ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

জীবনানন্দ দাশ কুয়াশা পথের চিত্রিত ছন্দ

প্রকাশিত: ০৭:২১, ৯ মার্চ ২০১৮

জীবনানন্দ দাশ  কুয়াশা পথের চিত্রিত ছন্দ

কবি জীবনানন্দ দাশ চৈতন্যময় একজন নিঃসঙ্গ মানুষ। অন্তরাশ্রয়ী বেদনায় যিনি ছিলেন নিমজ্জিত। সৌন্দর্য আর নিয়তির ছায়ার সম্মিলনে যে অবরুদ্ধ হাহাকার বোধ সেখানে অসংখ্যজনের মাঝে থেকেও তিনি ছিলেন একা। তার বক্তব্য ও ভাষায় চিত্রিত হয়েছে নিম্নগামী বিষন্নতা। যেখানে একাকীত্বের সংরাগ নিজের ছায়ায় নিজের ছবিকে পিছু ফিরিয়ে আনে। নির্বেদ নির্জনে একাকী জলের মতো ঘুরে ঘুরে কথা বলে, বলি আমি এই হৃদয়েরে সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়। আশ্চর্য ঘোরলাগা বিস্ময় সৃষ্টি করে জীবনানন্দ তার বিপুল সৃষ্টি সম্ভারে রেখে গেলেন অতৃপ্ত আত্মার নির্ঘুম প্রান্তরের কম্পিত ছায়া। জীবন ঘনিষ্ঠ কিংবা জীবন বিচ্যুত অভিমানী বোধে নিরন্তর পুড়ে ছায়ামাখা ঘাসে রেখে যান জীবনেরই শেলতীব্রতা। অনেক চাওয়া আর পাওয়ার দ্বান্দ্বিক প্রবাহে চিন্তায় আচ্ছন্ন গায়কী স্বভাব যখন নিস্তেজ যে কোন সংবেদনশীল মানুষ নিজেকে নিজের ভেতর টেনে আনে খরখরে অভিমানে। অভিমানী মনের ক্রিয়ায় প্রতিক্রিত হতে থাকে বিষণœতা। চূড়ান্ত যন্ত্রণায় ভালবাসাজনিত অবক্ষয়ে ক্ষয়ে যেতে থাকে গ্রন্থিত অদেখার আলো। যার অনিবার্য উচ্চারণ ‘মনে হয় এর চেয়ে অন্ধকারে ডুবে যাওয়া ভাল।’ বাস্তব জীবনের বিচ্যুত রেখা পাড়ি দিয়ে শুধু অন্ধকারে সন্নিহিত হয়ে পড়ে সকল অভিন্ন মেঘ। হয়ত কুয়াশা পথের চিত্রিত ছন্দের নাম অনুরুক্ত অঙ্গীকারে শুধুই একাকী হওয়ার চিত্র ভাষা- কী এক ইশারা যেন মনে রেখে একা একা শহরের পথ থেকে পথে অনেক হেঁটেছি আমি’ তবু সে হাঁটায়, নিরবচ্ছিন্ন আয়োজনে কীভাবে কেমন করে নেমে আসে অবসাদ। সকল দৃষ্টি গ্রাহ্যতায় জীবন, মৃত্যু আর প্রেমের অবসন্ন বুনটে আবার অভিমানী উচ্চারণ- ‘জানি আমি তোমার দু’চোখ আজ আমাকে খোঁজে না আর পৃথিবীর পরে-’ একটা অদৃশ্য সত্তার খোঁজে মন যেমন ছুটে যায় গৃহ থেকে গৃহান্তরে, পৃথিবীর পথে পথে পথচারী হয়েও অখ- চৈতন্যের মাঝে ছড়িয়ে দেয় অভিজ্ঞ কল্পান্তের সুর- যেখানেই যাও চলে হয় নাকো জীবনের কোন রূপান্তর, এক ক্ষুধা এক স্বপ্ন এক ব্যথা