ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুক্তিযুদ্ধপন্থী জোটকে কেন ভোট দিতে হবে?

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ১৭ জুলাই ২০১৮

মুক্তিযুদ্ধপন্থী জোটকে কেন ভোট দিতে হবে?

প্রথমেই তরুণ, বয়স্ক নির্বিশেষে সব প্রজন্মের মানুষকে নিজেদের একটি মৌলিক প্রশ্ন করতে হবেÑ পৃথিবীর কোন দেশে কি সে দেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণকারী কোন দল, সে দলের নেতা-সমর্থকরা কখনও সরকার গঠন করে সে দেশটি শাসন করেছে? দু’একটি ব্যতিক্রমী দেশ যেখানে স্বাধীনতার স্থপতিদের হত্যা করে বা ক্ষমতাচ্যুত করে বিরোধী গোষ্ঠী ক্ষমতা দখল করলেও পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই স্বাধীনতা আন্দোলনে বা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলই সব সময় দেশ শাসন করে, করছে। স্বাধীনতার বিরুদ্ধতাকারী দল এবং নেতাদের রাজনীতি সব দেশে নিষিদ্ধ হয়। উপরন্তু দেশ ও জাতিবিরোধী অপরাধ, হত্যা, গুম, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুট ও অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ে তাদের দোষী সাব্যস্ত করে বিচারের আওতায় আনা হয়। সভ্য দুনিয়ার সামনে এর বড় উদাহরণ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের খলনায়ক হিটলারসহ নাজি বাহিনীর প্রধান নেতৃবৃন্দ এবং নাজি দলের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল। এই ট্রাইব্যুনালে ওদের যেমন বিচার হয়েছিল, তেমনি নাজি দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছিল। আজও বর্তমান ইউরোপে নাজি দল নিষিদ্ধ আছে এবং আজও প্রাক্তন নাজি কর্তাদের সন্ধান পাওয়া গেলে তাদের বয়স যাই হোক, বিচারে সোপর্দ করা হয়। এই বিচার এবং খুনী দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার নেপথ্যে প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবসভ্যতা এবং মানবিকতাকে সভ্যতার প্রধান মূল্যবোধ ও বিশ্বাসকে মানবতাবিরোধী, সভ্যতা ধ্বংসকারীদের ব্যক্তিগত এবং দলগত আক্রমণ থেকে সুরক্ষা প্রদান, যা ভবিষ্যত প্রজন্মকে এই বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে লক্ষ্য বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখতে সক্রিয় রাখবে। এ প্রসঙ্গে সবচাইতে জরুরী হয়ে উঠেছে দেশের জনমানুষ, তরুণ প্রজন্মের তার দেশ ও জাতির মঙ্গল এবং কল্যাণ অর্জনের জন্য যথার্থ কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণে সচেতনভাবে সক্রিয় হওয়া। স্মরণ রাখতে হবে ১৯৪১-এ জার্মানিতে হিটলারের জার্মান জাতীয়তাবাদের উত্থান সহজ ও সম্ভব করেছিল সে সময়ের জার্মান প্রগতিশীল দল ও সুশীল সমাজের নিষ্ক্রিয়তা এবং নীরব ও নমনীয় ভূমিকা। সমাজ থেকে জার্মান বর্ণবাদ, নাজিবাদ, ইহুদীবিরোধী প্রতিবাদ তোলা হলে হিটলারের ও তার নাজি দলের এমন বাধাহীন উত্থান সম্ভব হতো না। এটা ইতিহাসের একটি শিক্ষা, যথাসময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে না পারার জন্য বহু জাতি ও রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে গেছে। এই তথ্যের সঙ্গে পাঠক মিলিয়ে নিন ’৭২-এ বিজয়ী জাতি নতুন সরকার গঠন করে স্বাধীনতাবিরোধীদের চরম বিরোধিতা, ষড়যন্ত্র, বঙ্গবন্ধু, তার পরিবারের সদস্য, মুক্তিযুদ্ধের পরিচালক তাজউদ্দীনসহ প্রধান নেতাদের বিরুদ্ধে চরিত্র হননকারী ঘটনা ঘটানো, মিথ্যা রিপোর্ট প্রকাশ, কলকারখানায় আগুন দেয়া, মুক্তিযোদ্ধা, সাংসদ হত্যা, রাজপথে চরম অরাজকতা, ভারতীয় দূতকে