ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আরএম দেবনাথ

আমানতের নিরাপত্তা ॥ আমানতবীমাসহ নানা পদক্ষেপ নেয়া আছে

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২৭ জুলাই ২০১৮

 আমানতের নিরাপত্তা ॥ আমানতবীমাসহ নানা পদক্ষেপ নেয়া আছে

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নরের ক্ষমতা (পাওয়ার) অফুরন্ত। সেই জন্যই বলা হয় গবর্নরের কথা বলা উচিত কম, কাজ করা উচিত বেশি। কারণ, গবর্নরের প্রতিটি কথার ‘অর্থ’ করা হয়। তার কথা আলোচিত হয়, ব্যাখ্যা করা হয়। এতে অর্থনীতির ভাল-মন্দ হয়, ব্যাংকিংয়ের ভাল-মন্দ হয়। এ প্রেক্ষাপটে দেখলে তার একটি কথা এবার বেশ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেছেন, ব্যাংকিং খাতের ওপর জনগণের ‘আস্থার সঙ্কট’ তৈরি হয়েছে। শব্দগুলো এমন না হলেও মোটামুটি এমন ধরনের মন্তব্যই তিনি কিছুদিন আগে করেছেন। আর যায় কোথায়? এখন সর্বত্র নানা প্রশ্ন। অন্যদের কথা জানি না আমি প্রশ্নবাণে জর্জরিত। এর অবশ্য কারণ আছে। আমি অর্থনীতির ওপর নিয়মিত কলাম লিখি। তাই অনেকেই জানতে চায় অমুক ব্যাংকে টাকা রাখা যায় কীনা? ব্যাংকে টাকা রাখলে ফেরত পাওয়া যাবে কীনা? আসলে ব্যাংকগুলোর অবস্থা কেমন? সমস্ত খাত ধসে পড়বে কীনা? এসব প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে আছে ক্ষোভ, ভয়, আতঙ্ক ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে প্রায় প্রতিদিন যেভাবে খবরের কাগজে ব্যাংকের অনিয়মের ওপর খবর ছাপা হয় তাতে জনমনে এ ধরনের ভয়-ভীতির জন্ম হওয়া স্বাভাবিক। আবার এও সত্যি ব্যাংকগুলো তো চলছে। কোথাও কোন সাধারণ ‘কাস্টমার’ টাকা তুলতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন এমন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। ‘ফারমাস ব্যাংকের’ সমস্যা ছিল বড় কর্পোরেট গ্রাহককে নিয়ে। সেটা একভাবে শেষ হয়েছে। এখন অন্যদের কথা। এই ক্ষেত্রে আমার জবাব তত্ত্বগতভাবে আছে যার কথা বলছি। ব্যাংকের বারোটা বাজাতে পারে একমাত্র আমানতকারীরা (ডিপোজিটর) কাল সকালে যদি সকল ব্যাংকের আমানতকারীরা গিয়ে ব্যাংকে লাইন দিয়ে টাকা তুলতে চায়, তাহলে সকল ব্যাংকের একযোগে লালবাতি। কারণ? কারণ ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা বসিয়ে রাখেনি। দিয়েছে ঋণগ্রহীতাদের। যখন-তখন তা ফেরত পাওয়া যাবে না। এমতাবস্থায় সকল গ্রাহক একযোগে টাকা তুলতে গেলে সব ব্যাংক ‘ফেল’। ব্যাংক চলে একটা ‘ধারণার’ ওপর। কিছু লোক টাকা জমা দেবে, কিছু লোক টাকা তুলবে। তোলার চেয়ে জমা হবে বেশি। এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে কোন দেশে ব্যাংক চলবে না। তবে হ্যাঁ, এরপরেও কথা আছে। কোন একটি ব্যাংকে যদি সঙ্কট তৈরি হয়, অথবা সঙ্কট তৈরি হয় কয়েকটি ব্যাংকে তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘লেন্ডার অব দ্য লাস্ট রিসর্ট’ হিসাবে এদের বাঁচিয়ে দিতে পারে। কীভাবে? টাকার জোগান দিয়ে। এবং এটা হয়। প্রায় সর্বত্রই পুঁজিবাদের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১০-১৫ বছর আগে তা ঘটেছে। বারাক ওবামা ডুবন্ত মার্কিন ব্যাংকগুলোকে ‘ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার’ দিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। আমাদের দেশে এ ঘটনা অনেক ঘটেছে। ইস্টার্ন ব্যাংক, কমার্স ব্যাংক, এনসিসিবিএল, বিডিবিএল আইসিবি ইসলামী ব্যাংক ইত্যাদি