বিচ্ছেদের কাহিনী ধূসর একই ধূসরতার জীবনে অভিজ্ঞতার নীল চেতনায় অভিষিক্ত কবি বার বার রক্তাক্ত বেদনায় ম্রীয়মান হন। সময়ের মহাপরিধি পাড়ি দিয়ে একে একে সকল আনন্দের উন্মেষ থেকে যখন জীবনের বৃন্তচ্যুতি ঘটে অমলিন হাহাকার নির্বিকার আর্তনাদ দেখি সৃষ্টির প্রকাশে। এক ধরনের বিতৃষ্ণায় নুয়ে আসে ভেতরের মন। জীবনানন্দের প্রায় সব সৃষ্টিতে রয়েছে বিলম্বিত বিষাদের ছায়া। সে বিষাদের বৃত্তের ভেতর অসংখ্য বার গুঞ্জরিত হয়েছে মৃত্যু। সম্ভবত সবচেয়ে বেশিবার উচ্চারিত শব্দ জীবনানন্দের কবিতায়। অবসন্ন হৃদয়ের দোলাচলে বিপর্যস্ত পটভূমি থেকে এক নিগূঢ় সন্ধ্যার আর্তি বার বার ভেসে আসে। স্ফুর্তিহীন প্রেমের ভেতরে ক্লান্ত আকাক্সক্ষায় বিমিশ্র ক্ষোভের সঞ্চালন ঘটে। নিঃসহায় সময়ের ভাঁজে পিষ্ট হতে হতে সম্পৃক্ত মনন ক্রমে নিষ্প্র্রভ হয়ে আসে। মৃত্যু সেই নি®প্রভ অঙ্গীকারের অনবদ্য উচ্চারণ। তার কাছে কেবলই মনে হয় ফাল্গুনের ছায়ামাখা ঘাসে শুয়ে ‘এখন মরণ ভাল কেননা, জানা নেই কোন্ পথে কোন্ ঘরে যাব। কোথায় উদ্যম নেই, কোথায় আবেগ নাই, চিন্তা স্বপ্ন ভুলে গিয়ে শান্তি আমি পাব।’ একি চূড়ান্ত যন্ত্রণার নিরুত্তাপ? নাকি অবহেলার আয়োজনে ঘেরা প্রত্যক্ষ অবসাদ? প্রেমের আকাক্সক্ষায় জীবন যখন উন্মুখ হয়ে ওঠে তখন হঠাৎ যদি মৃত্যুর ভেতর ঘনীভূত হতে থাকে অনুচ্চারিত বিরহ তবে তার নিষ্ঠুরতা কী ভীষণ, জীবনের অনুপলে কী সাংঘাতিক অসহায়তার রেখা ফুটে ওঠে তার প্রতিচিত্র দেখি। শিকার, কিংবা ‘ক্যাম্পে’ কবিতায়। ধ্বংসের নিরবচ্ছিন্ন আয়োজনে প্রেম-প্রাণের ওলট-পালট অশরীরী দৃশ্যাবলীর অনুরণন ঘটে, অন্ধকার, কিংবা অঘ্রাণ প্রান্তরে কবিতায়। কেন মিছে নক্ষত্রেরা কবিতায় বলতে শুনি- কেন মিছে নক্ষত্রেরা আসে আর, কেন মিছে জেগে ওঠে নীলাভ আকাশ কেন চাঁদ ভেসে ওঠে, সোনার ময়ূরপঙ্খী অশ্বত্থের শাখার পেছনে কেন ধুলো সোঁদা গন্ধে ভরে ওঠে শিশিরের চুমো খেয়ে- গুচ্ছে গুচ্ছে ফুটে ওঠে কাশ? কবি জীবন বিমুখ প্রান্তরে প্রকৃতির প্রাত্যহিকতাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করছেন। এত অন্তরঙ্গ সুবিন্যাসে স্থিত আলোকণার কি প্রয়োজন? পৃথিবীর অতৃপ্তির কোলাহলে সাংসারিক সীমানার উর্ধে প্রখর চেতনালোকে যে জীবন বোধ কবি লালন করেছিলেন সাধারণ জীবন স্তর থেকে তা একেবারে ভিন্নতর। সে ভিন্নতার সহযাত্রী কবির কেউ ছিল না তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। যদিও অদৃশ্য রোমান্টিক নারীর আনাগোনা অনেকগুলো কাব্যিক শরীরে বহমান। স্ববিরোধী সত্তায় সেই অদৃশ্য একজন অনন্ত বিরহের সীমারেখায় দাঁড়িয়ে কবির হৃদয়ে স্থাপিত করে অসামান্য বোধের। কাল সচেতন কবি হিরন্ময় আভায় প্রত্যক্ষ করেন ইতিহাসের সচল চাকা। সময় কখনও থেমে থাকে না। পৃথিবীও থেমে নেই। সৃষ্টির প্রথম পর্ব থেকে আজকের এই জটিল পৃথিবী যেখানে বিপরীত ভাবগত সত্তা তুলে ধরে প্রকৃত অর্থে সভ্যতা আর অসন্তোষের অবিরল শূন্যতার গ্রাস। যেখানে অতিরিক্ত সংবেদনশীল মানব মন বিদীর্ণ বিভায় মুষড়ে পড়ে হাহাকার করে ওঠে। শুধু হাহাকারেই তার পরিসমাপ্তি নয়, বাস্তবের সব ধরনের অসুন্দরকে গ্রহণ করেও কল্পনা বিলাসী মন সৌন্দযর্ অšে¦ষণে শান্তি খুঁজে বেড়ায়। দু’দ- শান্তির জন্য হাজার বছর পথ হেঁটে আসেন। পৃথিবীর সব লেনদেন চুকিয়ে দেবার পরও অন্ধকারের মুখোমুখি বসার সাধ জাগে। মৃত্যুর সঙ্গেই অন্বিত হতে থাকে জীবনে বেঁচে থাকবার সফল সুন্দরের ধ্যান। আমাদের সত্যিকার বাঁচা কেবল সেখানেই থাকতে পারে যেখানে সুন্দরের সহাবস্থানে সব শূন্যতাকে আপন মনে হয়। কিন্তু সে সুন্দর বড় বেশি ক্ষণিকের। মুহূর্তমাত্র, তার রূপান্তর ঘটে বার বার। ইশারায় তার হাতছানি রহস্যছায়ায় ডেকে ডেকে দূর দিগন্ত রেখায় মিশে যায়। তাকে পাওয়ার জন্য ছুটে গিয়ে বিক্ষুব্ধ মন সংক্ষোভে জ্বলে ওঠে। মহাজাগতিক চেতনায় লালিত কবি বলে ওঠেন- কাল রাতের প্রবল নীল অত্যাচার আমাকে ছিঁড়ে ফেলেছে যেন, আকাশের বিরামহীন বিস্তীর্ণ ডানার ভেতর পৃথিবী কীটের মতো মুছে গিয়েছে কাল! অন্তর্গত বেদনায় পুড়ে পুড়ে ন্ডল জীবনের উপান্তে দাঁড়িয়ে কবি প্রত্যক্ষ করেন আকাশের বিস্তীর্ণ ডানার ভেতর পৃথিবী কীটের মতো মুছে যায়। একটা ভয়াল অন্ধকারের কাছে সুস্মিত আলোর অপমৃত্যু রোধে কবি নিথর এবং আড়ষ্ট হয়ে যান। কেউ কেউ সাধারণ একটা জীবন পেয়েও অনন্ত জীবনের মতো তাকে ধারণ করে যুগগত পরিবর্তন ঘটিয়ে কালান্তরের শব্দ ধ্বনি শোনান। সেই জীবনের সকল সত্তার স্বরূপ ধীরে ধীরে কালোত্তীর্ণ হয়ে যায়। তবুও জীবন পিপাসার ভান্ডারে ঘুরপাক খেতে থাকে হৃদয় বিদারক