লক্ষ্য করে বোমা হামলা, গুলিবর্ষণ, রাজপথে তরুণ হত্যা, বাকশালবিরোধী ভিত্তিহীন প্রচারণা- সবকিছু মিলিয়ে শত্রুপক্ষ ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু, তার পরিবারের সব সদস্য ও জাতীয় প্রধান চার নেতা হত্যার পরিবেশ তৈরি করে। সে সময় মুক্তিযুদ্ধ করা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি, নতুন সরকারের বিরোধিতা করাটা নতুন সরকারকে উৎখাতে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে তাদের ষড়যন্ত্রের সফল বাস্তবায়নের বিপুলভাবে সহায়তা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের মধ্যে একটি দল ছিল যারা স্বাধীনতা অর্জনের ফল পুরস্কার স্বাধীনতার পর নতুন সরকারের কাছে তখনই চাচ্ছিল। কিছু পাওয়ার জন্য তারা একটুও অপেক্ষা করতে রাজি ছিল না। যার ফল হলো যাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অতন্দ্র প্রহরী হয়ে নবজাতক শিশু রাষ্ট্রকে রক্ষা করার কথা ছিল, শিশু রাষ্ট্র ও তার নবগঠিত সরকার সেই পরিচর্যা থেকে বঞ্চিত হলো। এ ছিল সমগ্র বাঙালীর জন্য চরম দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যা, ঢাকা জেলে তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান বঙ্গবন্ধুর চার সহকর্মী, সৎ, দক্ষ ও যোগ্য নেতা হত্যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী দল, ব্যক্তিকে বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতোই মৃতপ্রায় করে ফেলেছিল। সে সময় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বিশ্বাসী, দেশপ্রেমিক আওয়ামী লীগের বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা নেতা, কর্মী, সমর্থক ভারতে প্রবেশ করে আরও একবার মুক্তিযুদ্ধ শুরু করতে চেয়েছিল। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে প্রায় ষোলো হাজার সেনাসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হারিয়ে, কোটি বাঙালী শরণার্থীকে আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসা দিয়ে বিপুল অথনৈতিক চাপে থাকা ভারতের পক্ষে আরও একবার বাঙালীকে স্বদেশী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সহায়তা করা বাস্তবে সম্ভব ছিল না। সে সময় পাকিস্তানী ভুট্টো সরকার, পাকিস্তানী বাহিনী, পাকিস্তানী গোয়েন্দা বাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী ও বঙ্গবন্ধুর বিরোধী শক্তি ছিল খুবই সক্রিয়। ভারতের সহায়তা ছাড়া অস্ত্র গোলাবারুদ লাভ করা সম্ভব ছিল না। আর ভারি অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া কোন সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করা সম্ভব নয়। মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের বড় সুযোগ ছিল ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট। দ্রুত সাভার সেনানিবাস থেকে সেনা মুভ করিয়ে গোলাহীন ট্যাঙ্কসজ্জিত খুনী সেনাদের পরাস্ত করে সরকারকে রক্ষা করার। যদি বঙ্গবন্ধু ইতোমধ্যে নিহত হতেন তাহলেও পরিবারের কোন কোন সদস্য বেঁচে যেত এবং সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ, বিশ্বস্ত চার জাতীয় নেতা প্রাণে রক্ষা পেয়ে সরকারের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারতেন। যাই হোক, সে সব ঘটেনি। আরও হতবাক হয়ে দেখলাম, অদ্ভুত এক উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ। জিয়াউর রহমানের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার ছদ্মবেশী এক