ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

জ্ঞানেশ মণ্ডল

গল্প ॥ খিড়কি

প্রকাশিত: ০৭:৩২, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

গল্প ॥ খিড়কি

খেলতে বসে প্রতি চালে জিতছিল মইফুল। তার প্যান্টের পকেট ক্রমশ ভারী হয়ে ওঠায় সে এখন উদ্বিঘœ। ভাবছে কী করে বাড়ি পৌঁছবে? প্রতিপক্ষ খুবই জোরদার। তারা ইতোমধ্যে বেশ গুছিয়ে নিয়েছে। মইফুল সতর্ক না হয়ে পারে না। যাতে দুর্বলতা ধরা না পড়ে, সে বরাবরের মত মুখাবয়ব জুড়ে ড্যাম কেয়ার গোছের একখানা সাইন বোর্ড ধরে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু জোরদার প্রতিপক্ষ লিডার সেসব বিবেচনায় না এনে অন্ধকারে জোনাক পোকার মতো মিটমিটে হাসির আলো ছড়ায়। কারণ কারও এখন আর বুঝতে বাকি নেই সবই জলের মতো স্বচ্ছ। মইফুল যে কোন উছিলায় খেলা ইস্তফা দিয়ে কেটে পড়ার ধান্ধা করবে। তার আগেই সুবিধামতো কোন এক সময় ধরে ফেলতে চায় ওরা। কিন্তু হটাৎই ত্যান্দর টিটু কাউকে কিছু না বলে মইফুলের শার্টের কলার চেপে ধরে বলল, “একখনি সব ঝেরে দিবি, নয়তো শালা ভুঁড়ি ফাটায়া দিমু।’’ মইফুলের গলার কাছে কি যেন একটা ছুরির মতো চেপে ধরে টিটু, ভয়ে আঁতকে ওঠে মইফুল। অদূরে দাঁড়িয়ে এ সময় খেলা দেখছিল নাসের। সপ্তাহের ছুটির দিন বলে কথা মইফুলের মতো সেও একজন বাইক ড্রাইভার। অবশ্য সে অনিয়মিত। জেলা সদর মোটর রিফাইনার একটা ওয়ার্কশপে সে চাকরি করে। অবসরে প্যাসেঞ্জার বয়ে বেড়ায়। একই পেশায় নিয়োজিত বলে। সমবেদনার পাল্লাটা মইফুলের দিকেই ঝুঁকে থাকা স্বাভাবিক নাসেরের। সে বন্ধুমহলে জেনেছে মইফুলের ঘরে ভারী সুন্দরী একটি ডাকা বুকো বউ রয়েছে। সে যে কত সুন্দরী তাকে দেখার অদম্য ইচ্ছা সেদিন থেকে নাসেরের। যে জন্য সে মাঝেমধ্যে মইফুলের সঙ্গে ভাব জমাবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু মইফুলের দিক থেকে কোন দিনও গ্রীন সিগন্যাল পায়নি নাসের। বরাবরের মত নিরাসক্ত ভাব দেখিয়ে নাসেরকে অপদস্থ করেছে মইফুল। তবে নাসেরের এবার শাপেবর হয়েছে যেন। যখন সবাই মিলে মইফুলের সর্বস্ব লুটে নেয়ার পাঁয়তারা করছিল, সে তখনি ন্যায়সংগত প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। খেলা না খেলা নিজস্ব ব্যাপার, সেখানে কেন জুলুম হবে? সঙ্গে সঙ্গে নাসের ক্ষিপ্র গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ত্যান্দর টিটুর ওপর। টিটু টাল সামলাতে না পেরে মাটির ওপর লুটিয়ে পড়লে মইফুল ওঠে দাঁড়ায়, এরমধ্যে বন্ধুত্বের সম্প্রীতির হাত বাড়িয়ে দিয়েছে মইফুল নাসেরের দিকে। ওরা দুজন এবার এক সঙ্গে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুজনের সম্মিলিত তা-বে পাঁচ পাঁচটি মানুষ প্রায় ধরাশায়ী। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। সূর্য পাটে বসেছে আগেই। মাঠের আঁকাবাঁকা আলপথগুলো সেই থেকে - অন্ধকারে ডুবে যেতে শুরু করে। হঠাৎ এ সময় টহল পুলিশের বাঁশির হুইসেল বাজতেই ওরা রণেভঙ্গ দিয়ে যে যেদিক পারে সব ছেড়ে ছুটতে থাকে উদ্ভ্রান্তের মতো। অনেক দিনকার এই টহল পুলিশের টিম জুয়ার আড্ডাটাকে ধরবে বলে নানা রকম ফন্দি ফিকিরে ছিল। আজ বাগে পেয়ে একেবারে উঠেপড়ে লাগে। মইফুল নাসের ছুটছে পাশাপাশি। এদিকে আন্ধারমানিক বাজার সংলগ্ন কোথায় যেন মইফুলের বাড়ি। পুলিশ তল্লাশির ভয়ে ওরা মাঝিরঘাট বরাবর প্রাণপণ ছুটছে। তবু যদি পুলিশ পিছু না ছাড়েতো শ্মশানঘাট পেরিয়ে সোজা চলে যাবে পদ্মার গহিন চরে। ওখানে সন্ধ্যার পর থেকেই শেয়াল, বাগদাসা, বনবিড়ালের একচ্ছত্র রাজত্ব। দিনের বেলায়ও ভয়ে ওদিকটা পাবলিক কোন ছাড় পুলিশ ও বড় একটা মাড়াতে সাহস পায় না। দরকারে ওরা হিং¯্র জানোয়ারের সহাবস্থানে রাত কাটাতে প্রস্তুত। তবু পুলিশের হাতে ধরা দেবে না। কথায় আছে কুমিরে নিলে পাঁচ বার আর পুলিশে ছুঁ’লে মাত্র একবার। যদি পুলিশ একবার হাতে পায়তো থানা থেকে সোজা চালান করে দেবে, তারপর ছ ন মাসেও জামিনের কোন নিশ্চয়তা নেই। জেলের ঘানি টেনেই মরতে হবে সারাজীবন। তাতে টাকার শ্রাদ্ধও কম হবে না। দিন কয়েক আগে পূর্ণিমা গেছে। এখন কৃষ্ণপক্ষ। সন্ধ্যা থেকেই অতলস্পর্শী অন্ধকার। লোকালয় থেকে কখন বেরিয়েছে ওরা টের পায়নি। ছুটতে পথেই চেয়ে দেখে মাথার ওপর খরতপ্ত বোশেখের সেই কৃষ্ণাকাশে আধ খাওয়া চাঁদের জ্যোৎ¯œা, যেন পুণ্যবতী যুবতীর ন্যায় জেল্লা ছড়াচ্ছে। আর সে কী জ্যোৎ¯œার সম্মোহনী মায়া। জোয়ারের মতো ভাসছে বিশ্বচরাচর। এ সময় নাসের বসে পড়লে মইফুল থমকে দাঁড়ায়, “কী হল নাসের ভাই, বইসা পড়লা যে?” “মাথায় ভীষণ ব্যথা।” মইফুল কাছে এসে মাথায় হাত রেখে চমকে ওঠে, “আরে তাইতো এ যে রক্ত! মাথা ফাটল কখন?” “কই টের পাইনিতো!” “সর্বনাশ তোমাকে এখনি ডাক্তার দেখানো দরকার।” রক্ত দেখে ঘাবড়ে যায় মইফুল। তারপর স্বগতোক্তির ন্যায় বিরবির করে, “বাজারে যাওন নিরাপদ নয়, ওখানে পুলিশ টহল।” নিজে নিজেই যেন হঠাৎ কি ভেবে নাসেরের দিকে ফিরে বলল, “লও আমার বাড়ি যাবা। তুমি হলা গিয়া আজ আমার ভিআইপি মেহমান। তুমি না থাকলে আজ যে আমার কী হতো, কখন মইরা ভুত হইয়া যাইতাম আল্লাই মা-লুম, কাউয়া পক্ষীও টের পাইতো না। মইফুল আবার নতুন করে তাড়া দেয়, ‘‘ও নাসের ভাই জলদি লও, বাড়িতে ডাক্তার ওষুধ সবই হইব।” কিন্তু নাসের নিমরাজি। তার ইঞ্চি দেড়েক মাথা কাটা গেছে ঠিকই, এখন কিছুই ভাল লাগছে না। মইফুল এরই মধ্যে ছুট পায়ে বাজার থেকে একটা গামছা এনে শক্ত করে মাথা বেঁধে দিয়েছে। আবার সেই একই তাগাদা, “লও না কাটা ঘা দেরি করলে সেফ্টিক হয়া যাবে।” এক সময় মইফুলের সুন্দরী বৌ দেখা নাসেরের বড় সাধ ছিল এখন মাথা যন্ত্রণায় সে বিকার মরে গেছে। সে আরও ব্যস্ত হয়ে পড়লে অবশেষে নাসের বলল, “এহন থাক, একেবারে সদরে গিয়া ডাক্তার দেখামু। এ অবস্থায় কেউ কারও বাড়ি যায় কখনও না ভাল লাগে?” মইফুল নিরাসক্ত কণ্ঠে বলল, ‘‘সে দেখাবে ভাল কথা। কিন্তু তুমি যে আমার জন্য মাথা ফাটালা এ অবস্থায় তোমাকে ছাইড়া দিলে হাশরে কী জবাব দিব আমি, বেইমান হয়া যামু না।’’ নাসের চুপ করে থাকলে সে আবার তাগাদা দেয়। পরিশেষে মইফুলের পীড়াপিড়ী দরুন এক সময় উঠতেই হয় নাসেরের। এরপর কখন সে বাজার থেকে ডাক্তার ধরে এনেছে, ডাক্তার কখন কাটা মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছিল তারপর রাত্রে কখন সে ঘুমিয়ে পড়েছে এ সবের কোন কিছুই মনে করতে পারে না সে এখন। মারদাঙ্গা খুনোখুনি অবশেষে পুলিশের ভয়ে পালিয়ে আসা এতসব ক্লান্তির অবসাদে সকাল বেলা যখন ঘুম ভাঙ্গে, চোখ খুলে দেখে ভোরের আলো বেড়ার ছিদ্র পথে তার বিছানায় লুটোপুটি যায়। মাথার কাছে যেখানে রাতের ডাক্তার সেলাই শেষে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছে। সে জায়গার ওপর ঝুঁকে পড়ে উজ্জ¦ল বর্ণের একটি মেয়ে চুলগুলো এখনো যার ভিজে হয়ত এই সাত সকালে ¯œান করেছে। মেকআপের সময় পায়নি এখনও, সে ঝুঁকে পড়ে নিষ্ঠার সঙ্গে কী যেন পর্যবেক্ষণ করছে। এমন সৌন্দর্য আর লাবণ্যভরা সুন্দরী মেয়ে জীবনে আর দুটো দেখেছে বলে মনে পড়ে না। বয়স হলেও তার এতটুকু ছাপ পড়েনি চেহারায় কিংবা ফিগারে। চমৎকার স্মার্ট ভঙ্গিতে সে তাকিয়ে আছে। নাসের প্রথমেই মুমূর্ষু রোগীর মতো মেয়েটিকে বলল, ‘মুই কোথায়?’ “আপনে বাড়িতে।” ভোরের কুয়াশার মতোই ভেজা কণ্ঠ রোমেনার। “এটা কী মইফুল ভাইয়ার বাড়ি?” “হ্যাঁ।” আবার বলল রোমেনা। তখনি আবার নাসের বলল, “আমি বাড়ি যামু।” সঙ্গে সঙ্গে দুহাতে ভর করে উঠে বসতে চেষ্ট করে সে। হায়! হায়! করে ওঠে রোমেনা, “আপনে অসুস্থ, ডাক্তার কয়ে গেছে আপনার বিশ্রামের দরকার, বাইরে যেতে নিষেধ ডাক্তারের’’ একটু একটু করে এ সময় সব মনে পড়ে নাসেরের, সেই সন্ধ্যার সময়কার নানা ঘটনার কথা সে ভাবছে নারী বিবর্জিত ঘটনার মধ্যে এখন আবার হঠাৎ করে নারী এলো কেমন করে? তবে কী এই সেই মইফুলের কবিলা? শালা বউ ভাগ্যে তবেতো একেবারে পয়মন্ত। এমন লক্ষ¥ী মন্ত বউ যার ঘরে সেতো দিন দুনিয়ার বাদশা বনে যায়। নাসিরুদ্দির মনে কাঁটার মতো কী যেন বিঁধতে শুরু করে তার ঈর্ষান্বিত বুক জ্বালা করে ওঠে। এখন ভাবে মইফুলের পীড়াপীড়িতে এসে ভালই করেছে। নয়তো এমন রূপ যৌবন দর্শন জীবনে আর নাও হতে পারতো। যে মানুষ সেই রাতেই ঘরে ফিরে আসার কথা সাত দিনেও সে যাত্রায় আর ফেরা সম্ভব হয়নি। সদরপুর এসে শেয়ালের মত ধূর্ত হয়ে ওঠে নাসের। প্রথমে স্ত্রী শাহিদার সঙ্গে মইফুলের মধ্যস্ততা করে; এই ভেবে যে, যদি মইফুলের সঙ্গে শাহিদার সম্পর্ক ভালবাসা গড়ে ওঠে, তবে রোমেনার সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে তুলতে আর কোন বাধা থাকে না। শাহিদাকে সে বলেছে, দেখ শাহিদা সেই রাত্তিরে মইফুল ভাই যদি ডাক্তার না দেখাত আর তার সহধর্মিণী রোমেনা ভাবী নার্সিং সেবা না দিত তবে আর প্রাণে বেঁচে থাকা তার কোন আশা ছিল না। একমাত্র নিজের মা বোন ব্যতিরেকে এমন নিঃস্বার্থ সেবাপরায়ণ মহিলা সে তার জীবনে দুটি দেখেনি। অবশেষে মইফুলকে দেখিয়ে বলেছিল, যদি কখনো মইফুল ভাই এখানে আসে তাকে যেন নিজের লোক ভেবে শাহিদা সেবা শুশ্রূষা ত্রুটি না করে। এমন অপ্রত্যাশিত সমভিব্যহারে মুগ্ধ মইফুলের নাসেরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আরও দ্বিগুণ বেড়ে যায়। এতো যে ভাল মানুষ নাসের নিজের আগেকার অমানবিক ব্যবহারে সে আরও বিন¤্র হয়ে পড়ে। বরাবরের মত জেনে এসেছে নাসের দুশ্চরিত্র লম্পট প্রকৃতির মানুষ। আজ তার অন্তর্দৃষ্টি খুলে যায়। বিস্ময়াভিভূত মইফুল। সেই বিক্ষুব্ধ সন্ধ্যা প্রাক্কালে নাসের যদি তার প্রতি সদয় না হতো তবে তার মৃত্যু ছিল অবধারিত। এখন কোথায় থাকত সুন্দরী বৌ, পুত্র-কন্যা। আর এই উপকারী বন্ধু তার কোন প্রতিদান না চেয়ে উল্টো কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে, এমন নিঃস্বার্থ ভাল মানুষ সমাজে আর একটি আছে কিনা তার জানা নেই। এত দিনকার কত বড় সত্যিটা রোমেনাকে এখনও জানানো হয়নি খুবই আত্মদংশিত মইফুল। ধূর্ত নাসের এভাবেই মইফুলের সরলতার সুযোগ নিয়ে রোমানাকে কব্জা করার ফন্দি আঁটে তারপর থেকে সে যখনি আন্ধারমানিক এসেছে, মইফুল তাকে ডেকে দিয়ে তার কাজে বেরিয়ে গেছে। গোড়া থেকেই রোমেনা নাসেরকে হেংলা স্বভাবের অসৎ লোক ভেবে আসছিল। তখন থেকেই এড়িয়ে চলার কোন ত্রুটি করেনি। কিন্তু এত সাবধানতা সত্ত্বেও নিজেকে বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি রোমেনা। লোভের বসে একটু একটু করে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। কারণ নির্লজ্জ নাসেরের কোন তোয়াক্কা নেই। সে জানত রোমেনা ধনী ঘরের আদুরে দুলালী। বাপ-মায়ের কাছে না চাইতেই সব পেয়েছে। মইফুলের নি¤œ মধ্যবিত্ত সংসারে পড়ে সাধ আহ্লাদ বলতে এখন আর কিছু অবশিষ্ট নেই। নাসের এখান থেকেই রসদ সন্ধানে ব্রতী হয়। একটু একটু করে নিজেকে প্রস্তুত করে, মেয়েরা যে চিরকাল উপহারপ্রেমী। কেউ কিছু হস্তান্তর করলে আত্মতৃপ্তির উদ্ভাসে উল্লসিত হয়। প্রসূত ভাবনার পথ ধরেই আশার বুক বাঁধে নাসের। এটা ওটা মইফুলের ছেলেমেয়ের হাতে ধরে দিয়ে রোমেনার নজর কাড়ার চেষ্টা করে। যেন ঝিকে মেরে বৌ-কে শেখায়। হঠাৎ একদিন বুঝতে পেরে রোমেনা মইফুলকে দিয়ে বাঁধ সাধে। মইফুল রোমেনার পথ ধরেই নাসেরকে বলেছিল, “রোজ রোজ এটা ওটা হাতে করে এত কী আনার দরকার কও? তুমি হলা গিয়া আমার জেবন দাতা আর এটাই তোমার বড় পরিচয়।” বিকেলে পানশালা চত্বরে দুজন বসেছিল। ওদের পায়ের কাছে শেষ বিকেলের পড়ন্ত ছায়া, ক্রমান্বয়ে আরও ঘনীভূত হয়ে আসে। নাসের হেঁয়ালী সুরেই প্রথম শুরু করে বলল, “মোর দুখানা আর্জি আছে মইফুল ভাই। পরথম আমার বউ শাহিদার। তুমি আগের মতো এখন আর আমাগো বাসায় আস না।” এর মধ্যে দু দুবার রোমেনার সঙ্গে বসার সুযোগ হয়েছিল নাসেরের সেই সুবাদে মইফুল সম্পর্কে রোমেনার মনের অনেক অজানা পুঞ্জীভূত ব্যথা যা এতকাল আগ্নেয়গিরির লাভার মতো বুকের মধ্যে চাপা পড়েছিল। সেখানে নাসের যদি একটি দেশলাই কাঠির সংযোগ ঘটাতে পারে, তবেই ব্যাস! —————। যত সুপ্ত যন্ত্রণা ফুঁসে উঠতে শুধু সময়ের ব্যাপার। নাসের আবার বলল, “রোমেনা ভাবীর অভিযোগ, তুমি মোটেও তাকে সময় দেওনা।” বিস্ময়াভিভূত মইফুল, এত আগুন অন্তরে পুষে রেখেছে কেমন করে রোমেনা। বলল, ‘‘জানতো ভাই আমার নি¤œ মধ্যবিত্ত সংসার। নুন আনতে পান্তা ফুরায়, একদম সময় করতে পারি না। তাছাড়া রোমেনা আমার ঘরের লক্ষ¥ী, মুই যা কিছু করি সবতো তার সুখের জন্যই। সে ছাড়া মোর কেবা আছে আর। তবে কী জান বাইরে গিয়েও শান্তি নাই। কেউ কয় কাউয়ার মুখে কমলা, তুমিতো জান আমরা ভালবেসে বিয়ে করি। রোমেনা বড় ঘরের আদুরে মাইয়া। স্বইচ্ছায় আমার ঘরে বউ হয়া আইছে। এতে করে তারও মন খারাপ লাগা স্বাভাবিক।” “কিন্তু বাইরের লোকেতো অন্য কথা কয় ভাইয়া।” বলল নাসের। “কী কথা কয়?” “সুন্দরী বউ পাইয়া ঘরে বন্দী কইরা রাখ তুমি।” “মিছা কথা কয় ” ধূর্ত নাসের প্রশ্নান্তরে আলোচনার খেই ঘুরিয়ে বলল, “তাহলেতো তোমার বাড়ি মোরও যাওয়া ঠিক হইব না আর।” “এ কতা কও ক্যান?” মইফুল