ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

রোজা মুসলমানের জন্যে শুদ্ধাচার চর্চা

প্রকাশিত: ০৯:১৪, ২৫ মে ২০১৯

রোজা মুসলমানের জন্যে শুদ্ধাচার চর্চা

মুসলমানদের জন্যে অবশ্য পালনীয় কর্তব্য ৫টি। অর্থাৎ মৌলিক ফরজ- ঈমান, নামাজ, রোজা, হজ ও যাকাত। এর মধ্যেও একটু পার্থক্য হলো প্রথম তিনটি ধনী-দরিদ্র-আমির-ফকির সবার জন্যে একইভাবে ফরজ। ৪র্থ এবং ৫ম এই দুইটি কেবল আর্থিকভাবে সক্ষম মুসলমানদের জন্যে। এ দুটি আর্থিকভাবে সক্ষম নন বা গরিব মানুষের জন্যে ফরজ নয়। রোজা মৌলিক পাঁচ ফরজের মধ্যে তৃতীয়। সাত দশকের জীবনে কত মাহে রমজানে রোজা রেখেছি মনে নেই। অর্ধশতাধিকবার হতে পারে। সববার যে পুরো মাহে রমজানে রোজা রেখেছি এমনটি দাবি করা যাবে না। দাবি করি না। এবারের মতো গরম আমাদের দেশে আগে পড়েছে কি-না জানা নেই। তবে গরম পড়ুক বা ঝড়-বাদলে আক্রান্ত হোক রোজা রাখতেই হবে। আমরা রোজা রাখব, তারাবিহ পড়ব, সেহরি খাব ও ইফতার করব। সাধ্যমতো গরিবদের ইফতার খাওয়াব, সাহায্য করব। কোন কিছু বাদ দেব না। গ্রাম, শহর, সর্বত্র (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রামগুলো শহর বানিয়ে দিয়েছেন) ইফতার পার্টি দেব। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে শুদ্ধ সমাজ গড়ার পথে অবদান রাখার চেষ্টা করব। বস্তুত রোজা হচ্ছে মুসলমানদের জন্যে শুদ্ধাচার চর্চা। রাজনীতি করলে এই ইফতার কালচার চর্চা না করে উপায় থাকে না। ইফতার পার্টি আমাদের রাজনীতির অঙ্গনে একটা নিয়মে দাঁড়িয়েছে। একেক গ্রুপ একেক লক্ষ্য নিয়ে ইফতার দেয়। একটি রাজনৈতিক দল তার কর্মী, সমর্থক, পেশাজীবী, সংস্কৃতিসেবী এবং সর্বোপরি ভোটারদের সম্মানে ইফতার পার্টির আয়োজন করে। বিদেশী কূটনীতিকদের সম্মানেও আয়োজন করতে হয়। যেমন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আয়োজন করে থাকেন। তবে কিছু আছে ইফতার পার্টি দিয়ে টু-পাইস কামানোর পথ দেখে। পদ্ধতিটি হলো চাঁদাবাজি। দাওয়াতপত্রে কোন রকমে একজন মন্ত্রী, এমপি, নেতা, সমাজপতির নাম প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি হিসেবে প্রকাশ করা গেলে চাঁদার অঙ্কটা ফ্যাটি হয়। এভাবে কেউ কেউ ইফতার পার্টির রাজনীতিটাও করলেন আবার কিছু পকেটেও জমা হলো। আমি বলছি না সবার উদ্দেশ্য এমনি। কারও কারও। ওই যে কথা আছে না ‘রথ দেখা কলা বেচা।’ পুরো রমজান মাসটা যেন মুসলমানদের জন্যে একটা আনন্দের পরব। ফ্যাশন হাউসগুলো বছরব্যাপী নতুন নতুন ডিজাইনের পোশাক-আশাক নিয়ে বাজারে নামছে। এবারও তা-ই। শপিংমলগুলো যেন নারীদের মেলায় পরিণত হয়। সারা মাসই কেনাকাটা চলে। বিত্তশালীরা সিঙ্গাপুর-ব্যাঙ্কক যান শপিং করতে। মধ্যবিত্ত, পলিটিশিয়ানগণ যান ভারতে। মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল হওয়ায় রুচিরও বদল হচ্ছে দ্রুততর গতিতে। রমজানের শেষে ঈদগাহ্্ গিয়ে জামায়াতে ঈদের নামাজ আদায় করব, কোলাকুলি করব, এ বাড়ি-ওবাড়ি ঘুরে ঘুরে জর্দা-সেমাই খাব (যদিও এখন সেমাই বানাবার প্রক্রিয়া অরুচিকর), খাওয়ার, বিলাব, কুশলবিনিময় করব। কি শহর কি গ্রাম অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচিরও পরিবর্তন এসেছে ব্যাপকভাবে। আমাদের ছেলেবেলার গ্রামীণ জীবনের মাহে রমজান এবং ঈদের তুলনায় আজকের নগর সভ্যতার রমজান-ঈদের রূপ-রং-ই আলাদা। কৈশোরে দেখেছি গ্রামের সাধারণ মানুষ ইফতার টাইমে এক গ্লাস পানি খেয়ে রোজা ভাংতেন। তারপর সরাসরি ভাত। ভাত