ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

ভাল থাকুন তারা

প্রকাশিত: ০৪:৫০, ৩ অক্টোবর ২০১৮

ভাল থাকুন তারা

অক্টোবরের প্রথম দিন ছিল প্রবীণ দিবস। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ দিনটি ‘প্রবীণ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। প্রবীণ বয়সের বিপন্নতার কথা ভেবে উন্নত দেশগুলো ষাটের ওপর বয়স যাদের সে সব নাগরিককে সিনিয়র সিটিজেন ঘোষণা দিয়ে তাদের জন্য কল্যাণমূলক নানা ব্যবস্থা নিয়েছে বহু আগেই। প্রবীণদের প্রতি মনোযোগ দেয়ার প্রশ্নটি আমাদের দেশেও বেশ প্রকট হয়ে উঠেছে। এদিকে দৃষ্টি দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ। দু’হাজার চৌদ্দ সালের সাতাশ নবেম্বর দেশের এক কোটি ত্রিশ লাখ ষাটোর্ধ নাগরিককে জ্যেষ্ঠ নাগরিক হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল আগে থেকেই। দু’হাজার তেরো সালের সতেরো নবেম্বর ‘জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা দু’হাজার তেরো’ মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পায়। এরপর জাতীয় অধ্যাপক এম আর খানকে প্রধান করে একটি কোর কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির দেয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী এ্যাকশন প্ল্যান করা হয়েছে। এতে জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের বিশেষ সুবিধা পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সব ধরনের পরিবহনে কম ভাড়ায় যাতায়াত, হাসপাতালে সাশ্রয়ী মূল্যে আলাদা চিকিৎসা সেবা, আলাদা বাসস্থান সুবিধা ইত্যাদি। কর্মপরিকল্পনার বিভিন্ন দিক আরও বিস্তৃত করেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব। তিনি জানিয়েছিলেন, প্রবীণরা সাধারণত যে সব রোগে ভোগেন যেমন হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস ইত্যাদির চিকিৎসা সেবা দিতে হাসপাতালগুলোতে জেরিয়াটিক মেডিসিন বিভাগ চালু করার জন্য নব্বই লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছেন তাঁরা। এ ছাড়া সরকারী-বেসরকারীভাবে যেসব আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হবে, সেখানে প্যারেন্ট রুম থাকবে। প্রবীণরা শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে ও হারিয়ে যাওয়া মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা রাখতে পারেন। এ জন্য তাদের সম্মানী দেয়া হবে। তাঁরা পরিচয়পত্র পাবেন। এক নতুন আইন করে তার আওতায় প্রবীণ উন্নয়ন ফাউন্ডেশন গঠন করে জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে। শিল্পোন্নত দেশে পঁয়ষট্টি বা তারও বেশি বয়সীদের প্রবীণ হিসেবে বিবেচনা করলেও জাতিসংঘের স্বীকৃতি অনুযায়ী ষাট বা তার বেশি বয়সীরা আন্তর্জাতিকভাবে প্রবীণ হিসেবে বিবেচিত হন। বিআইডিএসের পরিসংখ্যানে জানা যায়, উনিশ শ’ নব্বই সালে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার চার দশমিক আটানব্বই শতাংশ ছিল প্রবীণ জনগোষ্ঠী। জনসংখ্যা প্রক্ষেপণ অনুযায়ী দু’হাজার পঞ্চাশ সালে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর এই হার হবে শতকরা বিশ ভাগ। অর্থাৎ প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন হবেন প্রবীণ। বিভিন্ন জটিল রোগের প্রতিষেধক বের হওয়া, লাইফ স্টাইলে পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে মানুষের গড় আয়ু ও কর্মক্ষমতা বেড়েছে। তার পরেও প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে বার্ধক্য আসবেই। একে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এর মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুতিটা তাই রাষ্ট্রীয়ভাবেই থাকা উচিত। বিশেষ করে আমাদের মতো দুর্বল অর্থনীতির দেশে। কেননা বিত্তবানরা বিত্তের সুবাদে অন্তত কিছু সুযোগ-সুবিধা প্রবীণ বয়সে ভোগ করলেও বিত্তহীনরা অবর্ণনীয় দুরবস্থায় পড়েন। এ শুধু আমাদের দেশে নয়। সব দেশে সবখানে সব কালে বিত্তের ব্যবধানই মানবিক এবং মানবেতর জীবনযাপনের সীমারেখা টেনেছে। শুধু সমাজতান্ত্রিক দেশ ছাড়া শিল্পায়ন ও পুঁজিবাদের প্রসার ঘটার যুগে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে অতি ধনী ও অতি গরীব প্রবীণদের মধ্যে ধন-বৈষম্য এক ধরনের প্রবীণতন্ত্র জন্ম দিয়েছিল। উচ্চবিত্ত শ্রেণীর প্রবীণরা ক্রমশ রাজনৈতিকভাবেও ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন। সে সময় প্রবীণদের পক্ষেই সম্পত্তির মালিক হওয়া সম্ভব হতো। যথেষ্ট সম্পত্তি যাদের ছিল তারাই ভোটাধিকার পেতেন। অন্যদিকে শ্রমশক্তি হারিয়ে গরিব প্রবীণরা নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতেন। পুঁজিবাদী দেশগুলোয় বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে ‘সায়েন্টিফিক ম্যানেজমেন্ট অব ওল্ড এজ’ নামে প্রবীণদের সেবা দেয়ার ব্যবস্থাপত্র চালু হয়েছে। যার পেছনে মুনাফার বিশাল চক্র রয়েছে। প্রবীণদের জন্য ওল্ড ভিলেজ চিকিৎসা সেবা ইত্যাদির জন্য চড়া দামে প্রিমিয়াম নিয়ে জীবন বীমা প্রতিষ্ঠানের রমরমা ব্যবসা চলে সে সব দেশে। এর সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে প্রযুক্তি। প্রযুক্তির নতুন নতুন উদ্ভাবনকে কাজে লাগিয়ে প্রবীণদের জন্য সহায়ক নানা উপকরণ বের করে মিডিয়ায় চলে প্রচার যজ্ঞ। এসব উপকরণ ও প্রযুক্তির ভোক্তা যারা হতে পারেন তারা নিজেদের প্রজন্মের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তুললেও সমাজের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। মানবিক সম্পর্কের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়। মানবিক মর্যাদা হারিয়ে টাকার বিনিময়ে শারীরিক আরাম আয়েশ কিনে বেঁচে থাকছেন তাঁরা। কেনার সামর্থ্য যাদের নেই তাদের দিকে রাষ্ট্র হাত বাড়ায় না। দুরবস্থাই তাদের সঙ্গী হয় শেষ পর্যন্ত। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মানুষের মূল্য নির্ধারণ হয় তার উৎপাদন ক্ষমতার ওপর। উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায় মানুষ হিসেবে তার যাবতীয় মূল্য। হয়ত সে জন্যই শেষ জীবনে কাউন্ট টলস্টয় ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসান চেয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখেছিলেন। নিজের সব সম্পত্তি বিলিয়ে দিয়েছিলেন কৃষকদের মধ্যে। এ নিয়ে তাঁর পারিবারিক অশান্তি চরমে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত কিং লিয়ারের মতো ঘর ছাড়েন বৃদ্ধ টলস্টয় এবং মারা যান অখ্যাত এক রেল স্টেশনে। শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত ট্র্যাজেডি ‘কিং লিয়ার’-এর রাজা লিয়ার দুই মেয়ের মধ্যে রাজ্য ভাগ করে দিয়ে বৃদ্ধ বয়সে বিপন্ন হয়ে ঝড়ের রাতে খোলা প্রান্তরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। করডেলিয়া, ঠোঁট কাটা ছোট মেয়েটি, সত্য কথা বলার জন্য যাকে তিনি সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছিলেন শেষ পর্যন্ত সীমাহীন সহানুভূতি নিয়ে সে-ই এসে উদ্ধার করে বাবাকে। বৃদ্ধ বয়সে যাদের তত্ত্বাবধানে থেকে নিশ্চিন্তে জীবনযাপন করবেন ভেবে সব সম্পত্তি ভাগ করে দিয়েছিলেন সেই দুই মেয়ে দুর দুর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল বাবাকে। সহানুভূতি বা মানবিক বোধ কোন কিছুই কাজ করেনি তাদের ভেতর। প্রবীণ নাগরিকদের সর্বোচ্চ সম্মান দেয়ার কথা প্রথম বলেছিলেন সম্ভবত প্লেটো। তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের দার্শনিক রাজা হবেন জ্ঞানী। কৈশোর থেকে পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁরা নানা ধরনের বিদ্যা অর্জন করবেন। সব বিদ্যায় পারদর্শিতা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তবেই শাসক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন। যোগ্যতা অর্জনের এ প্রক্রিয়া শেষ হতে হতে তাঁরা আসলে বার্ধক্যের কাছাকাছি পৌঁছে যান। প্লেটো সম্ভবত নবীনদের ওপর ভরসা করতে পারেননি। তাঁর শিষ্য এরিস্টটল অন্য অনেক বিষয়ের মতো গুরুর সঙ্গে এ বিষয়েও দ্বিমত করে শেষ পর্যন্ত বলেছেনÑ জ্ঞানী বা প্রজ্ঞাবান হতে হলে যে কাউকে অন্তত পঞ্চাশ বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। প্রাজ্ঞরাই জীবনের সুখ-দুঃখ, চড়াই-উৎরাই মোকাবেলা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবে শারীরিক সুস্থতার ওপর জোর দেন তিনি। তাঁর মতে পঞ্চাশের পর দেহ সুস্থ না থাকলে প্রাজ্ঞরাও মানসিক বিকারে ভুগতে পারেন। তবে রাষ্ট্র পরিচালনায় বুদ্ধিবৃত্তির চেয়ে শারীরিক শক্তির ওপর জোর দেন তিনি। বুদ্ধি কিংবা শক্তি নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো বার্ধক্যে ভালনারেবল হবে কি হবে না অথবা কতটা হবে তা নির্ভর করে অর্থনৈতিক সক্ষমতার ওপর।
×