ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার দিনরাত -মারুফ রায়হান

প্রকাশিত: ০৯:১৭, ২৯ অক্টোবর ২০১৯

ঢাকার দিনরাত -মারুফ রায়হান

কী দিনকাল পড়ল! পঞ্জিকার দিকে তাকিয়ে দেখি হেমন্তকাল, পাখা চালালেই শীতকাল; কাঁথা গায়ে দিলে গ্রীষ্মকাল আর রাস্তায় বেরুলেই দেখছি বর্ষাকাল! কথাগুলো রসিয়ে রসিয়ে লিখলেন একজন ঢাকাবাসী। খুব একটা মিথ্যে বলেননি। ঘরে-বাইরে ঢাকাবাসীর এমনই অভিজ্ঞতা হয়েছিল গত সপ্তাহে বেশ কয়েকটা দিন। দুদিনের জন্য খুলনায় গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম, সেখানে ঠা ঠা রোদ্দুর ছিল, যথেষ্ট গরম। তবে দুটো বিশেষ অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছি এবং ঢাকার জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার প্রয়াস পাচ্ছি। গ্রামে বিদ্যুত বিভ্রাট বা লোডশেডিং দুটোই আছে, তবে খুব দীর্ঘ সময়ের জন্য নয়। আমরা ঢাকাবাসী বিদ্যুতের অনুপস্থিতি খুব একটা টের পাই না ঘরে-ঘরে আইপিএস থাকায়। ফলে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলেও নিরবচ্ছিন্নভাবেই বাতি জ্বলে পাখা চলে। গ্রামেও দেখছি একই অবস্থা! না, সেখানে ঘরে-ঘরে আইপিএস নামক বিদ্যুত ধরে রাখা যায় ওই মুশকিল আসান যন্ত্রটি নেই। তার বদলে রয়েছে সৌরবিদ্যুত। ঘরে ঘরে না হলেও বহু বাড়িতেই এই ব্যবস্থা দেখলাম। যে দেশে ১১ মাসই রোদ পাওয়া যায় বিপুল পরিমাণে সে দেশে সৌর বিদ্যুত আশীর্বাদ নয় তো কী! তবে এই ব্যবস্থার ব্যাপক প্রচলন চাই। ঢাকার ফ্ল্যাট বাড়ির মালিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে। গ্রামে দ্বিতীয় যে বিষয়টি ভাল লাগল সেটি হলো কিছুটা খালি জায়গা পেলে লোকে শাকসবজির পাশাপাশি ফুলের গাছও লাগাচ্ছেন। ঢাকায় অবশ্য বহু বাড়ির ছাদে এমন গাছ লাগানো হচ্ছে। তবে ডেঙ্গুর বিষয়টি মাথায় রাখেন না অনেকেই। ফলে ছাদের টব এডিস মশাদের প্রজননক্ষেত্রে হয়ে উঠছে। দৃষ্টি আকর্ষণ : শিল্পকলা একাডেমির ডিজি শুক্রবার বেলা তিনটায় অনুবাদ উৎসবে যোগ দেয়ার জন্য সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমিতে যাই। দেখি উত্তর দিকে নাট্যমঞ্চের পাশটায় গেট বন্ধ। এমনকি মানুষের চলাচলের জন্যও ফটকের ছোট অংশটি খোলা নেই। কিছুটা হেঁটে পূর্ব দিকের গেটে গিয়ে দেখি একই অবস্থা। শিল্পকলার ভবনগুলো তৈরি হওয়ার আগে প্রবেশের একমাত্র পথটি ছিল উত্তর পাশে, সেটি স্থায়ীভাবেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। শুক্রবারে খোলা দেখলাম একমাত্র দক্ষিণপাশের ফটকটি। কেন? গাড়ি চলাচলের জন্য বিশেষ প্রয়োজনে একটি গেট খোলা রেখে বাকি দুটি বন্ধ রাখা যেতে পারে। কিন্তু মানুষের প্রবেশের জন্য কেন গেটের ছোট্ট অংশটি উন্মুক্ত থাকবে না। বয়স্ক ও শিশুদের ভোগান্তির কথাটি স্মরণে রাখুন। শুক্রবারেই এখানে অতিরিক্ত ভিড় থাকে। এখানে চলছে প্রধানমন্ত্রীর সংগ্রামী জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের আলোকচিত্র