বলল, “তোমার একটা রিজার্ভ চাকরি আছে। মাস গেলে অনেক আসে। তোমার হোন্ডা বাওয়া সখের কারবার। তুমি দরকারে বাইরে সময় দিবার পার।” এবার দৃঢ়তার সঙ্গে নাসেরকে আবার বলল মইফুল, “মুই তোমার বাড়ি যাই বা না যাই সেটা বড় কথা নয়। তুমি আমার বাড়ি আগের মতোই আসবা। রোমেনাতো সারাদিন একাই থাকে, তুমি একটু সময় দিলে খুশিই হইব।” নাসের এবার মইফুলের উৎসাহের প্রাবল্যে আরও একটু আগ বাড়িয়ে ভাল মানুষের মত বলল, “কামের অজুহাত বাদ দাও, ভাবীরে আরও একটু সময় দিবা, ঘুরেটুরে আস বাইরে থেকে, দেখবা রোমেনা ভাবী তোমারে আরও কত বেশি ভালবাসবে।” মইফুল বাইক স্টর্ট দিতে গিয়ে উল্লসিত হয়ে প্রত্যুত্তরে বলল, “বাকি দায় এহন তোমার বন্ধু।” নাসেরও উল্লসিত হয়ে কণ্ঠ মেলায়। তারপর আর বসে থাকতে হয়নি নাসেরের। অনুমতি পাওয়া মাত্র দুর্বার গতিতে তেড়ে ওঠে দিনকে দিন। প্রতি ঈদ পার্বণে দুটো শিশু সন্তানের জন্য দামি পোশাক কিনে। আর রোমেনার জন্য বরাবরের মত থাকে লম্বা বাজেট। মূলত ওদিকেই থাকে শকুনের মতো শ্যেন দৃষ্টি। দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করে শুধু। সেই থেকে নিজের অজান্তে একটু একটু করে নাসেরকে ভালবাসতে শুরু করে রোমেনা। শহরে প্রতি বছর হিন্দু সম্প্রদায়ের রথ উৎসব বসে । (এরপর ঠাকুর জগন্নাথ এক মন্দির থেকে অন্য মন্দিরে রথে চড়ে যাবেন। এই নিয়ে উৎসব। সামনে বিশাল চত্বর জুড়ে মেলা বসে, সার্কাস ওঠে, আরও পুতুল নাচ, রাধা দোলা, আরও হরেক রকমের ভিড়ভাট্টা। প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসে শহরে। নানা রঙের পোশাক পরা হরেক রকমের মানুষ। সুযোগ বুঝে মইফুলের বাচ্চা দুটোকে ক্ষেপিয়ে তোলে নাসের। ওরা কোনদিন শহরের মেলা দেখেনি। শোনা মাত্র ধেই ধেই করে নাচতে শুরু করে। যাবে, বাসে মাত্র ঘণ্টা খানেকের পথ। তবু রোমেনাও যায়নি কোনদিন। সবশুনে নাসের যাত্রা ভিলেনের মতো অট্টহাসি উড়িয়ে বলে, “কী দুর্ভাগ্য তোমার ভাইসাব। মইফুল ভাই তোমার জীবনটা একদম হেল করে দিল। সে তোমার শরীল ছাড়া কিছু বোঝে নাই কোনদিন। একবার ঘর থেইকা বেরিয়া দেখ তুমি। কী তোমার পরিচয়, আমি তোমারে শহরে নিয়া যামুই একদিন। আর তখনি তুমি বুঝবার পারবা কোথায় তোমার বসবাস?” “কী কইরা জানবো আপনের বন্ধুতো লইয়া যায় নাই কোনদিন।” “কইছিতো মুই নিয়া যামু একদিন।” তারও যেতে বড় সাধ। সেই থেকে রোমেনাকে বাইরের পৃথিবী হাতছানি দিয়ে ডাকে, শহর কত বড়। চারদিক কত মানুষের সমাগম। সে ওই নাসেরের কাছেই আগে পাছে কত শহরের গল্প শুনেছে। প্রায়ই আজকাল সেসব চোখে ভাসে রোমেনার। নাসেরটা ভারি দুষ্ট। শুধু গল্পে গল্পে স্বপ্ন দেখাতে ভালবাসে। নাসেরের উজ্জ¦ল গতিময়তা খুবই পছন্দ রোমেনার। সারাজীবন এই চার দেয়ালের মধ্যে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছে সে এখন। একমাত্র নাসেরই ঘর বাহিরের পার্থক্য চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। স্বপ্নতো সুধু স্বপ্ন নয়, বেঁচে থাকারও যে প্রেরণা। স্বপ্ন বাদ দিয়ে কখনও কী জীবন হয়? জীবনের কোন মূল্য হয় না। এই অনুভূতিটুকু নাসেরের কাছ থেকেই পাওয়া। রোমেনার ভয় হয়, সত্যি যদি কোনদিন এমন সময় আসে, মইফুল নাসেরের সঙ্গে বের হতে না দেয়, তবে