পাকিস্তানী বঙ্গবন্ধু হত্যার বেনিফিশিয়ারী হয়ে নিচে উল্লিখিত পদক্ষেপগুলো একের পরে এক গ্রহণ করে কোন লুকোছাপা না করে দৃঢ় ও স্পষ্টভাবে নিজের যুদ্ধাপরাধী পক্ষের পরিচয়কে প্রকাশ করে। এ লেখাটি, এমন আরও রচনা লিখেছিলাম ৮২-৮৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত, যা ‘সত্য যে কঠিন’ নামের সঙ্কলনে পত্রস্থ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ও জিয়াউর রহমানের পরস্পরবিরোধী পদক্ষেপ পাঠককে এবং তরুণ প্রজন্ম, বিশেষত যারা আশির দশকে জন্মেছে এবং যাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন ঐ দশকে অতিবাহিত হয়েছে, তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে জিয়া কাদের মিত্র ছিল। এখানে সংক্ষেপে অংশবিশেষ তুলে দিচ্ছি, সঙ্গে কিছু সংযোজন করেছি। ১. বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় ১৯৭৩ সালের ১৮ এপ্রিল গোলাম আযম ও অপর যুদ্ধাপরাধীদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর গোলাম আযম দেশে ফেরত আসে। ২. বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭২ সালের ৪ নবেম্বর সংবিধানের ১২ ও ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘ধর্মভিত্তিক রাজনীতি’ রহিত করে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যকে সুরক্ষা প্রদান করে। ৩. অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি রহিতের সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্ত তুলে দিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উৎসমুখটি উন্মুক্ত করে দেয়। ৪. বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭২ সালের ৪ নবেম্বর সংবিধানের ৬৬ ও ১২২ অনুচ্ছেদ দ্বারা দালাল-যুদ্ধাপরাধীদের ভোটাধিকার ও সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার বাতিল করে। ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান সংবিধানের ১২২ অনুচ্ছেদটি তুলে দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের ভোটার হওয়ার রাজনৈতিক সুযোগ দেয়। ৫. জিয়াউর রহমান দ্বারা জারিকৃত মার্শাল ল’ অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে ১৯৭৬ সালের ১৮ জানুয়ারি যুদ্ধাপরাধীদের বাতিল হওয়া নাগরিকত্ব ফেরতের আবেদন করতে নির্দেশ দেয়া হয়। ৬. বঙ্গবন্ধু সরকার ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে ২৪ জানুয়ারি ৭২ সালের ‘দালাল আইন’ প্রণয়ন করে সারাদেশে ৭৬টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধী দালালদের বিচার কাজ শুরু করে। জিয়াউর রহমান ১৯৭৫-এর প্রেসিডেন্ট অর্ডার দ্বারা ’৭২-এর কোলাবোরেটস এ্যাক্ট বাতিল করে। ৭. ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধীর বিচার কাজ পরিচালনা করছিল। এ সময় বঙ্গবন্ধু সরকার খুন, গণহত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণ- এই চার অপরাধ যারা করেনি, কিন্তু অন্য ছোটখাট মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কাজ করেছিল তাদের জন্য ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর একটি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। এই ক্ষমার আওতায় ২৬ হাজার দালাল মুক্তি লাভ করে। কিন্তু ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী যারা খুন, গণহত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণের মতো যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল, তাদের বিচার