অভিমান। অভিমানের উৎস মুখে প্রাণবন্ত জিজ্ঞাসার ধাপ ভেঙ্গে কবি পৌঁছে যান কোন দূর নির্জন নীলাভ দ্বীপে। সেখানেও পৃথিবীর সমস্ত রূপ অমেয় তিমির দুর্গন্ধের মতো। আবারও ট্র্যাজিক সত্তায় কবি প্রাণ বাষ্পাকুল। আমার সমস্ত হৃদয় ঘৃণায় বেদনায় আক্রোশে ভরে গিয়েছে; জীবনের অন্য সব নিশ্চয়তা যখন একে একে অনির্ভরশীল মাত্রায় ক্রমশ ঘোলাটে হয়ে ওঠে তখন বিষাদ ঘন আবেগের লৌকিক উপমায় নিয়তি নির্ধারিতভাবে যুক্তি ও বিশ্লেষণে ঝরা পালকের ছড়াছড়ি। ধূসর পৃথিবীর বাসিন্দা হয়েও বহনহংসরূপী জীবনানন্দ বনহংসীর কাছে আশ্রয় পেতে চাইলেন। যদিও পরে কবি যথার্থই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন সব কিছুই কল্পনার। যার জন্য অনায়াস আক্ষেপে পুনরুক্তি- স্বপ্নের ধ্বনিরা এসে বলে যায়, স্থবিরতা সবচেয়ে ভাল নিস্তব্ধ শীতের রাতে দীপ জ্বেলে অথবা নিভায়ে দীপ বিছানায় শুয়ে স্থবিরের চোখে যেন জমে ওঠে অন্য কোন বিকেলের আলো সেই আলো চিরদিন হয়ে থাকে স্থির, সব ছেড়ে একদিন আমিও স্থবির হয়ে যাব; সেদিন শীতের রাতে সোনালি জরির কাজকে প্রদীপ নিভায়ে বর বিছানায় শুয়ে; অন্ধকারে ঠেস দিয়ে জেগে রব বাদুড়ের আঁকাবাঁকা আকাশের মতো। স্থবিরতা কবে তুমি আসিবে বলো তো। এখানে গতিকে তাড়িয়ে স্থবিরের আকাক্সক্ষায় কবি অধীর হয়ে আছেন। বিরোধী ভাবনায় আক্রান্ত কবি গতির প্রাণময়তাকে ধারণ করতে রাজি নন। স্থবিরের চোখে জমে ওঠে অন্য কোন বিকেলের আলো। অন্য কোন অন্তর্গত বোধ। অবিন্যস্ত বিষণœতা ভরা সূর্যের তীব্রতায় সিন্ধু সারস উড়ে যায় কলরব করে। সেখানে নিঃসঙ্গ মুখের রূপ বিশুষ্ক তৃণের মতো। রক্ত ঝরা কল্পনার নিঃসঙ্গ দুপুর- ‘মেঘের দুপুরে, আহা, ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে; সেখানে আকাশে কেউ নেই আর, নেই আর পৃথিবীর ঘাসে। তবুও অপার সম্ভাবনাময় জীবনে কবি অন্তহীন আশার ঔজ্জ্বল্যে মৃত্যু ও বিষাদের পরিক্রমাকে ছাড়িয়ে বিশ্বাস আর দৃঢ়তায় নিজেকে দাঁড় করান। কল্পনার স্বপ্নমাখা কম্পিত মন জলের নিঃশব্দ ঢেউয়ে শব্দ তুলে বলে ওঠে- মৃত্যু এলে, মরে যেতে হবে ভালবাসা নদীর জলের মতন হয়ে রবে, জলের থেকে ছিঁড়ে গিয়েও জল জোড়া লাগে আবার যেমন নিবিড় জলে এসে। মৃত্যুকে স্বাভাবিক পরিণতি ভেবে ভালবাসার আশাবাদ ধ্বনিত