কী করে দিগন্ত জোড়া উদার আকাশ দেখা সম্ভব হবে? খোলা বাতাসে গা ভাসিয়ে ছুটে বেড়ানো সেও কি কম উৎকর্ষের? রোমেনা পরামর্শ করে নাসেরের সঙ্গে। নাসের রাত্রে মইফুলকে জানায়, “সবাইকে লয়া সদরে আসবা কিন্তুু।” “আমার সময় হবে না। তুমি লইয়া যাইবা।” এ সময় ছলনার আতিশয্যে রোমেনা বলল, “নিলুফার আব্বু যদি লগে না যায় আমি একা কী কইরে যাই?” “ভাবীসাব কি কয়?” নাসের জানতে চাইলে রোমেনা আবার ছলনার আতিশয্যে বলল, “আমার হাতের রান্না না হলে যে, নিলুফার আব্বার মুখে খাওন ওঠে না।” শুনে যেন লজ্জা পায় মইফুল, চট জলদি বলল, “না-না সে তুমি যাও গিয়া নাসের মিয়ার সাথে। ছেলে মেয়ে দুটা এত করে আহ্লাদ করছে যাইব। কোথাওতো যাওয়া হয় না তোমাগো। আমার খাওয়ার জন্য বেহুদা ভাব্বা না। কিছু একটা ব্যবস্থা কইরা নিমু। মাত্রতো দুটা দিনের মামুলা হইবো একটা কিছু।” আজ সহজেই নাসেরের কাছে ধরা দেয় রোমেনা। নাসের রোমেনাকে নিজের বাসায় না তুলে তার মটর ম্যান সন্স মালিক ওসমান চৌধুরীর বাসায় তোলে। খুবই দুর্ভেদ্য প্রাচীর ঘেরা মহল। বাইরের দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এখানে আরাম আয়েসে সময় কাটে রোমেনার। নাসের নিশ্চিন্ত। শহরের যে কটা সম্ভ্রান্ত পরিবার আছে তার মধ্যে অন্যতম চৌধুরী পরিবার। তাদের প্রভাব প্রতপত্তি অনেক। এখানকার ভেতরের খবর কারও জানা দুঃসাধ্য। সেজন্য নাসের সর্বদা নিজেকে নিরাপদ মনে করে। দুদিন বাদেই মইফুলের টনক নড়ে। চেয়ে দেখে কাছে পিঠে কোথায় কেউ নেই। স্ত্রী-পুত্র কন্যা কেউ নয়। চারদিক শুনশান নিস্তব্ধ। একি ভুল করছে মইফুল? এরপরও দুদিন অধীর প্রতীক্ষায় অতিবাহিত। ওপাড়ে রিংটোন বেজে নিঝুম হয়ে যায়। কল তুলে ধরার কেউ নেই। শুধুই নিষ্ফল ক্রন্দন। ষড়যন্ত্রের আঁশটে গন্ধ আসে নাসারন্ধ্রে। যেমন ভেবেছিল, সদরে পৌঁছে দেখে নাসের নেই। শাহিদা জানায়, প্রায় পাঁচ দিন হয় নাসের বাড়ি ফেরে না। প্রথম শহরের এদিক ওদিক খুঁজে ফেরে নাসেরকে মইফুল। কোথায় নেই। অবশেষে খুঁজে পেলে মইফুল প্রথমে রোমেনা, ছেলে মেয়ে কেমন আছে জানতে চায়; উত্তরে চট জলদি করে নাসের জবাব দেয়, “সেতো কবে ওগো নিয়া আন্ধারমানিক ফিরা গেছে।” মইফুলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। যে মানুষ কোন দিনও ঘরের বাহির হয়নি সে একা কি করে আন্ধারমানিক ফিরে যায়? অনাকাক্সিক্ষত বিপদের আশঙ্কায় মইফুল কেঁপে ওঠে। নিশ্চয় এ নাসেরের ষড়যন্ত্র। ভাল মানুষের মুখোশ পরে নাসের লোকালয়ে ঘুরে বেড়ায়। সুযোগ বুঝে এসবই করে সে। মইফুল পূর্বে যা শুনেছে সবই সত্যি। সে পাগলের মতো চিৎকার করে ওঠে, “উত্তর দাও কোথায় লুকায়া রাখছ আমার পরিবার?” “এর নাম বুঝি উপকারের উপকার।” ধীর গম্ভীর স্বর নাসিরুদ্দির। থমকে মইফুল বলল, “তুমি মোর জীবন বাঁচায়েছ একদিন; যত দিন বাইচা আছি স্বীকার করব। তাইতো বিশ্বাস করে আপন ভেবে তোমার হাতে নিজের মান-সম্মান তুইল্যা দিছিলাম, বিশ্বাসঘাতক এই তার প্রতিদান।’’ মইফুল পাগলের মতো ছুটে যায়। নাসের ততক্ষণে দূরে সরে গিয়ে বলল, “মুই জানি না, তুমি খুঁইজা দেখতে পার।” আর দাঁড়াতে পারে না মইফুল। মাথার ভেতরটা অস্থির করে। ফিরে দেখে নাসের কেটে পড়েছে এরি মধ্যে। তখনি ছোট ভাই মুজিবুলকে ফোনে আসতে জানায় মইফুল। মুজিবুল দুপুরের দিকে ফিরে আসে, এখন কোথায় যাবে। উপায়ান্তর না দেখে দুভাই হোসেন মিয়ার শরণাপন্ন হয়। সে গাঁয়েরই ছেলে। এখন শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। হোসেন মিয়া বণিক সমিতির সভাপতি তাজুল সাহেবের কাছে নিয়ে যায়। তিনি সমিতির সভাকক্ষে বসেন। সবশুনে বললেন, “রোমেনা চৌধুরী ভিলাতেই আছে।” তিনি আর বিলম্ব না করে তখনি শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে সোর্স লাগালেন। এরপর থেকেই প্রতীক্ষার পালা। রাত যায় দিনও যাবার পথে, সোর্স খবর নিয়ে আসে; চৌধুরী ভিলাতেই রোমেনার আরাম আয়েসে সময় কাটছে। আর সোর্স নয় তাজুল সাহেব নিজেই ফোন করেন ওসমানকে। সরাসরি জানতে চান, রোমেনাকে তার হাতে হস্তান্তর করবে কিনা। কিন্তু ওসমান চৌধুরী অন্য সুরে কথা বললেন, রোমেনা নামের কোন মেয়েকে তিনি চেনেন নাতো বটেই দেখেননিও কোনদিন। দরকারে তাজুল সাহেব নিজে এসে অন্দর মহল ঘুরে যেতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে তাজুল সাহেব জানালেন, “আমি নয় চৌধুরী সাহেব, যদি দরকার মনে করি আপার অন্দর মহলে পুলিশ যাবে। এতে কী আপনার বংশমর্যাদা অক্ষুণœ থাকবে মনে করেন? সামান্য একজন মোটর মেকানিজের জন্য আপনার বাপ-দাদার এত দিনকার তিলে তিলে গড়ে ওঠা আত্মমর্যাদাবোধ ক্ষুণœ হবে না? ওসমান চৌধুরী এবার মোবাইল ছেড়ে দেন। সন্ধ্যার প্রাক্কালে বড় ছেলে সাহেব ছৌধুরীর মারফত রোমেনাকে পৌঁছে দেন তাজুল সাহেবের হাতে। রোমেনা হাতে আসা মাত্র আর বিলম্ব নয় দিনরাত করে বুঝিয়ে যান তিনি। রোমেনা তার সিদ্ধান্তে তবু অটল, অনড়। তবু যেন তাজুল সাহেবের ক্লান্তি নেই। নিয়মমাফিক আগের সেই শেখানো বুলি আওড়ে যায় রোমেনা, মইফুলকে সে চেনে না, জানে না দেখেওনি কোন দিন। নাসেরকে সে ভালবাসে। নাসেরই তার সারা জীবনের সাথী। তাকে ব্যতীত সে বাঁচবে না বলল, “আমার জীবন মরণ সবই নাসের।” সভাপতি তবু শক্ত হাতে হাল ধরে থাকেন শেষাবধি লড়ে যাওয়ার জন্য। এক সময় রোমেনা অভুক্ত শরীরে আত্মহননের হুমকি দিয়ে নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকে। বাড়ি ডাক্তার আসে। পাল্স, প্রেসার এসব দেখে ডাক্তার স্যালাইন ব্যবস্থা দিয়ে যান। মহল্লা জুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয় এ সময়। প্রথমে পরিপার্শ্বের লোকজন তারপর ধীরে ধীরে মহল্লার বাইরের লোকজন জড় হতে থাকে। ভিড় জমে ওঠে ক্রমান্বয়ে। আবেগে ক্ষোভে যে যেমন মন্তব্য জুড়ে যায়। না খেয়ে দিন দিন আরও দুর্বল হয়ে পড়ে রোমেনা। বাড়ির সবাই বিরাগভাজন, বাইরের একটা উটকো ঝামেলা, সেজন্য পরিবারের মধ্যে একটা অশান্তি বিরাজ করে। উৎসুক জনতা আরও বেড়ে গেলে তাজুল সাহেব দারোয়ানকে গেট বন্ধ করার নির্দেশ দেন। কলাপসিবল গেট। বন্ধ গেটের ওপারে জনতার উৎসুক দৃষ্টি। সবাই রোমেনার রূপে মুগ্ধ। অভুক্ত শরীরে ক্রমান্বয়ে আরও ভেঙ্গে পড়ে রোমেনা। হঠাৎ করেই এ সময় তাজুল সাহেব বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন। সে যদি তার সংসারে ফিরে গিয়ে একবার আহার নিদ্রায় অভ্যস্ত হয়, স্বামী-সন্তান নিয়ে থিতু হতে পারে, তবেই নিজের ইগো থেকে সরে হারানো ছন্দে ফিরে যাওয়া সম্ভব। এভাবে