ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা এনায়েত

অভিমত ॥ বিশ্ব কাঁপানো সেই কণ্ঠস্বর

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ৮ এপ্রিল ২০১৮

অভিমত ॥ বিশ্ব কাঁপানো সেই কণ্ঠস্বর

কেমন ছিল সেই দিনটি, একাত্তরের ৭ মার্চ। বাঙালী ও বাংলার মানুষের আত্মা সেদিন এক দেহে লীন হয়ে গিয়েছিল। সারা বাংলাজুড়ে ছিল উত্তাল জনসমুদ্র। সাহসের বরাভয় কাঁধে করে স্বাধীনতার স্বপ্ন বুকে নিয়ে তাদের জাগরণ ঘটেছিল। স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্ম কিংবা আজকের প্রজন্মের দৃষ্টিতে সেই দিনটির আবেগ, উদ্বাস, বাস্তবতা দৃশ্যমান হয়তো হয় না। কিন্তু সেই দিনের ঐতিহাসিক ভাষণ বাঙালীকে স্বাধীনতার পথে ধাবিত করেছিল। সেই ভাষণেই রয়েছে পাকিস্তানের দুঃশাসন ও বাঙালী নিপীড়নের ২৩ বছরের ইতিহাসের বিবরণ। বাংলার মানুষ হাজার বছরের পরাধীনতাকে পায়ে ঠেলে স্বাধীন সত্ত্বার বিকাশে সেদিন অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিল মুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার দৃঢ়তায়। সেদিনের সেই ভাষণ বাঙালীকে দিয়েছিল সাহস, সৌম, বীর্য, অমিততেজ এবং লড়াকু সেনানীর প্রত্যয়। সাড়ে সাত কোটি মানুষের অপর নাম শেখ মুজিবুর রহমান তখন জাতিকে সঙ্গে নিয়েছিলেন মুক্তির মন্ত্রে, জাগরণের গানে। সে এক অনন্য ইতিহাস। বাঙালীর জাগরণকাল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ সংগ্রামী নেতৃত্বের মূল স্তম্ভ হচ্ছে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। বাঙালীর রাজনৈতিক জীবনে এই ভাষণের গুরুত্ব ও অসাধারণত্ব ছিল বহুমাত্রিক। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বিচার করলেও এ ভাষণটির শ্রেষ্ঠত্ব অগ্রগণ্য। সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সে প্রেক্ষিতে কী কী করণীয় তার দিক-নির্দেশনা ছিল এই ভাষণে। ছিল স্বাধিকার আন্দোলনকে জনযুদ্ধে রূপান্তরিত করার কৌশল ও রূপরেখা। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা হয়েও ৭ মার্চের ভাষণে আসন্ন পরিস্থিতিতে তিনি জনগণের করণীয় তুলে ধরেছেন এভাবেÑ ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। আমি যদি হুকুম দেবার না পারি... মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।’ এ ধরনের তেজোদীপ্ত বাক্য কেবল একজন রাজনৈতিক নেতার নয়, একজন দেশ স্রষ্টার কণ্ঠেই ধ্বনিত হওয়া সম্ভব। সেদিন তাঁর অন্তর থেকে ছুঁয়ে আসা আত্মবিশ্বাসই বলেছিল বাংলার মানুষ স্বাধীনতা চায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেনÑ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই ‘ডি ফ্যাক্টো’ স্বাধীনতার ঘোষণা। এই ভাষণের পর থেকেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের আর কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্র বঙ্গবন্ধুর নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল। আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে ইউনেস্কোর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের’ স্বীকৃতলাভ করায় গত বছরের ২৫ নবেম্বর মাসে সারাদেশে আনন্দ শোভাযাত্রাসহ দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করা হয়। এই কর্মসূচীর অংশ হিসেবে ভালুকা উপজেলা পরিষদ ভাষণ উৎসবের আয়োজন করে। সেই উৎসবে ভালুকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক সঙ্গে অন্তত ৫০ হাজার খুদে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ধ্বনিত হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। পুরস্কৃতও