জুটাতেও তখন অনেককেই হিমশিম খেতে হতো। অবস্থাপন্ন পরিবারে কিছুটা ইমপ্রুভড ইফতার হতো। ষাটের দশকে গ্রামের বাজারগুলোতে ছোলা, পেঁয়াজুুু, বেগুনি যোগ হয়। এগুলো একটা গামলায় মিশিয়ে দল বেঁধে ইফতার করার রেওয়াজ চালু হয়। একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো ওইসব ঝাল দ্রব্যের সঙ্গে জিলাপি মিশিয়ে খেতে গ্রামের মানুষ পছন্দ করেÑ যা শহরে দেখা যায় না। শহরে বরং ছোলা-মুড়ি-পেঁয়াজু-বেগুনিতে নাগরিকদের মন ভরে না, ইফতারের সঙ্গে যোগ হয় হালিম এবং সঙ্গে মোরগ-পোলাও বা কাচ্চি বিরিয়ানি প্রভৃতি পশ্চিমা খাবার। এই হালিমের একটা মুখরোচক নামও আছে ‘মামা হালিম’ এবং মোরগ-খাসির রোস্টের নাম ‘বড় বাপের পোলায় খায়’। অবশ্য আদি ঢাকাবাসীর হিউমারের তুলনা নেই। শরবত-খেজুর থাকবেই। সৌদি আরবে পবিত্র কাবা শরীফে কিংবা মদিনা মুনাওয়ারায় নামাজের সারির মাঝে একদল লোক প্লাস্টিকের লম্বা লাইন বানিয়ে তার ওপর ইফতার সামগ্রী দিয়ে যায়। সবাই একসঙ্গে বসে ইফতার করে। গ্রামের কিছু মসজিদেও এমনি সামাজিক ইফতারের আয়োজন করা হয়। তবে আরব দেশগুলোর ইফতার পার্টিতে খেজুর অবশ্যই থাকবে, সেই সঙ্গে টক দই, রুটিও পরিবেশন করা হয়। চাও পরিবেশন করা হয়। ধনী-গরিব-আমির-ফকির পাশাপাশি বসে ইফতার করে, রোজা ভাঙ্গে। রোজা বা পবিত্র রমজানের তিনভাগ- প্রথম ১০ দিন ‘রহমত’, দ্বিতীয় ১০ দিন ‘মাগফিরাত’ এবং তৃতীয় বা শেষ ১০ দিন (৯ দিনও হয় কখনও কখনও) ‘নাজাত’-এর। এই শব্দ তিনটির মাঝেই রয়েছে রোজার ফজিলত। আরবী ‘রহমত’ শব্দের অর্থ ‘আশীবাদ’, ‘মাগফিরাত’ অর্থ ‘ক্ষমা’ এবং ‘নাজাত’ অর্থ মুক্তি। লক্ষ্য করার বিষয় একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান পবিত্র রমজানের এই সুযোগগুলো গ্রহণ করে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য যেমন অর্জন করতে পারে তেমনি ইহ-জাগতিক শুদ্ধাচারের পথে হাঁটতে পারে। এই রমজান মাসেই পবিত্র কালাম-এ পাক নাজিল হয়েছিল। অর্থাৎ এই মাসেই শব-ই-কদর অর্থাৎ কদরের রাতে পূর্ণাঙ্গ আল-কোরান নাজিল হয়েছিল। ‘ইকরা’ মানে পড়। যেমন ‘ইকরা বিএসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাফ’-অর্থাৎ পড় তোমার প্রভুর নামে। পূর্ণাঙ্গ কোরান নাজিল হওয়ায় এই শব-ই-কদর বা কদরের রজনীকে সহস্র রজনী থেকে উত্তম বলা হয়েছে : (লাইলাতুল কদরি খায়রুম মিন আলফি শাহর)। পবিত্র রমজানের ফজিলতের কথা বলে শেষ করা যায় না। উলামা কেরাম ভাল বলতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে আমি দু’একটি হাদিসের উদ্ধৃতি দিতে চাই : পবিত্র রমজানের ফজিলত ও মর্যাদা সম্পর্কে মহানবী (সঃ)-এর হাদিস হচ্ছে: হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন আল্লাহর রাসুল (সঃ) এরশাদ করেছেন রমজান মাস এলে আসমানের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয় এবং দোজখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। একই সঙ্গে শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয় (বুখারী, মুসলিম)। সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত : নবী করিম (সঃ) এরশাদ করেছেন- অনেক রোজাদার ব্যক্তি এমন রয়েছে যাদের রোজায় অনাহারে থাকা ছাড়া কোন প্রাপ্তি হয় না। আবার অনেকে এমন আছেন যারা রাত জাগেন অথচ তাদের রাত জাগার কষ্ট ছাড়া কিছুই লাভ হয় না (ইসলাম বা পবিত্র মন বা একাগ্রতার সঙ্গে আমল না হলে বা কেবল দেখানোর উদ্দেশ্যে হলে বিনিময়ে কোন