ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

বিএনপি-জামায়াতের ভরসা এখন বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ১১ জুন ২০১৮

বিএনপি-জামায়াতের ভরসা এখন বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ

সাংগঠনিক অবস্থা ক্রমশ দুর্বল হয়ে আসা বিএনপির ভরসা ছিল এতদিন জামায়াতে ইসলামী। তাতেও বেশিদূর পথ পাড়ি দেয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসায় দুর্বিপাকে খাবি খাচ্ছিল যখন দলটি, আশার বাতিঘর হয়ে তখন দাঁড়িয়েছে ছাত্রশিবির, ছাত্রদল এবং ছাত্রলীগের শিবির ও ছাত্রদলপন্থীদের সমন্বিত কথিত সংস্কারবিরোধী আন্দোলন। যে আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্যই হচ্ছে সরকার উৎখাত এবং কারাগার থেকে বেগম জিয়াকে মুক্ত করা। দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত ও ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থী বিএনপির ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান’ তারেক রহমানের এতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠার নেপথ্যে সেই লক্ষ্যই কাজ করছে। তাই আন্দোলনকারীদের মদদ দিতে এগিয়ে আসার জন্য দলীয় পেশাজীবী নেতাদের প্রতি নির্দেশনামাও দিয়েছেন। জাসাস সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মামুন আহমেদকে আন্দোলনকারীদের সহায়তা প্রদানের টেলিফোন সংলাপ সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে ভাইরাল হয়েছে। সেখানে তারেকের আশা-আকাক্সক্ষা ফুটে ওঠেছে। দলীয় অন্যান্য পেশাজীবীর প্রতি নিশ্চয়ই একই বাণী নির্গলিত হয়েছে। সরকারের কোটাপ্রথা পুরোপুরি বাতিলের ঘোষণার পর আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা পুরোপুরি স্তিমিত হয়নি। খড়কুটোতে এখনও আগুন জ্বালানো রয়েছে। শিবিরপন্থী বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ ইতোমধ্যে সাংগঠনিক রূপ নিয়েছে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলে ৬১ সদস্যের কমিটিও গঠন করে ফেলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অবস্থান দুর্বল করে ফেলেছে। এই দুর্বলতার সুযোগটুকু তারা পুরোপুরি ‘সদ্ব্যবহার’ করছে বলা যায়। মেয়েদের হলে শিবিরের ছাত্রী সংগঠন ইসলামী ছাত্রী সংস্থার অবস্থান বেশ মজবুত বলা যায়। যার নিদর্শন দেখা গেছে উপাচার্যের বাস ভবনে তা-ব চালানোকালে হল ছেড়ে মেয়েদের বেরিয়ে আসার মধ্যে। এর নেতৃত্বে ইসলামী ছাত্রী সংস্থা ছাড়াও ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারী শিবিরপন্থীরাও ছিল। আন্দোলন হচ্ছে কোটা সংস্কারের দাবিতে, কিন্তু গভীর রাতে সশস্ত্র হামলা চালানো কেন হয়েছিল উপচার্যের বাস ভবনে, তার মাজেজা বোঝা দিব্যদৃষ্টি সম্পন্নদের জন্য কঠিন নয়। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের তারা সম্মোহিত করতে পেরেছিল। যেন ‘হ্যামিলনের বংশীবাদক’। কোটা সংস্কারের আন্দোলনের নামে তারা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাবিরোধী যে অবস্থান নেয়, তা উপলব্ধি করতে পারেনি সাধারণ ছাত্ররা। হুজুগে মেতেছিল হয়ত তারাও। যে আন্দোলন দিনের বেলা সভা সমাবেশ মিছিলের মাধ্যমে হওয়ার কথা তা প্রলম্বিত করে রাতের বেলা রাস্তা ও ক্যাম্পাস দখল করে নাশকতার পথে ধাবিত হওয়ার পেছনে কোন সুবুদ্ধি কাজ করেনি। রাতে ক্যাম্পাসে গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন ছাত্র মারা গেছে বলে গুজব ছড়িয়ে অরাজক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটানো হয়েছিল। কোটার সঙ্গে উপাচার্যের কোন সম্পর্ক না থাকার পরও উপাচার্যের বাস ভবনে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনাগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় কোটা সংস্কার আন্দোলনের আড়ালে ভিন্নতর উদ্দেশ্য কাজ করছিল। কিন্তু সে উদ্দেশ্য তাদের সফল হয়নি। তারা তাতে অবশ্য হতোদ্যম হয়নি। বরং তেজোদীপ্ত হয়ে সারাদেশের ছাত্র সমাজকে রাজপথে নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক সাফল্য অর্জন করেছিল। এতে তারা আরও বেশি উগ্রতার দিকে ধাবিত হতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত পারেনি। ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ শিবিরেরই অপর নাম। যে কোন বদউদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তারা বিভিন্ন নাম নিয়ে মাঠে নামে। গত শতকের আশি ও নব্বই দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছিল শিবিরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। তাদের হুকুম ছাড়া যেন ‘গাছের পাতাও নড়তে পারত না’। স্বাধীন মত প্রকাশ, সাংস্কৃতিক কর্মকা- এমনকি অন্য ছাত্র সংগঠনের তৎপরতাও ছিল নিষিদ্ধ প্রায়। সে সময় যে কোন অপকর্ম সাধনের পর শিবির ‘সাধারণ ছাত্র ঐক্য’, ‘সচেতন ছাত্র সমাজ’ ইত্যকার নামে বিবৃতি প্রদান শুধু নয়, মিছিলও করত ক্যাম্পাসে শিবিরের অপকর্ম ঢাকতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের কর্মকা- অনিশ্চিতভাবে নিষিদ্ধ থাকলেও তাদের গোপন সাংগঠনিক তৎপরতা থেমে থাকেনি। পাশাপাশি তাদের একটি অংশ সরকারী দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করে নেতৃত্বে অবস্থান নিতে পেরেছে। তাই কোটা সংস্কার নামক আন্দোলনে ছাত্রলীগের সেই অংশকে সক্রিয় দেখা গেছে। গত মে মাসে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ও কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর মাস পেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কমিটি গঠন হয়নি। ফলে ছাত্র রাজনীতিতে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। শিবিরপন্থী ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। রমজান মাসে তারা হলে হলে এবং টিএসসিতে নিয়মিত ইফতার পার্টির আয়োজন করেছে। সেখানে তাদের ভবিষ্যৎ কর্মসূচী নিয়ে কথাবার্তা বলেছে। সারাদেশে ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করার জন্য ঢাকার বাইরেও তাদের অনুসারীরা অনুরূপভাবে ইফতার পার্টির আয়োজন করেছে। এসব আয়োজনের নেপথ্যে অর্থায়ন কারা করেছে। তা অনুধাবন করা কঠিন নয়। মেধাবীরা চাকরি পায় না বলে মিথ্যে ধুয়া তুলে এরা আলোড়ন তোলার চেষ্টা করেছিল বৈকি। কিন্তু নাশকতা আর অরাজকতায় পথে ধাবিত হওয়ার কারণে ছাত্র মত ধরে রাখতে পারেনি। তাদের এই কর্মকা-ের পেছনে বিএনপি-জামায়াতের ইন্ধন পরিষ্কার। আরও গভীরে গেলে হয়ত পরিষ্কার হবে নির্বাচনী বছরকে মাথায় রেখে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থার অর্থায়নও রয়েছে কিনা। সরকারের কোটা বাতিলের ঘোষণার পরও তারা সড়ক পথে নেমেছিল ‘প্রজ্ঞাপন’ জারির আবদার নিয়ে। যার আদৌ কোন প্রয়োজন ছিল না। সরকারপ্রধানের গৃহীত সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে দাফতরিক তৎপরতার বিষয় চলাকালে তারা কেন সরকারকে ‘আলটিমেটাম’ দিতে চায় তার মাজেজা অনুধাবন করা কাটা নয়। অর্থাৎ বিভ্রান্তির বেড়াজালকে আরও সম্প্রসারিত করাই তাদের লক্ষ্য। টানা প্রায় এক যুগ ক্ষমতার বাইরে বিএনপি-জামায়াত জোট। এই সময়ে সাংগঠনিক শক্তি ক্ষয় ও লয়প্রাপ্ত হয়েছে আন্দোলনের নামে নাশকতা, অরাজকতার বিস্তৃতি ঘটানোর জন্য। এখানেই থেমে থাকেনি, তারা পেট্রোলবোমা মেরে দেড় শতাধিক মানুষকে হত্যা করেছে। হেফাজতকে মদদ দিয়েছে। অবরোধ ও হরতাল ডেকে মানুষ হত্যা জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তাই ক্রমশ জনবিচ্ছিন্ন হযে পড়েছে জনরোষে। দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে বেগম জিয়া চার মাসের বেশি কারাগারে। জনগণ বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে। বিএনপি নেতারা তার মুক্তির দাবিতে সারাদেশে লিফলেট বিনিয়েও জনমনে সামান্য রেখাপাত করতে পারেনি। এই দাবিতে সারাদেশে কোন আন্দোলনও তাই গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৬টির মতো মামলা রয়েছে। সেগুলো নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কারাজীবন তার জন্য বহাল থাকছে। রাজপথে কোন চাপ সৃষ্টি করতে না পারে বিএনপিকে এখন বিদেশমুখী এবং বিদেশী কূটনীতিকদের অনুকম্পা প্রার্থী। কূটনীতিকদের ইফতার পার্টিতে ডেকে তারা খালেদার মুক্তির কথা বললেও তাতে সাড়া মেলেনি। কূটনীতিকরা জানে কোন রাজনৈতিক মামলা নয়। দুর্নীতির মামলায় আইনগতভাবে খালেদা জিয়া কারাগারে, সুতরাং তার মুক্তির প্রসঙ্গে সরকারের ওপর কোন চাপ প্রয়োগেও তারা আগ্রহী নয়। ইতোমধ্যে ভারতে দলের শীর্ষ নেতারা গেছেন। লন্ডনও যাবেন। ভারতের সঙ্গে দেনদরবার তারা অতীতে করেও কোন ফল লাভ করেনি। খালেদার বিষয়ে ভারত নির্বাক এখনও। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান স্পষ্ট করেছেন যে, আইনী লড়াইয়ে খালেদার মুক্তিলাভ সম্ভব নয়। সুতরাং আইনী প্রক্রিয়ায় নয়। অন্যপন্থা অবলম্বন করবে বিএনপি জোট। এই পন্থা শতাধিক কারণে নাশকতা, অরাজকতার বহুল বিস্তৃতি ঘটানো। হার্ড লাইনে যেতে চায় বিএনপির তারেক রহমান সমর্থক অংশ। এই হার্ড লাইন মানে সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঘটিয়ে দেশ ও সরকারকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়া। কিন্তু বর্তমান সাংগঠনিক শক্তিতে এককভাবে করা যে সম্ভব নয় তারা তা জানে। জামায়াতের ওপর নির্ভরশীল হয়েও হালে পানি পাচ্ছে না। আন্দোলনে অক্ষম বিএনপির অবস্থান এখন দাঁড়িয়েছে ছাত্র সংরক্ষণ অধিকার পরিষদ। বিএনপি-জামায়াতের ঈদের পর কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচীর হুঙ্কার এই ছাত্র সংগঠনের ওপর নির্ভর করেই বলা যায়। তাই এর পেছনে তাদের শ্রম ও শক্তি বিনিয়োগ করছে। বিএনপি জোটের আন্দোলনের কর্মসূচী বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করার জন্য ছাত্র সংগঠনটি মাঠে নামছে ঈদের পর। শিবিরপন্থী ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ ঈদের পরপরই সারাদেশের জেলা, উপজেলা পর্যায়ে সভা, সমাবেশ ও মতবিনিময় সভা করে ঢাকায় কেন্দ্রীয় সমাবেশ আয়োজনের গোপন কর্মসূচী নিয়েছে। সরকার উৎখাত না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ ধরে রাখার জন্য হত্যা, অগ্নিসংযোগ, আশঙ্কা তা-বলীলা চালানোরও পরিকল্পনা রয়েছে। এ কাজে শিবিরের সশস্ত্র গ্রুপ মদদ দেবে। বিএনপি জঙ্গীদের ব্যবহার করার যে চিন্তা-ভাবনা এতদিন করে আসছে, তা থেকে সরে যায়নি। আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিলও মনে করেন আন্দোলন করার শক্তি ও সামর্থ্য বিএনপি হারিয়েছে ২০১৪ সাল থেকে বোমা মেরে মানুষ হত্যার জালে। নির্বাচন বানচাল ও দেশে অরাজকতা তৈরির যে ফন্দিফিকির আঁটছে, সে ব্যাপারে সরকারী দল সতর্ক, ছাত্র সংরক্ষণ অধিকার পরিষদের কর্মকা-ও তারা পর্যবেক্ষণ করেছেন। যথাসময়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে। ঈদের পর অর্থাৎ জুন মাসেই নাশকতার পথপরিক্রমা করতে চায় বিএনপি-জামায়াত জোট। সেই পথে নব গজায়মান ছাত্র সংগঠনটিকে কাজে লাগাতে তারা নানা ধরনের সংযোগ সাধন করছেন। জেলা-উপজেলা পর্যায়েও অর্থায়ন করার পরিকল্পনা তাদের রয়েছে নাশকতার কাজে। বিএনপি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করার শক্তি ও সাহস হারালেও নাশকতার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ রয়েছে বলা যায়। নির্বাচনের আর কয়েক মাস বাকি। এ সময় সরকারের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগে সমস্ত পন্থাকেও কাজে লাগাতে চায়। তবে আসার কথা, ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের মুখোশ ইতোমধ্যে উন্মোচিত হয়ে গেছে। ছাত্রদের প্রতিরোধের মুখে তারা আর দাঁড়ানোর ক্ষমতা ও শক্তি পাবে- এমনটা নয়। তবে ক্ষতিকর অনেক কাজই তারা করতে পারে সরকারী দল ও অঙ্গ সংগঠনের দুর্বলতার, অজ্ঞতার, উদাসীনতার সুযোগ নিয়ে। তবে জনগণের কাছে তারা নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে পারবে না বলেই সব অপকর্ম বিনাশিত হবেই।
×