করা হয় প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের। উপজেলা পরিষদ এ উৎসবের আয়োজন করে। ভালুকার ঘরে ঘরে তৈরি হয়েছে হাজার হাজার খুদে বঙ্গবন্ধু। ময়মনসিংহের ভালুকায় এটা মহোৎসবে পরিণত হয়। সারাদেশে কালজয়ী ১৮ মিনিটের সেই ভাষণ কত জনের মুখস্থ রয়েছে, তা জানা না থাকলেও ভালুকা উপজেলার চার শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৫০ হাজারেও বেশি কোমলমতি শিক্ষার্থী বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি মুখস্থ বলতে পারেন। শুধু তাই নয়, জাতির পিতা এই ভাষণটি প্রদানের সময় কখন কি কি অঙ্গভঙ্গি করেছিলেন ভালুকার ৫০ হাজার খুদে শিক্ষার্থী তা হুবহু করতে শিখেছেন। হাজার হাজার কোমলমতি শিক্ষার্থীর হৃদয় জাতির পিতার ঐতিহাসিক ভাষণের চেতনায় উজ্জীবিত করার কারিগর ছিলেন ভালুকা উপজেলার সাবেক উপজেলা নির্বাহী অফিসার কামরুল আহসান তালুকদার। তিনি বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব। তিনিই উৎসবের মূল পরিকল্পনাকারী। কামরুল আহসান তালুকদার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে ‘জাতীয় ভাষণ’ এবং এই দিনটিকে ‘জাতীয় ভাষণ দিবস’ হিসেবে ঘোষণার জন্য ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর অনুরোধপত্র পাঠিয়েছিলেন। এরপর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফাকে প্রধান উপদেষ্টা, ভাইস চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম পিন্টু ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান মনিরা সুলতানা মনিকে উপদেষ্টা করে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়। তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবদুল্লাহ আল জাকির, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শহীদুজ্জামান, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সমন্বয়ে বিচারক প্যানেল গঠন করে ভাষণ উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ৭ মার্চের কালজয়ী এই ভাষণের মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতির জেগে ওঠার মন্ত্রকে শিক্ষার্থীসহ তরুণ প্রজন্মের মধ্যে স্থায়ীভাবে গ্রথিত করা হবে। চার শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে মাসব্যাপী ভাষণ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। উপজেলার প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভাষণের ১ হাজার ২০০ সিডি এবং এর মুদ্রিত কপি বিতরণ করা হয়। প্রথমে স্কুল পর্যায়ে, পরে ইউনিয়ন পর্যায়ে সেরা বক্তা নির্বাচিত করা হয়। এভাবে চারটি বিভাগে ১২ জন সেরা ভাষণদাতা চূড়ান্ত হয়। সিদ্ধান্ত ছিল, ৭ মার্চ ভালুকা ডিগ্রী কলেজ মাঠে শিক্ষার্থী-শিক্ষক, অভিভাবক ও ভালুকাবাসীর সমন্বয়ে দুই লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশে এ ১২ প্রতিযোগীকে পুরস্কার প্রদান করা হবে। এর আগেই কামরুল আহসান বদলি হলে পরিকল্পনায় ছন্দপতন ঘটে। তবে তার সেই পরিকল্পনার আলোকেই এ উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ উৎসবকে কেন্দ্র করে উপজেলার প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে উৎসবের যে আমেজ তৈরি হয়েছিল, তা সত্যি গর্ব করার মতো। এই উদ্যোগের জন্য কামরুল আহসান তালুকদারসহ সংশ্লিষ্টরা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে এই ধরনের উদ্যোগ সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেয়া উচিত। বর্তমান সরকার ইচ্ছা পোষণ করলে এ বিষয়ে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারেন। লেখক : সাংবাদিক
×