প্রক্রিয়া ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। বিচার চলছিল ও অনেকে দ-িত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান সব বিশেষ ট্রাইব্যুনাল বন্ধ করে দেয় এবং সব দন্ডি ও বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীকে মুক্তি প্রদান করে। ৮. জিয়াউর রহমান ৭৬-৭৭ সালে সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ কর্তন করে ‘বিসমিল্লাহ’, আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ও সমাজতন্ত্র অর্থে ‘ন্যায়বিচার’ যোগ করে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিপরীতে যে ধর্মভিত্তিক দলটি যুদ্ধাপরাধীদের জন্ম দিয়েছিল, সেই ধর্মীয় রাষ্ট্রের প্রবক্তা জামায়াতের আদর্শের পক্ষেই কাজ করেছিল। ৯. জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক বিতর্কিত ঘটনা ঘটানোর জন্য চাকরিচ্যুতি থেকে বঙ্গবন্ধুর দয়ায় রক্ষা পেয়েছিলেন, বীর উত্তম খেতাবও পেয়েছিলেন। তিনি ’৭৫-এর হত্যার পর শাসক, সেনাপ্রধান, প্রধান সামরিক প্রশাসক এবং প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ক্যুয়ের নামে প্রায় চার হাজার বীর দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে ফাঁসি দিয়ে সেনাবাহিনীকে মুক্তিযোদ্ধামুক্ত করার কাজ করেছিলেন। কর্নেল তাহেরকেও এ সময় ফাঁসি দেয়া হয়। অপরদিকে যুদ্ধাপরাধী শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়। অন্য যুদ্ধাপরাধীরা মন্ত্রী ও অন্য উচ্চপদে নিযুক্ত হয়। ১০. জিয়াউর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী নেতা তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানের খুনীদের পুরস্কৃত করার মাধ্যমে ‘ইনডেমনিটি বিল’ দ্বারা তাদের বিচার বন্ধ করে দিয়ে নিজেকে খুনীদের পক্ষ হিসেবে প্রমাণ করেন। ১১.জিয়াউর রহমানই মুক্তিযুদ্ধজাত ঐক্যবদ্ধ বাঙালীকে ‘বাঙালী’ ও ‘বাংলাদেশী’ নামে বিভক্ত করে প্রকৃত অর্থে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং চেতনায় বিশ্বাসীদের প্রতিপক্ষ যুদ্ধাপরাধীদের পাশে দুর্বল ও বিভক্ত করে ফেলেছিলেন। এর ফলে লাভবান হলো যুদ্ধাপরাধীরা। মুক্তিযোদ্ধারা বিভক্ত, খ-িত হয়ে পড়ল। ১২. সবশেষে জিয়াউর রহমান জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ কোন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে বাজানো বন্ধ করেছিলেন। সে স্থলে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’, ‘আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’ ইত্যাদি গান বাজানো চালু করেছিলেন। গানগুলো ভালো, কিন্তু জাতীয় সঙ্গীতকে সরিয়ে রেখে অন্য গান গায়ানো, বাজানো অবশ্যই জাতীয় সঙ্গীতকে অসম্মান করার উদ্দেশ্যেই করেছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় খালেদা জিয়া ৯২ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত সোহরায়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত ‘গণআদালত’ অনুষ্ঠানে পুলিশী নির্যাতন চালিয়ে, মঞ্চ ভেঙ্গে দিয়ে, মাইক কেড়ে নেয়। গোলাম আযমকে নিরাপত্তা দিতে কয়েক দিন জেলে রেখে পরে মুক্ত করে তার নাগরিকত্ব ফেরত দিয়ে তাকে জামায়াতের আমির করার ব্যবস্থা করে। অপরদিকে ‘গণআদালতের’ বিচারক, সাক্ষীর ভূমিকা পালনকারী ২৪ জন কবি, শিক্ষক, আইনজীবী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীর বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ মামলা করে খালেদা সরকার। সেলুকাস কি