হয়েছে। বিচ্ছিন্ন বোধ থেকে অবিচ্ছিন্ন জলের মতো ভালবাসা জোড়া লেগে যাবে নিবিড় জলে এসে। কিন্তু চিরন্তনতার ছোঁয়ায় নিরালম্ব জীবনবোধে অভ্যস্ত কবি পুরোপুরি আশাহীন হয়ে যাননি সত্য কিন্তু বিপন্ন বিস্ময়ে মহাজিজ্ঞাসার কালান্তর ঘটিয়েছেন। বিস্ময় চিহ্নিত বিষাদিত মৃত্যুকেই আরাধ্য সঞ্চয় ভেবে এঁকে গেছেন জীবনের নিঃশেষিত রূপ। প্রাত্যহিক সাধারণ্যে সহসা কবি মিশে যেতে পারেননি বলেই কবিকে একা থাকতে হয়েছে নিজের মতো করে নিজস্ব জগতে যুগান্তরী কল্পনাশ্রয়ী রূপে মনকে ছুটিয়েছেন এশিরীয় থেকে বেবিলন পর্যন্ত। মালাবার পাহাড়ের কোল থেকে শঙ্খমালা নারীর কাছে যেখানে তার প্রেমিকের ম্লান নিঃসঙ্গ মুখের রূপ শাশ্বত সূর্যের তীব্রতায় কলরব করে উড়ে যায়। বিষন্ন পৃথিবীতে- দুপুরের অসীম আকাশ শুধু নিঃসঙ্গ ধ্যানের অনুবর্তী আলো ছায়াকে হরণ করেনি ইচ্ছা, চিন্তা, স্বপ্নকে দূরের মায়াবী আরশিতে প্রতিফলিত করেছে বার বার। রহস্যের উন্মোচনে হলুদ-হলুদ জ্যোস্না ভাসিয়ে নিয়ে যায় নীল নীল রূপালি নীরব। বিকীর্ণ জীবন জুড়ে সমুদ্র স্ফীত অন্ধকার দেবদারু দ্বীপের নক্ষত্রের ছায়া চেনে না- এমনকি পৃথিবীর মানুষীর রূপ। তাই অবসাদ সুখে বিচ্ছিন্ন বিমুখ কবি প্রাণে প্রাণে একাকী হয়ে যেতে থাকেন। শোনেন কেবল মৃত নিশ্বাসের স্বর। আলোহীন আলোর মায়ায় অতলান্ত ইচ্ছায় শুধু বিষন্নতার অপূর্ণাঙ্গ ক্লেদ। মানুষের মন সাপের আঁধার মুখে নিঃস্ব করে পতঙ্গের হৃদয়ের ব্যথা। কবি লীন হয়ে যান সেই একাকী ব্যথার ঘোরে। মৃগতৃষ্ণায় কাতর কবি স্বপ্নের জগতে ঘুরপাক খেতে বলে ওঠেন- পৃথিবীর পুরনো সে পথ মুছে ফেলে রেখা তার। কিন্তু এ স্বপ্নের জগত চিরদিন রয়! সময়ের হাত এসে মুছে ফেলে আর সব- নক্ষত্রের আয়ু শেষ হয়। ঘুমহীন ক্লান্তির অনপেক্ষ স্তব্ধতায় বাদামী হরিণ ভোরের আলোয় নেমে আসে। বিবর্ণ ইচ্ছার মতো বিশুদ্ধতায় কেবল শাদা মাটির কঙ্কাল। নক্ষত্রের মৃত্যুর শীতলতায় প্রবহমান যন্ত্রণার ভেতর আলোর মূর্খ উচ্ছ্বাস। সুগভীর অন্ধকারে সমস্ত পৃথিবী নিমগ্ন হয়ে থাকে। অনাবিল হৃদয়বাদী কবি অনুরক্ত অভিমানে বার বার অদৃশ্যের অন্তরালে লুকিয়ে থাকতে চান- ‘গভীর অন্ধকারে ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত আমাকে কেন জাগাতে চাও? হে সময় গ্রন্থি, হে সূর্য, হে মাঘনিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি, হে হিম হাওয়া আমাকে জাগাতে চাও কেন। এ নশ্বর ধরাধামে বিবিক্ত সুন্দরের ধ্যানে নিমজ্জিত কবি আর জেগে উঠতে চান না। প্রতীকী নির্জনতার ঘেরাটোপে কবি নিজেই নিজেকে বন্দী করে রাখতে চান। বিচ্ছেদের বিষন্ন লেগুন কেঁদে ওঠে। কবি দৃঢ় স্বরে উচ্চারণ করেন- ধানসিঁড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকব- ধীরে পউষের রাতে কোনদিন জাগব না জেনে- কোনদিন জাগব না আমি- কোনদিন আর। হেমন্তের নিঃস্ব সন্ধ্যার মতো কবির এত বিষন্ন নীরব অভিমানী উচ্চারণে ম্লান হয়ে আসে নীল কস্তুরি আভার চাঁদ। নীল কস্তুরি আভার চাঁদকেও উদ্যমহীন, স্বপ্নহীন শান্ত ও স্থির মনে হয়। যেন অলস মাছির শব্দে ভরে থাকে সকালের বিষন্ন সময়।’ সংসার সমাজে প্রত্যেক চলমানতায় থাকে অপূর্ণতার আভাস। সুখে-দুঃখে অবিরত আনন্দ মাখা জীবনে মানুষ প্রতিবার চেষ্টা করে বহুবিধ যন্ত্রণার শীর্ষ চূড়া ভেঙ্গে দিতে। এই ভেঙ্গে দেয়ার মানসিকতায় সে যখন নিস্তেজ হয়ে পড়ে তখন বিপ্রতীপ অবসন্ন মননে শৈল্পিক অন্ধকারে নিজেকে ডুবিয়ে রাখেন। জীবনানন্দ বহু ঊর্ধ্বলোকের চেতনায় আবিষ্ট ছিলেন সময় থেকে সময়হীনতায় আর অবিরত চিন্তার চলমানতায়। অসম্ভব কল্পনাশ্রয়ী বোধে নিজেকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে কালোত্তীর্ণ শিল্প রেখায় হেঁটে গেছেন সঙ্গীহীন। অনন্তের মতো একাকীত্বে আপন ভগ্নস্তূপে চিত্রের পর চিত্র সাজিয়ে গেছেন। বিশৃঙ্খল সমাজের গোলক ধাঁধার ভেতর থেকে গুমরে গুমরে উঠেছে তার অভিমান। ভীষণ বিলাপী সুর একাগ্র আঁধারে ডুবে যায়- সকল লোকের মাঝে বসে আমার নিজের মুদ্রাদোষে আমি একা হতেছি আলাদা আমার চোখেই শুধু ধাঁধা আমার পথেই শুধু বাধা? কবি অন্য আর সবার চেয়ে আলাদা হয়েছিলেন কিংবা হতে পেরেছিলেন। তাতে তাকে পাড়ি দিতে হয়েছিল ধূসর রক্তাক্ত অধ্যায়, ক্লান্ত কবির বুকে থেকে থেকে বাজে অসহায় এক কণ্ঠ- কোনদিন মানুষ ছিলাম না আমি। হে নর, হে নারী, তোমাদের পৃথিবীকে চিনিনি কোনদিন; কবি জীবনানন্দ তার পৃথিবীকে চিনেছেন নিজের মতো করে। আমাদের চেনা-জানা পৃথিবীর থেকে এক ভিন্নতর পৃথিবীর স্রষ্টা তিনি। বিষাদ বেদনা আর বিষন্নতায় ভরা অতিমাত্রিক অভিমান ভাসে সে পৃথিবীর অসীম আকাশে।
×