সওয়াব পাওয়া যায় না) (ইবনে মাজাহ্্, নাসাঈ)। এর অর্থ হচ্ছে রোজাদারকে পবিত্র হতে হবে এবং তার নিয়ত সাফ হতে হবে। এভাবে রোজা রাখলে মানুষ পবিত্রতা অর্জন করতে পারে। রোজাদার ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হবেন না। কেউ তার সঙ্গে ঝগড়া করতে এলে বলতে হবে ‘আমি রোজাদার’। রোজা আল্লাহর ফরজ আদায়ের পাশাপাশি ঝগড়া-ফাসাদবিহীন সুন্দর সমাজ গড়তেও সাহায্য করে। কিন্তু এই রোজা নিয়েও মুসলমানদের মধ্যে কোথাও মতভেদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। অর্থাৎ কখন থেকে রোজা রাখা হবে কখন রাখা হবে না। যেমন চাঁদপুর ও শরীয়তপুরসহ কয়েকটি এলাকায় মানুষ বাংলাদেশের চাঁদ দেখা কমিটির দেয়া দিনের একদিন আগে রোজা শুরু করে এবং একদিন আগে রোজা ভেঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করে। তাদের বক্তব্য হলো সৌদি আরবের সঙ্গে তারা রোজা রাখে। বেশিরভাগ মানুষই জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটিকে ফলো করে। এখানে বড় ধরনের বিভেদ না হলেও ভেতরে ভেতরে একটা দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে। এ ব্যাপারে চাঁদপুরের চান্দ্রা দরবার শরীফের ড. মওলানা এম এম হুজ্জাতুল্লাহ নকশবন্দীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইসলামের ৪ মাযহাবের অন্যতম হানাফী মাযহাবের ইমাম হযরত ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) প্রথমে বলেছিলেন ‘পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে চাঁদ দেখা গেলে রোজা রাখা যাবে।’ কিন্তু এটি তার প্রথম মত, চূড়ান্ত মত ছিল না এবং এর ওপর হানাফী মাযহাবের ফতোয়াও হয়নি। হানাফী মাযহাবের ফতোয়া হয়েছে ‘যে দেশে যখন অবস্থান করবে সে দেশে যখন চাঁদ দেখা যাবে তখন থেকে রোজা শুরু হবে।’ সৌদি আরবে থাকলে সৌদি আরবে যেদিন চাঁদ দেখা যাবে সেদিন থেকে রোজা রাখতে হবে। একটি উদাহরণ হলো হজরত মুয়াবিয়া (রাঃ) একবার উম্মে ফজল বিনতে হারেসা নামে একজন নারীকে শ্যাম দেশে (বর্তমান সিরিয়া) পাঠান। সেখানে রমজানের শুরুর আগে শুক্রবারে চাঁদ দেখা গেলে তিনি সেদিন থেকে রোজা রাখতে শুরু করেন। রোজার শেষে তিনি মদীনা শরীফে ফিরে এসে দেখেন হজরত আব্বাস (রাঃ) একটি রোজা বেশি রাখছেন। তিনি হজরত আব্বাসকে প্রশ্ন করলে তিনি জানান, মদীনায় শনিবার চাঁদ দেখা গেছে। এভাবেই রোজা রেখেছেন। অর্থাৎ যে দেশে যখন থাকবে সে দেশে যখন চাঁদ দেখা যাবে তখন থেকে রোজা রাখতে হবে। সিয়াসাত্তা অন্যতম আবু দাউদ শরীফে হজরত আবু হুরায়রা (বাঃ) বর্ণিত একটি হাদিস হলো ‘তোমরা ঐদিন রোজা রাখ যেদিন সকলে রোজা রাখে (সূমূলে ইয়াওম আনতুম তাসূমুন)।’ ড. হুজ্জাতুল্লাহ জানান, ২০০৯ সালে সিরিয়ার গ্র্যান্ড মুফতি ড. আলী জুমা এই মতের ওপরই ফতোয়া দেন। বিষয়টা খুব বড় কিছু নয়। কিন্তু এ নিয়ে ভেতরে ভেতরে কথা আছে। এটার সুরাহা হওয়া দরকার। এ জন্য যে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একদিন বা দুদিন আগে বা পরে চাঁদ দেখা যায়। সেভাবেই রোজাও হয়। যেমন রাশিয়ায় সৌদি আরবেরও একদিন আগে চাঁদ দেখা যায়। আমি মনে করি, দেশের বরেণ্য উলামায়ে কেরাম নিয়ে একটি কমিটি করে এ ব্যাপারে একটা মতামত দেয়া যেতে পারে। অন্তত একটা মত থাকা দরকার। তারপর যে যেভাবে চাইবেন রোজা রাখবেন। ঢাকা-২৪ মে, ২০১৯ লেখক : সংসদ সদস্য, সদস্য পাঠাগার ও তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। [email protected]
×