই রেমভেসিভির ওষুধটিকে এক পাশে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। যদিও ল্যাব পরীক্ষায় দেখা গেছে এটি সার্স-কভসহ আরএনএ নির্ভর অন্য বেশ কিছু ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে। একই পরীক্ষায় এখন দেখা গেছে যে, এটি সার্স কভ ২ ভাইরাসের প্রতিরূপ সৃষ্টিকে বাধা দিতে পারে। এখন কোভিড-১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে রেমভেসিভিরের কার্যকারিতা নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। গিলিড এশিয়ায় এক হাজার সংক্রমিত রোগীর ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। এর ফলাফল মধ্য এপ্রিল থেকে এপ্রিলের শেষভাগের দিকে পাওয়া যাবে। নিউক্লিওটাইড এনালগের অন্যান্য ওষুধ নিয়েও পরীক্ষা চলছে। অন্যান্য চিকিৎসার জন্য অনুমোদিত ৭টি ওষুধ সার্স-ক ভ ২ এর ক্ষেত্রে কার্যকর বলে প্রমাণ পাওয়ার পর উহানের একদল গবেষক রিবাভাইরিন নামে একটি এন্টিভাইরাস ড্রাগের মধ্যে কিছু সম্ভাবনা খুঁজে পেয়েছেন। ওষুধটি হেপাটাইটিস-সিসহ অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। নিউক্লিওটাইড এনালগই ভাইরাস দমনের একমাত্র ওষুধ নয়। দ্বিতীয় প্রজন্মের এইচআইভি ওষুধ হলো ‘প্রোটিজ ইনহিবিটর’। এই শ্রেণীর দুটো ওষুধ রিটোনাভির ও লোপিনাভির ২০০৩ সালে কিছু কিছু সার্স রোগীর ওপর প্রয়োগ করে খানিকটা সুফল পাওয়া গিয়েছিল। আরএনএ নির্ভর অন্যান্য ভাইরাস দমনে উদ্ভাবিত অন্যান্য ওষুধ বিশেষ করে ইনফ্লুয়েঞ্জার একটি ওষুধ হলো ফাভিনিরাভির (ক্ষাভিলাভির)। এটা নতুন আরএনএ তৈরির কাজে যুক্ত একটি নন স্ট্র্রাকচারাল প্রোটিন তৈরির কাজে বাধা দেয়। তবে সার্স-কভ ২ এর ক্ষেত্রে প্রভাব রাখতে পারে এমন অনেক প্রচলিত ওষুধ ভাইরাস দমনের ওষুধ হিসেবে উদ্ভাবিত হয়নি। যেমন, ম্যালেরিয়ার ওষুধ ক্লোরোকুইন ২০০০-এর দশকে সার্স-কভ ২ এর ক্ষেত্রে কিছুটা কার্যকর হিসেবে দেখা গেছে। সেল-কালচার পরীক্ষায় দেখা যায় যে, ক্লোরোকুইন কোষের ভেতরে ভাইরাসের প্রবেশ করার ক্ষমতা এবং কোষের ভেতর প্রবেশ করলে সেখানে নিজের প্রতিরূপ সৃষ্টি করার ক্ষমতা দুটোই কমিয়ে দেয়। ক্যান্সারের ওষুধ ক্যামোস্টাট মেসাইলেট কোষের ঝিল্লির মধ্যকার টিএমপিআর এসএস-২ নামক যে প্রোটিনটি স্পাইক প্রোটিনকে সক্রিয় করে তোলে তার অনুরূপ প্রোটিজেসের কাজে বাধা দেয়। সব ওষুধকেই যে ভাইরাসকে টার্গেট করতে হবে এমন কোন কথা নেই। কিছু ওষুধ ইমিউন সিস্টেমকে সাহায্য করেও কাজ করতে পারে। ইন্টারফেরন সংক্রমিত কোষের ব্যাপক পরিসরে এন্টিভাইরাল রিএ্যাকশন ঘটায়। তার মধ্যে আছে প্রোটিন উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া এবং আরএনএ বিধ্বংসী এনজাইমগুলো চালু করে দেয়া। এই উভয় কাজের মধ্য দিয়ে ভাইরাসের প্রতিরূপ সৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে ইন্টারফেরন সার্স ভাইরাসের অগ্রগতি রোধে কার্যকর হাতিয়ার হতে পারে। সম্ভবত অন্যান্য ওষুধের সঙ্গে মিলিয়ে দিলে সবচেয়ে ভাল ফল পাওয়া যেতে পারে। চীন কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় ব্যবহারের জন্য একটেমরা (টোসিলিজুমার) অনুমোদন করেছে। ওষুধটি রিউমাটয়েড আর্থ্ররাইটিসের চিকিৎসার জন্য উদ্ভাবিত হয়েছিল। অসমর্থিত সূত্রে খবর পাওয়া গেছে যে, ইতালিতে এই ওষুধটি ব্যবহার করে করোনা চিকিৎসায় ভাল ফল পাওয়া গেছে। বৈশ্বিক মহামারী ব্যাপকতা কতটা দাঁড়াবে তার ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। একটা কার্যকর ওষুধও সর্বক্ষেত্রে উপযোগী নাও হতে পারে। ইতোমধ্যে এমন উদ্বেগও দেখা দিয়েছে যে, কোন একটি সম্ভাব্য ওষুধ কার্যকর প্রমাণিত হলে এর সরবরাহ হয়ত পর্যাপ্ত হবে। তবে আশার কথা, কভিড-১৯ এর ওষুধ বের করার জন্য দুনিয়াজুড়ে যেভাবে সবাই কোমড় বেঁধে উঠে পড়ে লেগেছে, তাতে এই অভিশপ্ত ব্যাধির হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে খুব হয়ত বেশি দিন সময় লাগবে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেটা আর কতদিন? সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×