এবং তাঁকে নিয়ে সৃজিত শিল্পকর্মের প্রদর্শনী। প্রায় প্রতিটি মিলনায়তন ও সেমিনার কক্ষে কোন না কোন অনুষ্ঠান থাকে প্রায় দিনই, বিশেষ করে ছুটির দুই দিন, শুক্র ও শনিবার। তাই সব গেট সকাল থেকে রাত পর্যন্ত উন্মুক্ত থাকা বাঞ্ছনীয়। যদি গাড়ি চেকের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকে তাহলে গাড়ি না হোক, মানুষকে অবাধে প্রবেশ করতে দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। দৃষ্টি আকর্ষণ : মেয়র (উত্তর) উত্তরা থেকে শাহবাগ হয়ে গুলিস্তান যাওয়ার একমাত্র এসি বাস বিআরটিসির রুট হঠাৎ করেই বদলে ফেলা হয়েছে! কেন? উত্তরা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজধানীতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কেন্দ্রীয় অঞ্চল শাহবাগ-রমনা (শিল্পকলা একাডেমি) আসতে হলে মানুষের জন্য একটিও এসি বাস থাকবে না? আমরা কি সামনে যাচ্ছি, নাকি পেছনে! এক দশক আগেও তিনটে কোম্পানির শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাস চলতো উত্তরা-ফার্মগেট-শাহবাগ এবং উত্তরা-ফার্মগেট-ধানমন্ডি রুটে। নাগরিক সুবিধা সীমিত করার এই পেছনযাত্রা কেন? বহুতল ভবনে অগ্নিঝুঁকি রাজধানীর বহুতল ভবনে অগ্নিঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে; শনিবার ধানমন্ডির একটি আবাসিক ভবনে আগুন লাগার ঘটনায় ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে এক বয়স্ক নারী মারা গেছেন। বিষয়টি দুঃখজনক। ১২ তলা ভবনটির তৃতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটে আগুনের সূত্রপাত। ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট সেখানে কাজ শুরু করে। ফায়ার সার্ভিসের সক্রিয়তায় দেড় ঘণ্টার মধ্যে আগুন পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয়। ওই ভবনের ওপরের ফ্ল্যাটের এক গৃহিণীর প্রতিক্রিয়া জানার সুযোগ হয়। তিনি বলেন, আমার ফুল গাছগুলো সব মওে গেছে। মাত্র দুই ঘন্টার ব্যবধানে ওরা নিস্তেজ হয়ে যায়। পরদিন সকালে চোখ খুলে প্রথমেই আকাশ দেখলাম। কি বিশাল। অথচ শনিবার সকালে খোলা ছাদে এই বিশাল আকাশটার নিচে দাঁড়িয়েও আমরা ক’জন শ্বাস নিতে পারছিলাম না। প্রথমে সিঁড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করলাম। কিছুদূর নামার পরই দশতলার ভাবী , ভাই ওনারা বলেলন, নামবেন না, নিচে অনেক ধোঁয়া , যাওয়া যাচ্ছে না। ছাদে চলেন। ইমার্জেন্সী এক্সিট পুরোটা ধোঁয়ায় ভরে গেছে। আমরা ছাদে গেলাম। মাত্র কয়েক মিনিট লাগলো বিশাল ছাদটা ধোঁয়া দিয়ে ভওে যেতে। আমার তখন একটাই চিন্তা বাচ্চাদের বাঁচাতে হবে। সাথে কোনো পানি ছিল না। দুটো ছেলেকে দেখলাম পাশে দাঁড়ানো। ওদের বললাম পানির ট্যাংকের ঢাকনাটা খুলে দাও , ওড়না ভিজিয়ে বাচ্চাদের নাক-মুখ ঢেকে দিই। বান্ধবী পাগলের মতো বারবার ফোন দিচ্ছে , ওকে বললাম কাঁদিস না , ফায়ার বিগ্রেডের গাড়ী যেন জলদি আসে সেটা নিশ্চিত কর। সম্ভবত চারটা ফ্যামিলির মানুষ আমরা ছাদে ছিলাম। ছাদের একপাশের বহির্গমন পথ পুরোটা কালো ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছিল। অন্যপাশে যে ইমার্জেন্সি এক্সিট সেটা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। কোনো এক ফ্লাটের একটা ছেলে ভেতর থেকে ছিটকিনি খুলে ছাদে এসে সবাইকে ডাকাডাকি শুরু করলো। সিঁড়িতে তুলনামূলকভাবে ধোঁয়া কম ছিল। আমরা সবাই নিচে নামলাম। আমরা বাঁচলাম। চিত্রশিল্পীর বিদায় শিল্পী কালিদাস কর্মকার বেশ আমুদে মানুষ ছিলেন। বিচিত্র আইডিয়া ঘুরতো তার মাথায়। সেই নব্বইয়ের দশকে হঠাৎ তিনি আমন্ত্রণ জানালেন ঢাকার বাইরে পদ্মার একটি চড়ে দলবল নিয়ে যাবেন, সেখানে আর্ট শো হবে। তরুণ বয়স, তাই নড়েচড়ে বসলাম। দলের একটি মাইক্রোতে উঠে দেখি সেখানে শিল্পী ছাড়াও আছেন অনেক বিশিষ্ট মানুষ, তার ভেতরে খ্যাতিমান আলোকচিত্রী আনোয়ার হোসেন আর সুপ্রভাত সিনেমার নায়কও আছেন। বেশ ক’জন তরুণ চিত্রকরও আমাদের সফরসঙ্গী। চরে যেতে যেতে বিকেল, আমরা নৌকো করে বেড়ালাম কিছুক্ষণ। সন্ধ্যে না হলে আর্ট শো শুরু করা নাকি যাবে না। পরে বুঝলাম কেন? অনেক প্রদীপ জ্বালানো হলো, চরের ভেতর ছোট্ট জলাভূমি বেছে নিলেন কালিদাস কর্মকার। গায়ের জামা খুলে কী কী সব বস্ত্রখ- আর মালা জড়ালেন। গলায় মালা তার আগে থেকেই ছিল। শুরু হয়ে গেল অঙ্কন এবং তার তৎপরতা, তাতে কিছু নৃত্যভঙ্গিমাও ছিল। সব মিলিয়ে খুবই অভিনব। চমকিত হওয়ার মতো। ওই ঘটনার পরে শিল্পীর প্রতি হৃদ্যতা অনুভব করতাম আরও বেশি। মিশুক ও নিরহঙ্কার, শিল্পিত মানুষ। আশপাশের সব মানুষই তাকে ভালবাসতো, আপন ভাবতো। বয়স ৭৪ হলেও তাকে কে না বলবে তরুণ। তাই তাঁর হঠাৎ চলে যাওয়া আমাদের অনেককেই বেদনাপ্লুত করেছে। নিরন্তর নিরীক্ষা তাকে করে তুলেছিল খ্যাতিমান। দেশের স্থাপনা ও পারফরমেন্স শিল্পের সূচনাকারী অন্যতম শিল্পীও তিনি। শুক্রবার কালিদাস কর্মকার ইস্কাটনের বাসায় গোসল করতে গেলে সেখানে পড়ে যান। বেশ কিছুক্ষণ কোন সাড়া না পেয়ে সেখানে থাকা এক বন্ধু নিচে খবর দেন। পরে বাথরুমের দরজা খুলে তাঁকে বের করা হয়। সেখান থেকে নেওয়া হয় ল্যাবএইড হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসকেরা জানান, ঘণ্টাখানেক আগেই মারা গেছেন কালিদাস কর্মকার। তিনি ১৯৬২-৬৪ এই তিন বছর তৎকালীন ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে দুই বছরের সূচনা কোর্স শেষ করে ১৯৬৯ সালে কলকাতায় সরকারী আর্ট কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে চারুকলায় স্নাতক করেন। দেশে-বিদেশে আয়োজিত শিল্পী কালিদাসের একক চিত্র প্রদর্শনীর সংখ্যা এ দেশের চার শিল্পীদের মধ্যে সর্বাধিক, দেশে বিদেশে এ শিল্পীর ৭১টি চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৭৬ সাল থেকে ফ্রিল্যান্স শিল্পী হিসেবে দেশে-বিদেশে কাজ করে আসছিলেন তিনি। এ ছাড়া তিনি বহু আন্তর্জাতিক দলবদ্ধ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ ও আন্তর্জাতিক সম্মান