আশ্চর্য এ জাতি! এরপর খালেদা-তারেক ২০০১-এ বিএনপি-জামায়াত জোট করে নির্বাচন করলে বিএনপি যে জামায়াতের মায়ের পেটের ভাই সেটি প্রকাশ্যে জানান দিতে দ্বিধা করেনি। ২০০১-এর বিতর্কিত নির্বাচনে জয়ী হয়ে যুদ্ধাপরাধী নিজামী এবং মুজাহিদকে শিল্প ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী পদে বসিয়ে সরকারের প্রশাসনযন্ত্রকে জামায়াতীকরণ করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা প্রশাসকদের অবসর দেয়া হয়। এ সময় তারেক-কামাল সিদ্দিকী মিলে ক, খ, গ, ঘ নামে প্রশাসক-কর্মকর্তাদের বিএনপি-জামায়াতের প্রতি আনুগত্যের মাপকাঠি তৈরি করে ইচ্ছামতো দলীয়করণ করে প্রশাসন। এ সময় মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষায় খাঁটি বিএনপি-জামায়াতীদের ভর্তি করিয়ে পড়াশোনা না করে, ক্লাস না করে পাস করিয়ে দেয়া হলে অনেক জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক এদের অপচিকিৎসার ফল জাতি দশ-পনেরো বছর পর দেখতে পাবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। এখন অহরহ ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর ঘটনা, দোষী চিকিৎসককে দ- দিলে ডাক্তারদের ক্যাডারের মতো উচ্ছৃঙ্খল আচরণ, চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়া ঐ সাবধান বাণীকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। বিসিএস-এর মাধ্যমে ঐ পাঁচ বছর প্রশাসনের জামায়াতীকরণ করা হয়, যার জের এখনও চলছে। এছাড়া খালেদা-নিজামী-তারেকের প্রশ্রয়ে দেশে বাংলা ভাই প্রমুখ জঙ্গী নেতা ও জেএমবি, হরকত-উল-জিহাদ ইত্যাদি শতাধিক জঙ্গী দল গঠিত হয়ে দেশে বোমা, গ্রেনেড হামলা শুরু করে। ২০০৪-এর একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা, শাহ কিবরিয়া হত্যাসহ হিন্দু আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা, হত্যা, লুট, ধর্ষণ, বাড়িঘর ভাংচুর, গ্রাম, দেশ ত্যাগে বাধ্য করাÑ এ পাঁচ বছর চলমান ছিল। সত্যিকার অর্থে ২০০৭-এ সেনা সমর্থিত নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার জাতিকে বিশাল এক স্বস্তি এনে দিয়েছিল এ কথা বলতেই হবে। এ সরকারই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করে ২০০৮-এর ডিসেম্বরে নির্বাচন দিলে তাতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধপন্থী মহাজোট বিজয়ী হয়। এভাবেই দেশ ও জাতি আবার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের পথে ফিরে আসে। দেখা যাচ্ছে সব ক্ষেত্রে দেশপ্রেমিক সরকার দেশকে দ্রুত উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিচ্ছে। এ কারণে ২০১৮-এ অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে জনগণকে উপরোক্ত দেশবিরোধী যুদ্ধাপরাধী-মিত্র বিএনপি এবং যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতের হয়ে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে মুক্তিযুদ্ধপন্থী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটকে বিজয়ী করার অন্য কোন বিকল্প নেই। কতগুলো প্রত্যক্ষ ইতিবাচক কর্মতৎপরতার শুভ ও কাক্সিক্ষত ফলের জন্য মুক্তিযুদ্ধপন্থী জোটকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করতে হবে : কারণ, ১৩. ২০১৪-১৫ সালে খালেদা-তারেক পেট্রোল বোমা মেরে দেশে যে অরাজক হত্যার অপরাজনীতি শুরু করে, তাতে দু’শ’র বেশি চালক, যাত্রী নিহত হয়! কয়েক হাজার বাস, ট্রাক, কার, রেল, লঞ্চ, স্কুল ঘর আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। ১. জাতি