আমাদের দেশের উদাহরণ। সরকার ডুবন্ত এসব ব্যাংককে বাঁচিয়ে দিয়েছে। নতুন ব্যাংক করে বাঁচিয়ে দিয়েছে। সরকার দেশে দেশে এটা করে। কারণ, কোটি কোটি লোকের সঞ্চয় এসব ব্যাংকে থাকে। ইচ্ছা করলেই এগুলোকে পরিত্যাগ করে সঙ্কট তৈরি করা যায় না। তাহলে ব্যাংকিং খাত থাকবে না। ব্যাংক ছাড়া অর্থনীতি হবে না। ব্যাংক নিয়মের মধ্যে চলবে। অনিয়ম হলে বিচার হবে, শাস্তি হবে কিন্তু আমানতকারীদের টাকা নিরাপদ থাকতে হবে। এটাই স্বীকৃত নীতি। এর জন্য আমাদের দেশে আমানতবীমা (ডিপোজিট ইনসিওরেন্স) আছে। এক লাখ টাকা পর্যন্ত যাদের আমানত আছে একটি ব্যাংকে সেই ব্যাংক ‘লালবাতি’ জ্বালালে আমানতকারীরা তার এক লাখ টাকা পর্যন্ত টাকা সহসা ফেরত পেয়ে যাবেন। এর দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। ব্যাংক যদি দেউলিয়া ঘোষিত হয় তাহলে তা হবে কোর্টের মাধ্যমে। কোর্ট ‘লিক্যুইডেটর’ (অবসায়ক) নিয়োগ করবে। ব্যাংকের কাছে প্রতিদিন বেশ টাকা থাকে। বর্তমান নিয়মেই ২০ টাকার মতো ‘ক্যাশ’ টাকা ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে ব্যাংকের হাতে থাকে। এই টাকা আমানতকারীরা পেয়ে যাবেন। সব ব্যাংককে এখন ১০ শতাংশ পুঁজি রাখতে হয়। ১০ শতাংশ মানে আমানতের ১০ শতাংশ। এই টাকা ব্যাংকের সঙ্কটে কাজে লাগানো যাবে। তাছাড়া রয়েছে ‘প্রভিশনের’ টাকা। প্রতিটি ‘খারাপ লোনের’ বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখা আছে এবং প্রতিটি লোনের বিপরীতে কোর্টে মামলা আছে। ‘প্রভিশন’ রাখা হয় ‘প্রফিট’ থেকে। খারাপ লোনের টাকা আদায় না হলে ওই প্রভিশনের টাকা থেকে তা পুষিয়ে নেয়া হবে। শুধু ব্যাংক নয় সকল ব্যবসাতেই এই ব্যবস্থা করা আছে। এর জন্য ‘এ্যাকাউন্টিং মেথড’ আছে। প্রভিশনের টাকার ভাগিদারও আমানতকারীরা। কোর্টে যে মামলা আছে সেই মামলা ফয়সালা হবে। ঋণখেলাপীর মুক্তি নেই। টাকা তাকে দিতেই হবে। খেলাপীর সুদ কিছুটা মাফ হতে পারে। আসল টাকার এক পয়সাও মাফ হবে না। অথচ মানুষের ধারণা খেলাপীদের টাকা মাফ হয়ে যাচ্ছে। তারা টাকা মেরে দিচ্ছে। এটা অনেকেই জানে না প্রতিটি খেলাপীর বিরুদ্ধেই একটা করে মামলা আছে। মেরে খাওয়ার উপায় নেই। সময়ের প্রশ্ন মাত্র। ওপরের আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে আমানতকারীদের টাকা নিরাপদ রাখার জন্য অনেক ব্যবস্থা আছে। আইনী ব্যবস্থা আছে, হিসাবের পদ্ধতিগত ব্যবস্থা আছে, ‘লেন্ডার অব দ্য লাস্ট রেসর্ট’ ব্যবস্থা আছে। কথায় কথায় ব্যাংক ধসে যাওয়ার কারণ নেই। তবে এখানে প্রশ্ন স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং সুশাসনের। এ বিষয়গুলো যত বেশি নিশ্চিত করা যাবে ব্যাংকিং খাত তত বেশি নিরাপদ হবে। এর দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। এই জায়গাতেই আমরা মার খাচ্ছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকটা হয়ে পড়েছে ঠুঁটো জগন্নাথ। তার ক্ষমতা প্রচুর, অব্যবহারে ক্ষমতা নষ্ট হচ্ছে। বেসরকারী ব্যাংকের মালিকরা দিনে দিনে ক্ষমতাশালী হয়েছে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বুড়ো আঙ্গুল দেখাচ্ছে। এই জায়গাটা মেরামত করতে হবে। দৃঢ়ভাবে মেরামত করতে হবে। তত্ত্বগতভাবে আরেকটা প্রশ্নের জবাব দরকার। দেশে অনেক ব্যাংক, অনেক ধরনের ব্যাংক। দেশী ব্যাংক, সরকারী ও বেসরকারী। বিদেশী ব্যাংক। এত ব্যাংকের মধ্যে সকলের ‘শক্তি’ ও সামর্থ্য’ এক রকম নয়। কেউ বড় কেউ ছোট, কেউ নতুন, কেউ পুরনো। কেউ বটগাছের মতো নিরাপদ। কেউ কম নিরাপদ, তার মানে অনিয়মে জর্জরিত। কেউ নিয়মের মধ্যে কাজ করছে। আমানতকারীদের উচিত এসব ব্যাংকের বাছ-বিচার করা এবং তার বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। সাধারণভাবে কোন কোন ব্যাংক অনিয়ম করছে, তার খবর কাগজে ছাপা হচ্ছে। সেদিকে নজর রাখলে ব্যাংকের শক্তি ও সামর্থ্যরে খোঁজ পাওয়া যায়। এ ছাড়া আবশ্যকীয়ভাবে একটা কাজ হয়। প্রতিটি ব্যাংককে ‘রেটিং’ করাতে হয়। এবং তা করে ‘রেটিং এজেন্সি’ যারা পেশাজীবী সংগঠন। ওই রেটিং থেকে ব্যাংকের শক্তি বোঝা যায়। রয়েছে ব্যাংকের ‘ব্যালেন্সশিট’। প্রফিট এ্যান্ড লস এ্যাকাউন্ট। এসব স্টাডি করলেও ব্যাংকের শক্তি সম্পর্কে বোঝা যায়। এসবের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিলে ঠকার সম্ভাবনা কম। এবং হয় কী, খারাপ ব্যাংক ধীরে ধীরে আপোসেই উঠে যায়। অকার্যকর ব্যাংক, কম লাভজনক ব্যাংক উঠে যায়। ‘গ্রীনলেজ ব্যাংক’ কী আছে? নেই। কোথায় গেল? স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের সঙ্গে মার্জ হয়ে গেছে। এটাও একটা ব্যবস্থা। সরকারের জড়িত হওয়ার দরকার নেই। ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংক মিলেই ব্যবস্থা। আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। এক ব্যাংক আরেক ব্যাংককে কিনে নিতে পারে। দুই ব্যাংক এক হয়ে যেতে পারে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এসব আছে। সেখানে সরকারের কিছু করতে হয় না। পুঁজিবাদের নিজস্ব ব্যবস্থাতেই ভাল-মন্দের ফয়সালা হয়ে যায়। আমাদের দেশে ব্যাংকগুলোর বর্তমান যে অবস্থা তাতে সরকারকে সাময়িকভাবে হস্তক্ষেপ করতে হলেও অচিরেই ব্যাংকগুলোকে বোঝাপড়া করতে হবে বলে মনে করি। এভাবে চলবে না। খারাপদের আপোসেই চলে যেতে হবে। ভালরা টিকবে। সরকারকে আইনগত সহায়তা দিতে হবে। মার্জার, এ্যামালগেমেশন, টেকওভার ইত্যাদির ওপর আইন, বিধি জলদি তৈরি করুন। আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করে এসব আইন করুন। খারাপের বিদায়ের ব্যবস্থা আজ হোক, কাল হোক করতে হবে। ওই সময়ে যেন কোন আমানতকারী ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। ইতোমধ্যে যে কাজটি করা দরকার তা হচ্ছে ‘বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন’কে কার্যকরী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। ‘বাজার অর্থনীতি’ করতে চাইলে এটা দরকার। প্রতিযোগিতায় পরিবেশ নিশ্চিত করা দরকার। প্রতিযোগিতায় যারা টিকতে পারবে না তারা বাজার ছেড়ে দেবে- এই হওয়া উচিত নিয়ম। তবে সবাইকে আইনের মধ্যে কাজ করতে হবে। আইন মেনে কাজ করতে হবে। আমাদের অনেক ব্যাংকের সমস্যা হচ্ছে তারা আইন-বিধি মানতে চায় না। অনিয়ম করে ঋণ দেয়। ঋণের সীমা লঙ্ঘন করে। বেনামী ঋণ দেয়। সিকিউরিটি নেয় না। এসব কাজ আবার মালিকরা পুরস্কৃত করে। কিছু ব্যাংকারের সৃষ্টি হয়েছে যারা মালিকদের তুষ্টি ছাড়া কিছুই বোঝে না। এই দুষ্ট চক্রই ব্যাংকিং খাতকে সর্বনাশের দিকে ধাবিত করছে। আগ্রাসী ব্যাংকিং করে তারা সর্বনাশ ডেকে আনছে। এসব ক্ষেত্রে ‘স্ট্রং মনিটরিং’ ছাড়া গতি নেই। সব ব্রাঞ্চ দরকার নেই বড় বড় ‘বৈদেশিক শাখা’ মনিটরিং করলেই চলবে। অনিয়মের ৮০-৯০ শতাংশ সংগঠিত হয় এসব ব্রাঞ্চে যেখানে আমদানি-রফতানি ব্যবসা হয়। এগুলো ঠিকমতো মনিটরিং করলে আমানতকারীরা নিরাপদ থাকবে। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×