লাভ করেছেন। বাংলাদেশে ছাপচিত্র-শিল্পের প্রচার ও প্রসার আন্দোলনে গ্রাফিকস আঁতেলিয়ার-৭১-এর মাধ্যমে তাঁর ভূমিকা স্মরণীয়। ভারত, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, জাপান, কোরিয়া, আমেরিকাতে আধুনিক শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমে উচ্চতর ফেলোশিপ নিয়ে সমকালীন চারুকলার নানা মাধ্যমে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আসছেন। জীবদ্দশায় একুশে পদক, শিল্পকলা পদকসহ অসংখ্য স্বীকৃতি পেয়েছেন বরেণ্য এই চিত্রশিল্পী। শহীদ মিনারে শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে তার সহপাঠী ভাস্কর হামিদুজ্জামান অশ্রুশিক্ত কণ্ঠে বলেন, ‘কালিদাস সত্যিকার অর্থেই একজন আন্তর্জাতিকমানের শিল্পী ছিলেন। তার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি আছে। এই মুহূর্তে আমি বলতে পারছি না। নতুন প্রজন্মকে সে উৎসাহিত করে তুলেছে। এই দেশের আধুনিকতার আন্দোলন শুরু করে গেছে সে, এটা আমি স্বীকার করি।’ শিল্পী মনিরুল ইসলাম স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘কালিদাস খুব ফ্রি লাইফ নিয়ে চলতেন। যখন ইচ্ছা আমেরিকা বা স্পেনে চলে গেছেন। কিন্তু তিনি যেখানেই থাকুন না কেন সবসময় বাংলাদেশের খোঁজ রাখতেন।’ আলোকচিত্রীর জগৎ ইফতেখার ওয়াহিদ ইফতির ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড’ শীর্ষক পক্ষকালব্যাপী একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী চলছে উত্তরার উইন্ড ব্লোজ ক্যাফেতে (বাড়ি- ২৬, রোড- ১৮, সেক্টর-৩, উত্তরা)। ইফতি প্রায় দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করে আসছেন। দেশের প্রায় ৬০০ বিশিষ্ট ব্যক্তির ছবি তোলার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ইফতেখার ওয়াহিদ ইফতি জানান, তার তোলা ১১টি পোর্ট্রেট এবং ১৪টি ক্রিয়েটিভ ছবি নিয়ে সাজানো হয়েছে আয়োজন। তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু মূলত পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফি হলেও ক্রিয়েটিভ এবং ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফিতেও তিনি কাজ করেছেন প্রচুর। গত দু’দশকের কাজের ফাকে তিনি প্রায় ৬টি একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী করেছেন। এর মধ্যে, ‘পোর্ট্রেট’- বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র- ২০০১, ‘লুক থ্রু ক্রোজ আইজ’ – ভারতীয় দূতাবাস, ২০০২, ‘সান অব দ্য সয়েল’, জয়নুল গ্যালারি, ২০০৭, ‘শাহাবুদ্দিন-দ্য পেইন্টার, দ্য ফাইটার’, জয়নুল গ্যালারি, ২০১৩, ‘আ ফিলোসফার’স পোর্ট্রেট’- জয়নুল গ্যালারি, ২০১৭ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। মূলত ফ্রিল্যান্সার হিসেবে বেশিরভাগ সময়ে কাজ করলেও দেশের প্রথিতযশা মিডিয়া হাউসে কাজ করারও অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। ২৭ অক্টোবর ২০১৯ [email protected]
×