ও দেশকে তার মহান মুক্তিযুদ্ধ ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মূল চেতনা, আদর্শ, লক্ষ্যকে ধারণ করে অন্য সব সভ্য দেশের মতো দেশের শাসন ক্ষমতা সব সময় দেশের স্বাধীনতার পক্ষ শক্তির হাতে রাখতে হবে। তাহলেই দেশ ও জাতির প্রকৃত উন্নয়ন সংঘটিত হবে। ২. জাতির মুক্তিযুদ্ধের অসম্পন্ন কাজÑ যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার কাজকে অব্যাহত রেখে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার প্রক্রিয়া সমাপ্ত করতে হবে। কেননা, বিএনপি-জামায়াত জোট জয়ী হলে পূর্বের মতো এ বিচার বন্ধ করে দেবে, বিচারক-সাক্ষীদের হত্যা করবে, ট্রাইব্যুনাল বন্ধ করে দেবে। ৩. মুক্তিযুদ্ধ জোটই সন্ত্রাস জঙ্গীবাদ থেকে জাতিকে, তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করেছে। সন্ত্রাসের প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করে জঙ্গীবাদকে প্রতিহত করার ফলে বাংলাদেশ পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মতো জঙ্গী আবাসে পরিণত হয়নি। পক্ষান্তরে বিএনপি-জামায়াত জোট বাংলা ভাইসহ শতাধিক জঙ্গী দল গঠন করে দেশকে জঙ্গী কট্টর মৌলবাদের দ্বারা হত্যা-খুনের রামরাজত্ব কায়েম করে দেশকে পাকিস্তানের মতো সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল, সেটি প্রতিহত করতে হবে। ৪. বিএনপি-জামায়াত জোট কখনই বাঙালী জাতি ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নতি চায়নি। চায় না স্বনির্ভর আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে বাঙালীর অগ্রগতি, যেটি বাস্তবায়ন করে চলেছে দেশপ্রেমিক মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী দল ও জোট। ৫. বাঙালীর ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, উৎসব অনুষ্ঠান, যাত্রাপালা, সঙ্গীত, নাটক-সবকিছুই বাঙালী সংস্কৃতির ধারক মুক্তিযুদ্ধপন্থী উদার, অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল নীতিতে বিশ্বাসী মুক্তিযুদ্ধপন্থী জোট ও দল আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে রক্ষা পাবে। বিএনপি-জামায়াত জোট এ সব সংস্কৃতি চর্চাকে অনৈসলামিক নাম দিয়ে বন্ধ করে দেবে। অতীতেও দিয়েছে। বোমা হামলা করিয়েছে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে, উদীচীসহ নানা যাত্রা ও মেলা অনুষ্ঠানে। ৬. জঙ্গী সন্ত্রাসীরা তথ্যপ্রযুক্তিকে ধর্মের মনগড়া মিথ্যা প্রচারে ব্যবহার করে শিক্ষিত তরুণদের দিয়ে দেশী, বিদেশী নিরীহ মানুষ হত্যা করে অপরাজনীতির লক্ষ্য বাস্তবায়ন করে। পক্ষান্তরে তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধপন্থী দল তরুণ প্রজন্মকে নিজেদের জীবনমান ও রাষ্ট্রের নানা ক্ষেত্রে সেবাদানে কাজের উন্নয়নে কাজ করে চলেছে। ৭. আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধপন্থী দল যতবার ক্ষমতায় এসেছে ততবার জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জের মধ্যেও কৃষি, মৎস্যসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে। জামায়াত-বিএনপি দেশকে খাদ্যে পরনির্ভরশীল রেখেছে। যতদিন পর্যন্ত না দেশ ও জাতিবিরোধী বিএনপি-জায়ামাতের অপরাজনীতি চিরতরে বিলুপ্ত হবে, ততদিন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে বারবার ক্ষমতায় আনতে হবে। ৮. এতে ভবিষ্যতে সরকার ও বিরোধী দল- উভয়ে মুক্তিযুদ্ধপন্থী এবং দেশপ্রেমিক হবে, যেটি অন্যান্য সভ্য দেশে আছে। লেখক : শিক্ষাবিদ
×