ধীরে ধীরে একদিন স্বাভাবিক হতে পারবে রোমেনা। যেমন ভাবনা তেমন কর্ম, রাতের মধ্যে মাইক্রোযোগে রোমেনাকে তুলে দিলে, ছেলে মেয়েসমেত মইফুল আন্ধারমানিক ফিরে আসে। এ সময় রোমেনা দুর্বল শরীরে আর কোন প্রতিরোধ গড়তে পারে না। কদিন আর নিজের সংসারে পালিয়ে থাকা যায়? কিছুদিনের মধ্যে রোমেনা আবার হারানো ছন্দে ফিরে আসে। নিন্দুকেরা বারবার নিন্দার ঝড় তুলতে গিয়ে এক সময় উৎসাহ হারিয়ে শান্তÍ হয়ে যায়। পুরনো ভাঙ্গা রেকর্ড বারবার কারও বাজাতে মন চায় না। এভাবেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে রোমেনার কলঙ্কগাথা। কদিন থেকে প্রচ- গ্রীষ্মের দাবদাহ যাচ্ছে। গরমে যখন অতিষ্ঠ প্রাণিকুল তখনি একদিন কালবৈশাখী ঝড়ে দুর্বার বৃষ্টি নামে। ক্লান্ত আকাশ অঝর ধারায় উদর শূন্য করে পরিশ্রান্ত। এ সময় সন্ধ্যা নামে আরও রাত বাড়ে। উঠানের খানাখন্দরে বৃষ্টির জল জমে। পরিপার্শ্ব জুড়ে ভেজা ঝোপঝাড়ে রাতের জোনাকিরা দ্বীপ জ্বেলে প্রহর জাগছে। ঝিঁঝিঁরাও আনন্দে সেতারে ধরেছে বেহাগের সুর। মইফুলের এখন কী হয়েছে? বৃষ্টির নেশায় সেই থেকে ঘুমে বিভোর। ঘুমকাতুরে বাচ্চা দুটোও ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘুম নেই শুধু রোমেনার চোখে একা। এই মাহেন্দ্রক্ষণটুকুর জন্য যেন সে একা জেগে আছে। অধীর রোমেনা এখনও কেন ফোন আসছে না? প্রতীক্ষার অতিক্রান্ত সময় যেন আর কাটছে না রোমেনার। হঠাৎ এ সময় ভাইব্রেশন মোবাইলটা কেঁপে ওঠে। ওপার থেকে ভেসে আসে রোমেনার কর্ণকুহরে “বাইরে আস আমি খিড়কি দুয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে। আর দেরি করলে প্লানটা ভেস্তে যাবে।’’ এরপর রোমেনা অনাকাক্সিক্ষত বিপদের আশঙ্কায় শিহরিত হয়। তখনি আর কিছু না ভেবে উঠে দাঁড়ায় রোমেনা। কোনদিক তাকাবার সময় নেই আর, দরজা ভেজিয়ে আলতো পায়ে নেমে আসে উঠানে। উঠান জুড়ে এখনও বৃষ্টির থিকথিকে কাদা। চারদিক নিকশ কালো অন্ধকার। পেছনের দুয়ারে একটা অশরীরী মূর্তিমান কালো ছায়া নড়ে যায়। এ সময় রোমেনা দৃঢ়পদ সঞ্চালনে অন্ধকারে হেঁটে চলে ছায়ামূর্তি লক্ষ করে। এবার বৃষ্টিভেজা মাঠের আলপথ ধরে। মাঠ পেরিয়ে পাকা সড়ক ধরে ওরা। এখন আর ছায়ামূর্তি নেই। আঁধারে অস্পষ্ট আলোর ছোঁয়া। কী ভেবে রোমেনা লোকটিকে ধরবে বলে আরও জোর কদম এগিয়ে গিয়ে বলল, “কে তুমি নাসের?” “আমি দুবাইওয়ালা নারী ব্যবসাদার। সুন্দরী মেয়েদের বেশি দামে বিদেশে পাচার করি।” তখনি অদূরে রাস্তার পাশে মাইক্রোবাসের হেড লাইট জ্বলে ওঠে আবার নিভে যায়। “নাসের কোথায়?” বলল রোমেনা। “আমি জানি না।” এ সময় বাস থেকে দু তিন জন লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে বেরিয়ে আসে। সে বলল, “তোমর নাগর দেনা পাওনা চুকে দিয়ে আগেই কেটে পড়েছে।” আর দেরি না করে পেছন ফিরে রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে থাকে রোমেনা। ওরা দৌড়ে সহজেই ধরে ফেলে, জোর করে মাইক্রোবাসের কাছে টেনে হেঁচড়ে ভেতরে ঠেলে দেয়। রোমেনা চিৎকার করে, বাঁচাও! বাঁচাও!! সঙ্গে সঙ্গে মাইক্রোবাস গর্জে ওঠে বিকট শব্দে। হেড লাইট জ্বলে ওঠে আবার। সশব্দে ছুটে চলে বাসটি। রোমেনার আর্তচিৎকার চাপা পড়ে থাকে যন্ত্রদানবের আত্মহুংকারে।
×